এই কবিতায় কোন কোন সমালোচকের মতে ভাবের বৈপরীত্য আছে। কবিতার সূচনায় দারিদ্র্য কবির কাছে অসহনীয় নয়। দারিদ্র্য বহু গুণে কবিকে মুগ্ধ করেছে। কবির আবেগ প্রথম স্তবকে ঘন, গভীর ও দৃঢ়সংবদ্ধ। এক মহৎ শিল্পীর মনে হয়েছে খ্রিস্ট মৃত্যুর ও দারিদ্র্যের ভার অতিক্রম করে মানুষের কাছে যে রাজোচিত সম্মান পেয়েছেন কবিও সেই একই গৌরবে গৌরবান্বিত। প্রথমে কবি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জীবনের মুখোমুখি। তিনি দীনহীন নন। কোন হীনমন্যতাবোধে লজ্জিত নন কবি। কিন্তু তারপরেই দারিদ্র্যকে তিনি তাপস বলে সম্বোধন করেছেন। যে দারিদ্র্যের তপস্যা করেছেন বিশ্বের অসংখ্য কবি ও লেখক। কবির কবিসত্তা এই দারিদ্র্যের প্রেরণাতেই ত উদ্বোধিত—

দিয়াছ তাপস 

অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস; 

উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি বাণী ক্ষুরধার, 

বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার

কবির প্রত্যেকটি কথাই সত্য। সারাজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই না করলে তাঁর মধ্য থেকে কী এই নিদারুণ নির্ভীক খরবাক্য বেরোত তাঁর অগ্নিবর্ষী কবিতায়’। নজরুলের কবিসত্তা, শিল্পী সত্তা দারিদ্র্যরূপী নিয়তির সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে কঠোর সংগ্রামে রত। দারিদ্র্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে কবির শিল্পীচেতনা, সৌন্দর্যভাবনা সৃষ্টিশীল আবেগ সবই ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত। সেই রক্তাক্ত সংঘাতের মর্মান্তিক পরিণতি কবিতাটির আর একটি চিত্রকল্পে প্রকাশিত—

দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস 

অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস।

কবির নিখাদ সোনার মত হৃদয়ও বিরস হয়ে যায় দারিদ্র্যের জ্বালায়। প্রথম স্তবকের কবির দারিদ্র্যকে সম্মান জানিয়ে যে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন পরবর্তী স্তবকগুলিতে দারিদ্র্যকে জীবনের রণসংহারক বলেই কবি গ্রহণ করেছেন। এতে ভাবের বৈষম্য বা রসাভাস হয় নি কারণ দর্পী দারিদ্র্যরূপী তাপস না থাকলে কবির বাণী কি এত সহজে পাঠকের মন স্পর্শ করত, এ প্রসঙ্গে মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন “এযুগে পৃথিবী জুড়িয়া অন্নাভাবের হাহাকার উঠিয়াছে—মনুষ্য সমাজে কু-বিধি প্রবল হওয়ায়, বঞ্ছিত বুভুক্ষুর দলই সর্বত্র বৃদ্ধি পাইয়াছে। মানুষের এই দুর্বল দারিদ্র্য—পীড়িত অবস্থাকেই কবি একরূপ বিষজালার উদ্দীপনরূপে—এক মহাশক্তিরূপে বন্দনা করিয়াছেন।

দারিদ্র্য মানুষকে যেমন খ্রিস্টের সম্মান দেয় তেমনি তা মানুষের গলায় ফাঁসিও পরায়। দারিদ্র্যকে কবি ক্ষমাহীন দুর্বাসা ঋষির সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবিতাটির অধিকাংশ জায়গা জুড়ে প্রকাশ পেয়েছে দারিদ্র্যের তাণ্ডবতা, কঠোরতা এবং তার ধ্বংসকারী রূপ। দারিদ্র্যের কঠোরতা অশ্রুসজল হয়েছে কবিতার শেষাংশে। পুত্রকন্যার দারিদ্র্য—পীড়িত ক্ষুধাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকালে বেদনার আঘাতে হৃদয় আর্তনাদ করে ওঠে। কবিতা শেষ হ’লেও কানের কাছে বাজতে থাকে সানাইয়ের শূন্য ক্রন্দন বেদনা রাগিণী। ভাবের অসংলগ্নতা চিন্তার দুঃসহ ভাব কবিতাটিকে মহৎ কবিতা হতে দেয়নি এটাও সত্য কিন্তু ভাববৈষম্য ঘটেছে এ বক্তব্য যথাযথ নয়। দারিদ্র্যের নানা ছবি আছে তার সঙ্গে জীবনের আনন্দকে মেলানোর একটা প্রচেষ্টা করিব, মধ্যে ক্রিয়াশীল। জীবনাভিজ্ঞতার বৈপরীত্যে দারিদ্র্যের রূঢ় নির্মম যন্ত্রণাময় বাস্তব রূপটিই প্রকটিত। কিন্তু কবিতার মধ্যে রোমান্টিক কবিমানসিকতাও লক্ষণীয়।

বেদনা হলুদবৃত্ত কামনা আমার 

শেফালির মতো শুভ্র সুরভি বিথার

বিকশি উঠিতে চাহে।’

এই কবিতা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার লিখেছেন : ‘এ যুগে পৃথিবী জুড়িয়া অন্নাভাবের হাহাকার উঠিয়াছে—মনুষ্যসমাজে কুবিধি প্রবল হওয়ায়, বঞ্চিত বুভুক্ষুর দলই সর্বত্র বৃদ্ধি পাইয়াছে। মানুষের সেই দুর্বল দারিদ্র্য-পীড়িত অবস্থাকেই কবি একরূপ বিষজালার উদ্দীপনারূপে—এক মহাশক্তিরূপে বন্দনা করিয়াছেন। একথা অনিবার্যভাবে সত্য দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে সুন্দরের সাধনায় অভিপ্রায় ব্যর্থ হয়েছে।

শরতে যখন পৃথিবী স্বর্ণোজ্জ্বল। বধূরা প্রবাসী স্বামীর পথ চেয়ে অপেক্ষা করে। যখনই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শরৎঋতুর সৌন্দর্য দেখে বলা যায় ‘একী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণেশ হে’। নারীরা ব্যাকুল হ’য়ে প্রোষিত ভর্তৃকার মতো অপেক্ষা করে। শরতের সানাই কবির মনে আনন্দের হিল্লোল জাগাতে পারছে না কারণ কবি সর্বহারা ও দরিদ্র। তাই শরতের শেফালী ফুলকে কবির মনে হয়েছে বিধবার হাসির মতো। চতুর্দিকে চঞ্চল পাখার প্রজাপতি ও ভ্রমর ঘুরে বেড়াচ্ছে। জীবনের এই রূপ বা ঐশ্বর্য সব মানুষই ভোগ করতে চায়। কবিরও ইচ্ছা করে। তাঁর কনিষ্ঠা মেয়ে আদরের দুলালী তাঁকে যে উপহার দিতে চাইছেন তা কবি পূর্ণভাবে ভোগ করতে চান। কিন্তু বোগের কোন উপায় নেই, সীমাহীন দারিদ্র্যে কবির শিল্পী সত্তা ও কবিসত্তা ব্যাহত হয়। দারিদ্র্য যেন তাঁর পুত্র ও জায়ারূপে প্রতিদিন তাঁর গৃহে ক্রন্দনরত। দেবী দুর্গার আগমনীর সুরে যে আনন্দের বিস্তার দেশের সমস্ত দিকে নির্মম দারিদ্র্য কবিকে সব সুখ থেকে বঞ্চিত করেছে।

যে পরিপ্রেক্ষিতে কবি দারিদ্র্য কবিতাটি লিখেছেন তাতে দারিদ্র্যের বাস্তবজ্বালা ফুটেছে। পৃথিবীর অনেক কবি ও সাহিত্যিকই এই দারিদ্র্যে জর্জরিত। দন্তয়েভস্কি আজীবন দারিদ্র্য পীড়িত। তাই তাঁর নায়ক বলেছে : ‘I am a sick man I am a malicions man’ | নাট্যকার ইবসেনের জীবনেও ছিল কঠোর দারিদ্র্য। যে ইবসেনের বিখ্যাত নাটক ‘ডলস হাউস্’ বা ‘অ্যান এনিমি অফ দি পিউপল’—তিনিও দারিদ্র্যের জ্বালায় বলতে একদিন বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর ‘হতাশ’ কবিতায় ‘নাম গোত্রহীন জনতার স্রোেত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ; তাদের একজন হয়ে আমি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাব।”

দন্তয়েস্কি ও ইবসেন দুজনেই কালজয়ী সাহিত্যিক তবু দারিদ্র্যের যাতনায় এমন সব মন্তব্য করেছেন যা আমাদের কাছে খাপছাড়া বা অসংলগ্ন মনে হয়। নজরুলও অগ্নিবীণা, সর্বহারা, বিষের বাঁশীর মতো কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন—অসংখ্য গান রচনা করেছেন। শিল্পী হিসেবে তিনি সার্থক। বাংলাকবিতাকে তিনি প্রথম পার্সী আরবী ভাষায় সমৃদ্ধ করে কবিতাকে বহুমাত্রিকতা দিয়েছেন সেজন্য তার শাণিত ক্ষুরধার বাণীকে ত তরবারিই বলা যায় যে লেখনীরূপ তরবারির সাহায্যে তিনি সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন। এ শক্তি কবি পেতেন না যদি না জীবনে দারিদ্র্যকে ভোগ করতে হত। বিশ্বের অনেক কবিই কোন না কোন সময় দারিদ্র্যের তাড়নায় সমস্ত দুঃখকে নীলকণ্ঠের মত গ্রহণ করেছেন। তাই প্রথমে কবি দারিদ্র্যকে সম্মান জানালেও পরে যে কবি দারিদ্র্যর নিষ্ঠুর রূপে মর্মাহত এতে কোন সন্দেহ নেই। দারিদ্র্যর বিষজ্বালায় সমস্ত প্রতিভা নিঃশেষিত হয়। আনন্দ ও সৌন্দর্যকে ‘বিরস’ বলে বোধ হয়। তবু এরই মধ্যে নজরুল যে সব কাব্যগ্রন্থ ও উপন্যাস লিখেছেন তা ব্যতিক্রমী ধারার পথপ্রদর্শক। জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য, স্বচ্ছলতা থাকলে তবেই ত কবির কাব্যবীণা ঝংকৃত হয়। সেদিক দিয়ে নজরুল দারিদ্র্যর যে জ্বালাময় বর্ণনা দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে অভিনব। দারিদ্র্য যে মানুষের জীবনরস শুকিয়ে দেয় এ নির্মম সত্যই কবিতার দ্বিতীয় স্তবক থেকে শেষ স্তবকে বর্ণিত। তাই প্রথমে দারিদ্র্যকে শিরোভূষণ করে মেনে নিয়েও দারিদ্র্যের যে ভয়ঙ্কর জ্বালা এ কবিতায় বর্ণিত তা সত্য ও বাস্তব। তাই কবিতাটির ভাবগত অসংগতি অতি সামান্য মূল সুরটি কবিতায় অকৃত্রিম।