বাংলা ভাষাচর্চায় শৈলীবিজ্ঞান কথাটি বহুল আলোচিত। ইংরাজি Stylistics শব্দের অনুসরণে গঠিত এই শব্দটি কবিতা বা সাহিত্যে বিনির্মাণ রীতিকে তুলে ধরে, তার অন্তরঙ্গ বিচার করে সৌন্দর্য ও আনন্দদানের কারণকে বিচার করে। কাব্যের শৈলীচর্চার ক্ষেত্রে কবিতাটি রসপ্রসঙ্গে দ্বিধা থাকে না; আর অন্তরঙ্গ বিচারের মধ্যে কবি সৃষ্ট শৃঙ্খলাবোধকে তুলে ধরা হয়। এখন ‘সোনার তরী’ কাব্যের শেষ কবিতা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’-র কাব্যশৈলী বিচারের মাধ্যমে কবিতাটি বিশেষ অনুধাবন করব।

‘সোনার তরী’ কাব্যের একটি পরিপূরক কবিতা নিরুদ্দেশ যাত্রা, জমিদারের কাজে পদ্মার বোটে করে যখন পদ্মার মানুষজনের কাছে পৌঁছেছিলেন তখন তাঁর মনে নিরুদ্দেশ সৌন্দর্য আকাঙ্ক্ষা ও সুখ দুঃখ বিরহ মিলন পূর্ণ জীবনে প্রবেশের ইচ্ছা জেগেছিল। ‘ছিন্নপত্র’ ও ‘সোনার তরী’ কাব্যে যার ছাপ সুস্পষ্ট।

‘সোনার তরী’ এবং ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ দুটি কবিতাতেই এসেছে নাবিকের কথা, এসেছে সৌন্দর্যচেতনা ও বিরহ ভাবনা। সোনার তরী কবিতায় নাবিক সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা প্রকাশিত হয় কিন্তু নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতায় এসে বোঝা গেল সেই নাবিক এক সুহাসিণী রমণী৷ সোনার তরীতে কবির ঠাঁই না হলেও নিরুদ্দেশ যাত্রাতে এসে কবি ঠাঁই পেলেন।

প্রথম স্তবকেই দেখি চেনা নাবিকের কথা, যে সোনার তরীতে অচেনা ছিল। কবি বলেন—

‘আর কত দূর নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী?

বলো, কোন্ পার ভিড়িবে তোমার সোনার তরী।

তারপর সেই চেনা নাবিককে মধুর হাসিনী বলে সম্বোধন। এখানে একটি ড্যাস (−) চিহ্ন এসেছে যা এসেছে এক রহস্যবোধ নিয়ে। পরের স্তবকে সেই অপরিচিতার আলয় কোথায় তা কবির কাছে জিজ্ঞাসা করিলেন।

ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে দিনের চিতা

করিতেছে জল তরলা অনল,

দোহায় কি আছে আলয় তোমার।

তৃতীয় স্তবকে অপরিচিতা নারীর নাবিকরূপে অবস্থান কেন ? সেই বিষয়ে কবি সংশয় প্রকাশ করেছেন। চতুর্থ স্তবকে কবির সেই সোনার তরীতে অবস্থান। নাবিকের আহ্বান উপেক্ষা না করে তরীতে স্থান নেওয়ার পর কবির প্রশ্ন—

‘আছে কি হোথায় নবীন জীবনে’

পঞ্চম স্তবকে কবির সোনার তরীতে উঠে অসীমের উদ্দেশ্যে যাত্রা। কবির প্রশ্ন— 

‘স্নিগ্ধ হরণ আছে কি হোথায়’

শেষ স্তবকে কবি সেই নারীর অস্তিত্ব অনুভব করছেন কিন্তু তাকে স্পর্শ অনুভব করতে পারছেন না তাই কবির বক্তব্য—

কোথা আছে ওগো, করহ পরশ নিকটে আসি।

কহিবে না কথা, দেখিতে পাব না স্ত্রীর হাসি ৷৷

কবিতার শুরু হয় একটি জিজ্ঞাসা সূচক বাক্য দিয়ে, যা কবির অন্তর্যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করে। জিজ্ঞাসাসূচক বাক্য কবিতায় বহুবার ব্যবহার করা।

  • প্রথম স্তবক : ‘কী আছে হোথায় চলেছি কীসের অন্বেষণে’ 

  • দ্বিতীয় স্তবক : ‘হেথায় কি আছে আনায় তোমার মেঘচুম্বি অন্তগিরির চরণাতলে

  • তৃতীয় স্তবক : ‘তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি হানিছ কেন?’ 

  • চতুর্থ স্তবক : ‘আমার স্বপন ফলে কি হোথায় সোনার থালে 

  • পঞ্চম স্তবক : ‘আছে কি শক্তি আছে কি সুপ্তি তিমির তলে’

ছন্দ অলংকার ও চিত্রকল্পসৃষ্টি কবি আলোচ্য কবিতায় অসাধারণ লিরিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। মধ্যম গায়ের ধ্বনি প্রধান ছন্দের সাহায্যে কবি ছন্দ মাধুর্য দান করেছেন।

অন্যদিকে শব্দলংকারের ধ্বনিঝঙ্কারময় পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থালংকারও সৃষ্টি করেছেন—

  • উপমা    ‘চঞ্চল আলো আশার মতো কাঁপিছে জ্বলে’

  • সমাসোক্তি    ‘জ্বলিতেছে জল করল অনল/ললিয়া পড়িছে অম্বরতল’

  • উৎপ্রেক্ষা    ‘দিকবধূ যেন দল দল আঁখি অশ্ৰুজলে’

আলোচ্য কবিতার অনুপ্রবেশ অলংকারেরও প্রয়োগ লক্ষিত হবার বিশেষ করে অস্তানুপ্রাস। পরপর দুই চরণের অন্তমিল এখানে দ্রষ্টব্য।

চিত্রকল্প কবিতার প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য কবিতায় পাওয়া যায় চিত্র স্পর্শ। যেমন—

হু হু করে বায়ু ফেলিছে সতত দীর্ঘশ্বাস।

অন্ধ আবেগে করে গর্জন জলোচ্ছাস।

সংশয়ময় ঘননীল নীর, 

কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,

অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন।

সোনার তরীতে কবির সংশয় ছিল সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টাও স্থান পাবে কি কালের তরীতে ? নিরুদ্দেশ যাত্রাতে বসে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় তিনি তরীতে ঠাঁই পেয়েছেন। ভাষা ছন্দ-অলংকার, চিত্রকল্প এভাবেই এই বিষয়টিকে উপস্থাপিত করেছে। ধ্বনি ঝঙ্কারময় গীতিকাব্যিক সুরও নাড়া দিয়ে যায় পাঠকের মনে। সর্বোপরি অনুপ্রাস সৃষ্টি উক্ত কাজে সহায়ক হয়েছে।