আমাদের দেশ বহুকাল ছিল পরাধীন। এই পরাধীনতার বিরুদ্ধে এবং বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছেন তাঁরাই দেশপ্রেমিক বলে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এবং যারা পরাধীনতা বা বিদেশি শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহিত্য রচনা করেছেন তাঁরাও দেশপ্রেমিক আখ্যা পেয়েছেন। অতএব এ থেকে বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াইটা হচ্ছে দেশাত্মবোধ বা স্বদেশপ্রেম। কিন্তু এটাই সব পরিচয় নয়, কারণ পরাধীনতা তো শুধু একটি বিষয়েই নয়, মানুষ তার অভিষ্ঠ লাভের পথে এগিয়ে চলতে চায়, কিন্তু পথে কত বাধা। অনেক বাধা তার নিজেরই সৃষ্টি। অনেক শিকল সে অজ্ঞানতাবশত বা অভ্যাসবশত নিজেই নিজের পায়ে পরিয়েছে। ভীরুতার শিকল, অর্থহীন আচারের শিকল, হীনতাভাবের শিকল, এ সবই মানুষকে পরাধীন করে রাখে, একটি দেশের বা একটি জাতির পরাধীনতার এই সামগ্রিক রূপ যাঁর চোেখ ধরা পড়ে, এবং জাতিকে সকল পরাধীনতার শিকল ভেঙে ফেলতে সাহায্য করেন, তিনি বড়ো দেশপ্রেমিক। তার অর্থ হল দেশপ্রেমিক হতে হলে তাঁকে মানবপ্রেমিক হতে হবে আগে। রাষ্ট্রীয় পারধীনতা থেকে মুক্তি দেবার পূর্বধাপ হচ্ছে মানুষের মনকে বহু জাতীয় পরাধীনতা থেকে মুক্তি দেওয়া। এই দুটি কাজ একই সঙ্গে চলতে পারে, দেশপ্রেম মানবপ্রেমের পরিপূরক, দুয়ের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই। কবি নজরুল ইসলাম এই গুণে বিভূষিত।

কবি নজরুল যে সকল দেশাত্মবোধক কবিতা গান রচনা করেছেন তাতে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম দুই-ই পাশাপাশি প্রকাশ পেয়েছে। এইখানেই নজরুলের কবি-মানসের আসল পরিচয়। দেশপ্রেমের নামে উত্তেজনাপূর্ণ গান রচনা করে বিদেশি শাসক শক্তির বিরুদ্ধে মানুষকে সহজে উত্তেজিত করা যায়। মুমূর্বৃ লোকও তাতে ক্ষণকালের জন্য উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সেটি হল সম্পূর্ণ বাইরের জিনিস, সহজ কবিত্ব শক্তি থাকলে যে-কোনো ব্যক্তি হিংসামূলক গান বাঁধতে পারে। তার মধ্যে গভীরতার পরিচয় না থাকলেও চলে, হৃদয়ের পরিচয় না থাকলেও চলে। কবি নজরুল সে পথের পথিক নয়। তাঁর দেশাত্মবোধে বড়ো কবির কাছ থেকে অপেক্ষিত পূর্ণতারই পরিচয় মেলে। কারণ, তিনি যথার্থ কবিধর্মী। যথার্থ কবিধর্মী সেই মনকেই বোঝায়, যার মধ্যে মানুষের প্রতি প্রেমে কোনো ভেজাল নেই। কবি নজরুল এই হিসাবে যথার্থ কবি। তাঁর কাব্যে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা, মানুষের আত্মার অসম্মান জনিত তীব্র ক্ষোভ কবির মনের একটি ভঙ্গিমাত্র। মনুষ্যত্বের উন্মেষ না হলে দেশাত্মবোধ অর্থহীন একথা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন।

কবি নজরুল ভারতীয়। ভারতবর্ষই হল তার দেশজননী। জন্মের পরেই দেখেছেন দেশজননীর মুক্তির জন্য কত শত বিপ্লবীর দল প্রাণ দিয়েছেন প্রাণ দেওয়ার জন্যে আরও কত বিল্পবী দল তৈরি হয়ে আছে। তখন মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে এদেশে শুরু হয়ে গেছে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। কবি গান্ধিজির অহিংসা নীতির প্রতি প্রথম দিকে আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে গান্ধিজির অহিংসা আন্দোলনকে অসার বলে মনে করেন। তাই তিনি এইরূপে শান্তির বাণী আর চরকার সুতা কাটার প্রতি বিশ্বাস রাখলেন না। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় তিনি সরাসরি গান্ধি বিরোধিতা করেছেন—কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও পরোক্ষভাবে যখন তিনি বলেন—

এল কোটি টাকা এল না স্বরাজ!

টাকা দিতে নারে ভুখারী সমাজ।

যার বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি বাঘ খাওহে ঘাস। 

হেরিনুর জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ ৷৷

তখন আর তিনি গান্ধিজির অহিংসা নীতির পথে না বেছে সাম্যবাদের সশস্ত্র বিপ্লবের পথে পা বাড়ালেন। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়েই দেশজননীর মুক্তি আসতে পারে। তাই তিনি সেই সব যুবকদের আহ্বান জানালেন, যারা একদিন চরকায় সুতা কেটে মিথ্যার তাঁত বুনে চলেছিল—

‘জাগোরে জোয়ান! বাত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি।”

কবি নজরুল সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্রে সকল ভারতবাসীকে দীক্ষা দেন। তাদের সকলের কাছে একান্ত কাম্য হবে দেশজননীর মুক্তি। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে আহ্বান করেছেন, তাদের কাছে জাতি ধর্ম বড়ো নয়, বরং জাতপাতের বৈষম্য ভুলে গিয়ে মাতৃমুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাই তিনি ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় বলেছেন—

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানেনা সন্তরণ,

কাণ্ডারী ! আজি দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।

হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন ?

কাণ্ডারী, বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।।”

কবির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আসবে। দেশের প্রতি কবির ভালোবাসা ছিল অগাধ, দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি এমন করে বলতে পেরেছিলেন—

ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর। 

উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।।”

ব্রিটিশের সঙ্গে আপোসের রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। শোষক ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তার প্রবল প্রতিবাদের সুর শোনা যায় ‘শিকল ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত এই স্বদেশি সংগীতটির মধ্য দিয়ে—

“কারার ঐ লৌহ কপাট 

ভেঙে ফেল কররে লোপাট

রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।”

সন্ধ্যা কাব্যের ‘অন্ধ স্বদেশ দেবতা’ কবিতাটিতেও স্বদেশপ্রেমের গভীর পরিচয় বিধৃত। ব্রিটিশ শোষণে জর্জরিত হয়েছে দেশজননী। অথচ এই দেশজননী একদিন বিদেশির নাগপাশ থেকে হবেই কবির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির গান শুনিয়েছেন ওই কবিতায়—

ওরে ওঠ ত্বরা করি

তোদের রক্তে রাঙা উষা আসে, পোহাইছে বিভাবরী।

‘ফরিয়াদ’ কবিতায় কবি পরিষ্কারভাবে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের অমানবিক অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছিলেন—ঈশ্বরের সাম্য নীতি অমান্য করে এরা কালো চামড়ার মানুষদের শোষণ করে চলেছে, তাই ঈশ্বরের কাছে তাঁর অভিযোগ—

সাদা রবে সবাকার টুটি টিপে, এ নহে তব বিধান,

সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান,

ভগবান ভগবান।

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় স্বোচ্চার কণ্ঠে কবি যখন গেয়ে ওঠেন—

বল বীর। 

চির উন্নত মম শির,

শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।

তখন মনে হয় কবি দেশের মানুষকে আত্মবিশ্বাসের মহিমায় জাগিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন, একটা জাতি যখন বহুদিনের পরাধীনতায় নিবীর্য হয়ে পড়েছে, নিজের শক্তিতে শ্রদ্ধা নেই, নিজের স্বাধীন ইচ্ছা নামক কোনো অনুভূতি নেই, তখন তার কানেই তো আত্মবিশ্বাসের মন্ত্র ধ্বনিত করা সবচেয়ে আগে দরকার। একাজ করতে গিয়ে কবি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার যে কত বড়ো পরিচয় দিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের দেশ ও জাতির পরম দুর্ভাগ্য, কবিকণ্ঠ দীর্ঘকাল স্তদ্ধ, ভাষাহীন। যিনি এই দীর্ঘকাল বঙ্গবাসীকে অকৃপণ ‘দানে সম্পন্ন করতে পারতেন, দুর্দিনে দেশ ও জাতিকে কল্যাণের পথের নির্দেশ দিতে পারতেন, তাঁর এই নীরবতা গভীর বেদনাদায়ক সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাই বোধহয় কবি নজরুলের জীবনের দুর্লঙ্ঘ নিয়তি, তবে আমাদের সান্ত্বনা এই যে, নজরুলের সাহিত্য সাধনা দীর্ঘকালব্যাপী না হলেও তাঁর দানের পরিমাণ নিতান্ত অল্প নয়। যদি তাঁর রচনাসম্ভার থেকে নতুন করে মনুষত্বের প্রেরণা ও দেশাত্ম প্রেমের মন্ত্র লাভ করে এবং যুগসংকট হতে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করি, তবেই তিনি চির অমর হয়ে থাকবেন আপামর পাঠক শ্রেণির কাছে।