গীতিকবিতা কবিতার একটি প্রকারভেদ। গীতিকবিতার মধ্যে মিতপরিসরে ভাবের সংহত প্রকাশ পরিস্ফুট হয়। কবির গাঢ় গভীর অনুভূতির আকৃতি গীতিকবিতায় পরিস্ফুট হয় বলে গীতিকবিতা সংহত ও গভীর হয়। গীতিকবিতাকে বলা হয় মঙ্গল কবিতা—কারণ কবির আত্মভাবপ্রাধান্য গীতিকবিতায় পরিস্ফুট হয়। গীতিকবিতায় Subjective লক্ষণ প্রকাশিত হয় বলে কবির ব্যক্তিসত্তার পরিচয় গীতিকবিতায় ধরা পড়ে। Ernest Rhys গীতিকবিতার সংজ্ঞা আলোচনা করতে গিয়ে কবির অনুভূতির তীব্রতার কথা প্রকাশ করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায় কবিমানসের অনুভূতির তীব্রতা গীতিকবিতার প্রাণ। গীতিকবিতার মধ্যে মন্ময়-লক্ষণ প্রধান বলেই এই শ্রেণির কবিতার সুতীব্র রসানুভূতির উজ্জ্বল সংহত প্রকাশ দেখা যায়। গীতিকবিতায় কবির স্বকীয় অনুভূতির প্রকাশ বলেই গীতিকবিতার আস্বাদ স্বতন্ত্র।

‘গানের আড়াল’ নজরুল ইসলামের একটি বিশিষ্ট গীতিকবিতা। গীতিকবিতার সংহত আবেগ এই কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। গীতিকবিতার সংহতি হীরক-কাঠিন্যের মতো রসিক পাঠকের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়। ‘গানের আড়াল’ কবিতাটির ভাবনির্ভরতা উল্লেখযোগ্য। কবির গান তাঁর বন্ধু উপলব্ধি করতে পারেননি এই দুঃখবোধ থেকেই কবিতাটি রচিত। কবিতাটির মূল ভাবকেন্দ্র এই বিষয়টি : কবির গান তার বাণী দিয়ে বন্ধুকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু বন্ধুর হৃদয়কে স্পর্শ করেনি। সংগীতের মধ্যে আছে কথা ও সুর। কবির গানের সুরের স্পর্শ তার বন্ধুর শ্রবণে দুলের মতো দোলায়িত। কিন্তু তার হৃদয়ে এই সুরের স্পর্শ লাগেনি। গানের আড়ালে যে হৃদয়, সৃষ্টির অন্তরালে যে বেদনা, যে যন্ত্রণা আছে, তার বন্ধু এই আবেদনকে বুঝতে পারেননি। গায়ক যখন গান গায়, তখন গানের আড়ালের ব্যঞ্জনাই শ্রোতাকে আকর্ষণ করে। কিন্তু স্রোতা যদি গানের বহিরঙ্গ আবেদনকে শুধু দেখে, গানের অন্তরঙ্গ আবেদনকে গ্রহণ করতে না পারে, তাহলে কবির দুঃখানুভূতি হবে অসীম। এই বেদনাই কবিতার ভাবকেন্দ্র। আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে কবি এই বেদনাকে প্রকাশ করেছেন। কবির ভাষায়—

হায়, ভেবে নাহি নাই-

যে চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই। 

‘সাগরের সেই ফুলে ফুলে কাঁদা কূলে কূলে নিশিদিন? 

সুরের আড়ালে মূৰ্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ্?

এখানে কবি উপমেয় ও উপমান ব্যবহার করে কবিতার ভাববস্তুকে প্রকাশ করেছেন। প্রকৃতি জগৎ থেকে কবি উপমেয় গ্রহণ করেছেন এবং সেই উপমেয়র সঙ্গে সাদৃশ্যবাচক প্রয়োগ করে রূপকের ব্যবহার করেছেন। তাঁর মূল কথাটি হল’সুরের আড়ালে মূৰ্চ্ছনা কাঁদে শোনে নাই তাহা বীণ’। অর্থাৎ সুরের আড়ালে যে ভাবব্যঞ্জনা, কবিপ্রাণের যে আকুতি তাকে কবির বন্ধু বুঝতে পারেনি। কবির অস্তরকে বুঝতে পারেনি তাঁর প্রেয়সী—এইখানেই কবির দুঃখ, কবির খেদ। তাই শেষ দুই স্তবকে কবির সুরে লেগেছে বেদনার গীতিসুর।

বন্ধু গো যেয়ো ভুলে’-

প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধ্যায় রেখো না সে ফুল তুলে’।

উপবনে তব ফোটে যে গোলাপ–প্রভাতেই তুমি জাগি’

জানি, তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি’।

কবির গানকে যেন তাঁর বন্ধু ভুলে যান। এই নিবেদনের মধ্যে আছে কবির অভিমান। এই অভিমান কবিহৃদয়ের এক গভীর অনুভূতি থেকে উৎসারিত হয়েছে। হৃদয়ের যে গভীর আবেগকে কবি ‘জোয়ার’ বলেছেন সে আবেগই কবির কবিতার মূল ভাববস্তু। গীতিকবিতায় এই আবেগেই কবিতার প্রাণ। ‘গানের আড়াল’–কবিতায় কবিমনের যে মন্ময় চেতনা পরিস্ফুট হয়েছে তা কবিমানসের বিশেষ ব্যক্তিত্বের ফসল। এই মন্ময় চেতনার লক্ষণ দেখা যায় শেষ স্তবকে—

‘ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়, 

আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়!

জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি-

কণ্ঠ পরায়ে হ’য়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি !”

“আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ নয়” – এই চরণের মধ্যে কবির হৃদয়াবেগের প্রত্যক্ষ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কবিমনের স্বকীয় অনুভূতি এর মধ্যে পরিস্ফুট হয়েছে বলেই এই অংশটি গীতিধর্মী। কবির প্রার্থনা শুধু তাঁর প্রেয়সীর হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা। এই সামান্য প্রার্থনাটুকুও কবির হৃদয়ানুভূতিতে উজ্জ্বল। গীতিকবিতার আবেগপ্রাধান্য স্বকীয় হৃদয়ানুভূতিতে উজ্জ্বল হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে বলে নজরুল ইসলামের ‘গানের আড়াল’–একটি সার্থক গীতিধর্মী সৃষ্টি।