“বুড়িগঙ্গার উপর নোঙর ফেলা একটি স্টিমলঞ্চে উপরের ডেক-এ ইজিচেয়ারে বসে আছেন তিনি, ঠিক তাঁর ফটোগ্রাফগুলোর মতোই জোব্বা পাজামা পরনে,—আরও কেউ কেউ উপস্থিত ও সঞ্চরমান, রেলিঙে হেলান দিয়ে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মুখ চেনা একটি ব্রাষ্ম যুবক আমার কাছে এসে বললেন, আপনাকে ইনটোডিউস করিয়ে দেবো? আমি আস্তে বলে উঠলাম, ‘না, না, সে কী কথা।”

১৯২৬ এ রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দর্শনের ছবিটি এভাবেই এঁকেছেন বুদ্ধদেব বসু। সে দেখায় রয়েছে দ্বিধা, সংকোচ,—অপরিচয়ের কুণ্ঠাও। পরবর্তীতে অবশ্য ‘কবিতা পত্রিকার সম্পাদনা সূত্রে রবীন্দ্রসান্নিধ্যে আপ্লুত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। অস্তরবির আলোয় স্নিগ্ধ হয়েছে তাঁর অন্তর, আনত প্রণামে বারবার স্মরণ করেছেন পূর্বসূরীকে। ব্যক্তি জীবেন, এমনকি দেশ ও সমাজ জীবনের দারুণ দুর্দিনেও একালের কবির মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের কথা, মনে হয়েছে মানুষের সভ্যতার এই ভাঙচুরের সময় একমাত্র রবীন্দ্রনাথই পারেন আলোকের ঝর্ণাধারায় সমস্ত ক্লেদ, সমস্ত মালিনাকে ধুয়ে ফেলতে,–

‘তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে 

হে বন্ধু, হে প্রিয়তম।’

–আপাতভাবে একটা ধারণা অবশ্য বুদ্ধদেবের সম্পর্কে আছে, তাহল—তিনি উদাসীন, সমাজ সম্পর্কে কিংবা তার পরিবর্তন সম্পর্কে অনাগ্রহী—… ইত্যাদি। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই সুতপা ভট্টাচার্য তাঁর ‘কবির চোখে কবি’তে (১৯৮৭) লেখেন,—“সামগ্রিকভাবে বুদ্ধদেবের কবিতায় লভ্য শুধু শেলির স্কাইলার্ক—আধ্যাত্মিক জাতীয়, উদাসীন, গৃহত্যাগ নিরাকারের অভিমুখী।”—’আধ্যাত্মিক জাতীয়’, ‘উদাসীন’, ‘গৃহত্যাগ নিরাকারের অভিমুখী’ এই শব্দগুলো একসময় ব্যবহৃত হতো রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। রবীন্দ্র পরবর্তীকালের বুদ্ধদেবের রচনা প্রসঙ্গে কিন্তু এ অভিযোগ মানতে পারিনা আমরা। বুদ্ধদেব বসু অবশ্যই নজরুল ইসলাম বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় নন, মিটিংয়ে মিছিলে তিনি গলা মেলাননি কোনো দিন ও, কিন্তু শুধুমাত্র এ কারণেই তিনি সমাজ বিবিত্ত, এ অভিযোগ ও বড়ই একপেশে। কবির কাজ একটি ভালো কবিতা লেখা—এমন কথা ঘোষণা করেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁকেই বলতে হয়েছে,— “স্বাস্থ্য যখন নষ্ট হয়, অশান্তি জেগে ওঠে, দুর্যোগ আসে ঘনিয়ে, তখনই সমগ্র মানব জাতির মন রাজনীতি গ্রাস করে নেয়, কারণ তখন প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনে পড়ে আশঙ্কার ছায়া। আজকের দিনে পৃথিবীর সমস্ত দেশে এমন একটি দারুণ দুঃসময় উপস্থিত, সমাজের অন্তলীন দ্বারে আজ বীভৎসরূপে প্রকট।” (সব পেয়েছির দেশে, আগস্ট ১৯৪১)—স্পষ্টতঃই বোঝা যায়, ঠিক কি কারণে বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকতে পারেননি বুদ্ধদেব, নিশ্চিত ভাবে চান-ও নি। বরং সেই উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বাভাবিক মানুষের মতোই উদ্বিগ্ন হয়েছেন তিনি।

বুদ্ধদেবের সমাজ-সচেতনা নিয়ে আলোচনার আগে অবশ্য আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত যে, সমাজের সেই সময়ের অন্তর্লীন স্বাদটি ঠিক কি ছিল? আগস্ট ১৯৪১ এ একথা বলেছেন বুদ্ধদেব—ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীর ইতিহাসেও প্রলয়কালের সঙ্কেত। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে তা এরকম,—প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে ভার্সাই চুক্তির শর্তগুলি জার্মানি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। মিত্রশক্তি যুদ্ধে জিতলেও অর্থনৈতিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা। যুদ্ধ শেষের সেই সাময়িক শান্তি বস্তুত ছিল খুবই অগ্নিগর্ভ এবং ওই সময় থেকেই যেন সূচিত হয়ে গিয়েছিল পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি ভাঙন ধরা ইউরোপের রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলি যে যেভাবে পারে শক্তি সঞ্চয় করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধে চলাকালীন-ই রাশিয়ায় জারতন্ত্রের পতন ঘটে। ১৯১৭ সালে ক্ষমতায় আসে বলশেভিক দল। রাশিয়ার আভ্যন্তরে উৎপীড়নের অবসান ঘটলেও সমাজতন্ত্রবাদী শক্তির আভ্যুত্থানে ইউরোপ ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি সচেতন হয়ে ওঠে, রাশিয়ায় নতুন নেতৃবৃন্দের মধ্যেও দেখা দেয় নীতি ও ক্ষমতার লড়াই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্ন থেকেই ইতালিতে শোনা হতে লাগলো ফ্যাসিবাদের গর্জন। ১৯২৯-এ বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার কালগ্রাস। তারপর হিটালারের ক্ষমতা অধিগ্রহণ,–১৯৩৩-এ। শুরু হল চিন-জাপান যুদ্ধ। ভারতেও ব্রিটিশ শাসনের শেষ লগ্নে শসস্ত্র বিপ্লবে—অহিংস সংগ্রামে ইংরেজদের অন্তহীন অত্যাচারে দেশবাসী আতঙ্কিত। ঠিক এই অবস্থায়, গাণিতিক নিয়মের মতোই যেন ঘোষিত হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আকাশ থেকে আগুনের গোলার মতো খসে পড়তে লাগলো মৃত্যু-পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

১৯৪২-এ এ কবিতা যখন লিখছেন বুদ্ধদেব, তার কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন রবীন্দ্র। ইউরোপের যুদ্ধ চলছে তখনও, প্রাচ্যেও শুরু হয়েছে জাপানের আগ্রাসন ভারতবর্ষ আলোড়িত ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনে। বস্তুত ভারত তথা বিশ্বের জনজীবন তখন প্রায় বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই আলোড়িত হয়েছেন কবি বুদ্ধদেব-ও। ‘কবিতা ভবন’ থেকে তখন প্রকাশিত বুদ্ধদেব ‘এক পয়সায় একটি সিরিজের কয়েকটি পুস্তিকা। এই সিরিজের পঞ্চম পুস্তিকা বুদ্ধদেব বসু’র ২২ শ্রাবণ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। ২২ শ্রবণ’-এ ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ নামের চারটি কবিতা জায়গা পেয়েছিল,—

১। তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে, ২। প্রাণে মোর আনো তব বাণী

৩। একে একে খসে পড়ে তারুণের মোহের শৃঙ্খল। 

৪। যায় না এমন দিন, যেদিন তোমারে আমি করি না স্মরণ।

এর মধ্যে প্রথম কবিতাটি ‘তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে’– বুদ্ধদেব বসু’র শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় স্থান পেয়েছে। কবিতাটি সংক্ষিপ্ত, মাত্র চোদ্দ লাইনে শেষ। কিন্তু সনেটের মতো চোেদ্দ অক্ষরের নয়, এ কবিতা আসলে ৮/১০ মাত্রার মহাপয়ার। আমরা জানি ভাষাকে পূর্ণায়ত রূপ দিতে অনেক সময়ই সনেটের চোদ্দ অক্ষরের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে বুদ্ধদেব, এ কবিতাটিও তেমনই। আট ও ছয় পঙ্ক্তির দুটি স্তবকে দুটি স্তবকে সনেটীয় কাব্যগঠন-এ রক্ষিত। মিল বিন্যাস যথাক্রমে ক খ খ ক, গ ঘ ঘ গ, ঙ চ ছ ঙ ছছ। শেষ দুই পক্তিতে ‘ছ ছ’ এই মিত্রাক্ষর যুগ্মকটি দেখে মনে হয়, এই বুঝি নিখুঁত শেক্সপীরীয় সনেট। কিন্তু নিবিড় পাঠে বোঝা যায় শেষ দুই পঙ্ক্তির ভাব আসলে অনেক দূর ছাড়িয়ে, বস্তুত, তা সমগ্র তা সমগ্র কবিতার দেহকেই ঘিরে রয়েছে। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, বিদেশি সনেটের শিল্পরূপ যথাযথ ভাবে রক্ষিত হয়নি এ কবিতায়। কিন্তু কি এসে যায় তাতে ? ভাবের গাম্ভীর্য ও সৌকর্য—দুই-ই হাজির, রয়েছে সনেটকল্প কবিতায় গাঢ়তাও। কবি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন সভ্যতার এক দারুণ দুর্দিনে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই অর্ধেক অংশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে সেই দুর্দিনের বর্ণনা—

“তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে

হে বস্তু, হে প্রিয়তম,’

—‘বন্ধু’ বা ‘প্রিয়তমের নামের উল্লেখ নেই, তবু কবিতাটির নামসূত্রে আমরা চিনে নিতে পারি এই বন্ধু বা প্রিয়তমটিকে? যাকে সভ্যতার এই দারুণ দুর্দিনে স্মরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে কবির?

কবিতা পাঠ এগিয়ে চলে, সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয় সভ্যতার দুর্দিনে নানা মাত্রা— ৫ রকম ভাবে।

এই দারুণ দুর্দিন-এর আভিঘাত আছড়ে পড়েছে তিনটি ক্ষেত্রে। (১) সভ্যতা (২) মানুষের জীবন ও (৩) প্রাণে সভ্যতার দুর্দিনে তাই মানুষের সভ্যতা মৃত্যুশয্যায় শায়িত ৷ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার বিনাশের বীজ। ‘মর্ম’ বা মন, মজ্জা হাড়, এখানে শরীর, অর্থাৎ মানুষের সভ্যতা শরীর ও মন সবদিক থেকেই ধ্বংসের মুখোমুখি। তার শরীরে বিনাশ, মনে হতাশা–বেঁচে থাকার ক্লান্তি।

সভ্যতার দুর্দিনে ধ্বংসের মুখোমুখি মানব সমাজ-ও। মহামারীর সংক্রমণ যেন শুষে নিয়েছে জীবনের রস। তাই সভ্যতা ধুঁকছে, আর রোগের বীজানু কুরে কুরে খাচ্ছে মানুষকে। এই অবস্থায় মানুষের সভ্যতার প্রাণ প্রতিমা, তার বেঁচে থাকার রসদ–‘প্রাণলক্ষ্মী’ নির্বাসিতা।

আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করবো ‘প্রাণলক্ষ্মী’ ও ‘নির্বাসিতা’ শব্দ দুটিকে। প্রাণ অর্থাৎ বেঁচে থাকা। লক্ষ্মী সম্পদের দেবী। বেঁচে থাকার চেয়ে বড়ো সম্পদ, বড়ো সৌভাগ্য মানুষের জীবনে আর কিছু নেই। তাই প্রাণের লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান। আর নির্বাসিত অর্থ পরিত্যাগ, ছেড়ে চলে যাওয়া। আমরা দেখেছি প্রাণলক্ষ্মী নির্বাসিতা। প্রাণলক্ষ্মী পরিত্যক্ত। কিন্তু মৃত নন। মৃত্যুতে সব শেষ—কিন্তু নির্বাসনে আছে ফিরে পাওয়ার আশা। এখন যে ধ্বংসের মহামারী ছেয়ে ফেলেছে সমগ্র মানব সমাজকে তার ফল হিসেবেই প্রাণলক্ষ্মীর নির্বাসন। আমরা আশা করতে পারি, নির্বাসন শেষে আবার ফিরে আসবেন প্রাণের দেবী, ফলত সম্পদে মাধুর্যে, বিশ্বাসে—আহার রূপে, রঙে ভ’রে উঠবে সভ্যতা—মানুষের সমাজ । পরবর্তী সাড়ে চার লাইনে সভ্যতার দুর্দিনের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন কবি। পৃথিবীর ইতিহাসে রণোম্মত্ত জাতিগুলির পারস্পরিক লড়াই, অধিকার বোধের হিংস্রতাই এই দুর্দিনের কারণ। তাই রক্ত পায়ীদের উদ্ধত সঙিনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জীবনের সৌন্দর্য—সমস্ত শুভবোধ, কল্যাণী ধারণার উপর ছড়িয়ে পড়ে নরকের রক্তধারা।

রামায়ণের কাহিনিতে পুষ্পক রথের কথা আমরা জেনেছি। প্রকাশ পথে ভাসমান একটি ফুলে সাজানা রথ—যাতে করেই অপহরণ করা হয়েছিল সীতাকে। পৌরাণিক সেই পুষ্পর যেন ফিরে এসেছে নতুন সাজে। পক্ষীমানব নয়—পক্ষীদানব হিসেবে। আর তার পেট থেকে আগুনের গোলার মতো নেমে আসছে মৃত্যু, নিমেষে ছাই হয়ে যাচ্ছে কত শহর, নগর, জনপদ। লক্ষ্য তাদের সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা। আর তুলনামূলক ভাবে কম শক্তিশালী জাতিরা অস্তিত্বের সঙ্কটে দীর্ণ, কাঁপছে থরতর। ঠিক যেমন করে উন্মত্ত জন্তুর মুখে কেঁপে ওঠে সোনার হরিণ।

এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়, শৈলীগত ভাবে উন্মত্ত জন্তুর হাতে হরিণের মৃত্যু, কিংবা বর্বর রাক্ষসের প্রাণহরণের ঘটনাকে কিন্তু সরাসরি উল্লেখ করেননি কবি। কারণ মৃত্যু বা বিনাশ নয়, এ কবিতায় কবি স্বপ্ন দেখেছেন প্রাণের জাগরণের। প্রাণলক্ষ্মী আবার ফিরে আসবেন জীবনের ক্ষেত্রে, মানুষের মর্ম ও মজ্জা পুষ্ট হবে জীবনের রস পেয়ে,—তাই মৃত্যুর ছবিকে স্পষ্টত ব্যবহার করতে চাননি তিনি। বরং মনে হয়, এই দুটি কাজ যেন থেমে আছে। কেননা, বর্বর রাক্ষস ও উন্মত্ত জন্তুর পরাজয় আবশ্যম্ভাবী। কবির মনে আছে রবীন্দ্রনাথের আক্ষয়বাণী—যার উচ্চারণে বিপন্মুক্তি সম্ভব।

কবিতাটির প্রথম স্তবকে রয়েছে সভ্যতার নরকবর্ণনা—আর পরবর্তী অংশে সেই ‘নরক’ থেকে পরিত্রাণের ইঙ্গিত। শুরুতেই ‘প্রাণ রুধ, গান স্তষ্ক’। প্রাণের যে দরজা দিয়ে ঢোকে জীবনের আলো, সেটাই যেন রুদ্ধ, বন্ধ। লক্ষণীয়, এখানে ‘রুদ্ধ’ শব্দের মধ্যে রয়েছে সেই আশার ব্যঞ্জনা। প্রাণ ধ্বংস হয়ে যায়নি। বরং, আনাল সরে গেলেই আবার জীবনের দ্যুতিতে ঝলমল করে উঠবে মানব সমাজ।

একইভাবে আমরা লক্ষ্য করি ‘স্তব্ধ’ শব্দটিকে। সুর থেমে গেছে, কিন্তু তা আবার বেজে ওঠার সম্ভাবনা আছে প্রতি মুহূর্তে। ঘটকের প্রথম লাইনে ভারতে, ব্যক্তিগত পরিসরে সরে এসেছেন কবি। ‘ভারতের স্নিগ্ধ উপকূলে লুদ্ধতার লালা করে। উপকূলের সঙ্গে কোথায় যেন যোগ থেকে গেছে ব্রিটিশদের। উপকূলের পথ ধরেই তারা ভারতে এসেছিল। শান্ত ভারতীয় উপদ্বীপে দ্রুত ক্ষমতা বিস্তার করেছিল তারা। তারপরের দুশো বছর শুধুই রক্তাক্ত এক ইতিহাস। নির্বিচারে ভারতের সম্পদ তারা রপ্তানি করেছে বিদেশে। আরও বেশি লাভের আশায় লোলুপ হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র ‘উপকূল’ এই শব্দটিকে ব্যবহার করেই সেই লালসা, সেই ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতাকে পাঠকের সামনে স্পষ্ট করে তুলছেন কবি।

সব মিলিয়ে মানব সভ্যতা ক্রমশ ধ্বংসের অভিমুখী। স্বাভাবিক ভাবেই কবিও। তবু তাঁর মননে এ সময়েও উজ্জ্বল উপস্থিতি রবীন্দ্রনাথের। তাঁর অক্ষয় মন্ত্রই কবিকে এই। এই বিপদেও শক্ত থাকার শক্তি দেয়, ধ্বংসের বাতাবরণের মধ্যেও শোনায় মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের কথা।

সভ্যতার নরকে রবীন্দ্রনাথের অক্ষয়-মন্ত্রের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন কবি। তবে সরাসরি সে বাণীর উল্লেখ নেই কবিতায় কোথাও। তাহলেও আমরা বুঝতে পারি সে অক্ষয় মন্ত্রের কথা,—–কারণ, আমাদের সকলেরই যে মননে, অস্তিত্বে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ,—তাঁর অক্ষয়মন্ত্রের মতো।

১। বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা বিপদে আমি না যেন করি ভয়।

২। নাই, নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার— জানি জানি তোর বন্ধন ডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার।

৩। আমি ভয় করবো না ভয়, করবো না দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না। 

৪। বুঝি বা এই বজ্ররবে নতুন পথের বার্তা কবে—

কোন পুরীতে গিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি।

এই অংশে চোখে পড়ে দুটি শব্দ, ‘লিপ্ত’ আর ‘বিদ্ধ’ লিপ্ত শব্দের অর্থ লেপন— পুরোপুরি মিশে যাওয়া। রবীন্দ্রবাণী যেন কবির রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে, আলাদা করে আর কোনো অস্তিত্বকে অনুভব করেননা তিনি। অন্যদিকে ‘বিদ্ধ’ শব্দে সচকিত হয় আনন্দের অন্তর। ধারালো অস্ত্র যেমন মাংসের গভীরে করে, তেমনই রবীন্দ্রনাথের অক্ষয়বাণীও যেন কবির হৃদপিণ্ড ভেদ করে ঢুকে গেছে সত্তার গভীরে,—ফলত হৃদয়ের এক অন্তর্লীন গভীরতায় তার উপস্থিতি ছারিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ যেন বিলীন হয়ে যান কবি বুদ্ধদেবের অস্তিত্বের সঙ্গে।

কবিতাটির অষ্টক অংশে রবীন্দ্রনাথকে হে বন্ধু, ‘হে প্রিয়তম’ বলে সম্বোধন করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। যদিও শৈলীগত ভাবে সে উল্লেখের তাৎপর্য অনুল্লেখিত-ই থেকে গেছে। ষট্‌কে আবার তাঁকে ‘বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছেন কবি। সভ্যতার শ্মশান—শয্যাতেও তাঁর সাহচর্যে প্রদীপ্ত হয়েছে কবির অস্তর। এবার কিন্তু আমরা বুঝে নিতে পারি ‘বন্ধু’ শব্দটির তাৎপর্য। ‘রাজদ্বারে শ্মশানে চাষ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ। এক্ষেত্রে সভ্যতার শ্মশান কবির সঙ্গে আছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই অবশ্যই তিনি বান্ধব।

প্রসঙ্গত ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতাটির শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। কবির সহজাত আকর্ষণ গৃহীত শব্দ, সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের প্রতি। কারণ, তাঁর মতে সংস্কৃত শব্দ বেশি ব্যবহার করলে রচনার দৃঢ়তা ও সংহতি আসে।‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ চতুর্দশপদী কবিতা। স্বাভাবিকভাবেই এর গঠনও ভাস্কর্যধর্মী, আঁটোসাঁটো, এ ধরণের কবিতার গাম্ভীর্যের সঙ্গে তৎসম শব্দের দাড়া খুব সহজেই খাপ খেয়ে যায়। তাই বিষয়ানুরোধেই এ কবিতায় বুদ্ধদেব ব্যবহার করেছেন বেশ কিছু তৎসম বা সংস্কৃত ঘেঁষা, শব্দ,– উড্ডীন, সংক্রামিত, লড়েছি ইত্যাদি। কোনো কোনো শব্দে রয়েছে গূঢ় অর্থ ব্যঞ্জনাও। লিপ্ত বিদ্ধ শব্দ দুটির প্রসঙ্গে সে আলোচনা আগেই করেছি আমরা।

বুদ্ধদেব বসু’র ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতার–আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে। দুটি কবিতাই রবীন্দ্রবাণীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রায় একই যুদ্ধ ও হিংসার পরিমণ্ডলে রচিত। তবু, পার্থক্যও আছে। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতেও বুদ্ধদেব বিশ্বাস, জীবনের জয় হবেই,—বর্বর রাক্ষসের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এ প্রত্যয় রবীন্দ্রবাণী রূপে তার মর্মমূলে সঞ্চারিত। তবে, সে ‘বাণী’র প্রত্যক্ষ উচ্চারণ নেই কোথাও। অন্যদিকে, সংগ্রামী কবি সুকান্ত রবীন্দ্রবাণী উচ্চারণেই অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা জানান । রবীন্দ্রনাথ একদিন ডাক দিয়েছিলেন, ‘দানবের সাথে সংগ্রামের তরে। কিশোর কবি দৃপ্তভাবে সেই আহ্বানের প্রত্যুত্তর দেন, ‘প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে। আসলে, রবীন্দ্র ভাবনার স্রোতে অবগাহন করেছেন দুই কবিই, – দু’ রকম ভাবে। রবীন্দ্রনাথের অক্ষয়মন্ত্রকে প্রবল প্রত্যয়ে উচ্চারণ করেছেন সুকান্ত, আর সেই মন্ত্রকেই নিরুচ্চারে অস্তরে লালন করে চলেছেন বুদ্ধদেব। হয়তো সুকান্ত’র মতো প্রতিবাদে ঝলসে উঠতে পারেননি। তিনি, তবু ও এ কবিতায় আমরা এমন একজন কবিকে পাই পূর্ব সূরীকে স্মরণের সূত্রে যিনি নিজের প্রতিবাদী মনটিকে চিনিয়ে দেন, বুঝিয়ে দেন জীবনের জয়গানে মুখর কবিসত্তাকে। এ কবিতা পাঠের প্রাপ্তি ও সেখানেই।