আধুনিক সাহিত্য সমালোচনায় শৈলীবিজ্ঞান এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় স্বরূপ। বিংশ শতকের ভাষাবিজ্ঞান ও আধুনিক সাহিত্য সমালোচনার যৌথ ফসল হল শৈলীবিজ্ঞান ৷ শৈলীবিজ্ঞান প্রথাগত সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি নয়, এই পদ্ধতিতে ভাষা ও তার প্রকাশ ভঙ্গিই মূল আলোচ্য কবি সাহিত্যকগণ কাব্যের ভাষাকে দৈনন্দিন কথা বলার ভাষা থেকে পৃথক করে নেন। কারণ দৈনন্দিন কথাবার্তায় চলে communication। আর সাহিত্যের লক্ষ্য expression । অবশ্য কোনো কবি বা সাহিত্যিক দৈনন্দিনের ভাষাকে সাহিত্যে ঠাঁই দিলেও কাব্যের রসসৃজনের প্রশ্নে সেই ভাষাও প্রধান ভূমিকা নেয়; অর্থাৎ শৈলী হল সেটাই যে পদ্ধতিতে স্রষ্টা বা লেখক সৌন্দর্যের উপাসনা করেন। ভাষা বিজ্ঞানীরা সাহিত্যের সৌন্দর্য সম্পর্কে নিশ্চিত থেকে সেই পদ্ধতিকে খুঁজে বেড়ান যার প্রয়োগে সাহিত্যের রসপ্রাপ্তি ঘটছে ; শৈলী হল সেই পদ্ধতি। পাশ্চাত্যে সোস্যুর, চমস্কি, স্টানবিয়োভিচ প্রমুখ সাহিত্য তাত্ত্বিকগণ শৈলীর নিয়ে নানা মতবাদ প্রকাশ করেছেন, অবশ্য এর সূত্রপাত হিসাবে অ্যারিস্টটলকেই ধরতে পারি। অ্যারিস্টটল পোয়েটিকস-এ বলেছেন— ‘deviates from the ordinary modes of specer…deviation from the ordinary words’.

অর্থাৎ ভাষার স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গি ও অর্থের বিচ্যুতি সাহিত্যে ঘটে। শৈলীর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলা ভাষার শৈলী চর্চায় পবিত্র সরকার, শিশির কুমার দাশ কিংবা অভিজিৎ মজুমদারের ভূমিকাও কম নয়। মোহিতলালের কথাতেও সেই দিকে ইঙ্গিত আছে। ‘ভাষাকে অবিকল যথাযথরূপে প্রকাশ কবিবার জন্য ভাষাকে সাধারণ ধর্ম হইতে একটি ভিন্ন ধর্মে গ্রহণ করাইতে হয়’। [ সাহিত্য বিচার ]

বুদ্ধদেব বসুর ‘২২ শ্রাবণ’ কাব্য গ্রন্থের রবীন্দ্রনাথের প্রতি কবিতার শৈলী নির্ণয় করলে বুঝতে পারি, কবিতাকে Organized massage এবং তা বাক্যের গঠন কৌশল বা আভরণ প্রয়োগের রীতির সঙ্গে অন্বিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি কবিকে কীভাবে দোলা দিয়েছে তার পরিচয় কবিতার ছত্রে ছত্রে অনুরণিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও জাতির হিংস্রতা কবিকে বিচলিত করেছিল। ফ্যাসিজ্ম যখন জাতির প্রাণ রুদ্ধ করছে তখন ফ্যাসিবাদ বিরোধী ‘প্রগতি’ লেখক শিল্পী। সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধদেব বসুও এই সংঘে যোগদান করেন। তাঁর কবিতার সভ্যতার দারুণ দুর্দিনে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রেমের মুক্ত বাণীকে পাথেয় করে চলার কথা আছে।

কবি তাঁর রাজনৈতিক ভাবকে কবিতায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একেবারে অন্তমিল যুক্ত সনেটের দ্বারস্থ হয়েছেন। চোদ্দো পঙ্ক্তিতে বিন্যস্ত এই কবিতায় বুদ্ধদেব বসু বেশ কিছু অভিপ্রায়িক শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘শ্মশান শয্যায়’ শব্দদ্বয়ের দ্বারা সভ্যতার অবনমন ও তার প্রেক্ষাপট যেন চিত্রকল্পের মতো অঙ্কিত করা হয়েছে।‘মহামারী’ শব্দটি সভ্যতার ক্রমশ আশ্রয়কে তুলে ধরে। ‘প্রাণ লক্ষ্মী’ প্রাণ হল অস্তিত্ব ও লক্ষ্মী হল ঐশ্বর্য, প্রাণ হল প্রবাহমানতা লক্ষ্মী হল তার দেবী। দ্বিতীয় স্তবকের প্রাণ রুদ্ধ শব্দটিও সম অর্থ বহন করে আনছে। এর সঙ্গে আছে সেই ঔপনিবেশিক ভারতের কথা, যেখানে মানুষ নানাভাবে শোষিত হতে হতে শেষ হয়ে গেছে। ভারতের স্নিগ্ধ উপকূলে তার লোভের লালা ঝরিয়েছে। অর্থাৎ শুধু উপকূল শব্দটিই যেন সেই ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছে। ‘উন্মত্ত জঞ্জু’-র মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনেতাদেরকে আর ‘সোনার হরিণ’ সেই শান্তিকামী মানুষ যারা শান্তি চায় কিন্তু উন্মত্ত জন্তুর মুখে পড়ে তা পায় না। আবার সভ্যতার এই দুর্দিনে তিনি আশ্রয় করেছেন রবীন্দ্রনাথকে, তাঁরই মন্ত্রেই আমাদের জাগরণ ঘটবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— 

‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’

চিত্তের মুক্তি, মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা এসবই বুদ্ধদেব বসু তথা আমাদের কাছেও বাণীমন্ত্র। কবি রবীন্দ্রনাথের অভয়মন্ত্র পাষাণের ঘুম ছুটিয়ে জীবনের জয় ঘোষণা করতে পারে।

কবিতায় তৎসম শব্দ ও যুক্তাক্ষর এর প্রয়োগ বেশ লক্ষ করি। যেমন—শ্মশান, উড্ডীণ ইত্যাদি কোনো কোনো পক্তির প্রায় সবকটি শব্দই যেন যুক্তাক্ষর।

বুদ্ধদেব বসু এই কবিতায় সভ্যতার আসন্ন দুর্দিনকে চিত্রিত করার জন্য আশ্রয় করেছেন অসাধারণ শৈল্পিক ভাবনাকে ; প্রত্যেকটা শব্দই যেন উদ্দেশ্যপ্রাণোদিত হিসাবে পাঠকমনকে নাড়া দিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির কাছে প্রিয়তম। লেখকের শব্দচয়নে যেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি। আবার এ কবিতা প্রথাগত রোমান্টিক সাধনার ফসল নয়। জাতির উত্তরণের প্রশ্নে তাঁর ভাবনা এবং রবীন্দ্রনাথের অক্ষয় মন্ত্র যেন কবিতার মূল ভিত্তি। প্রথম স্তবকে জাতির দুর্দিনকে এমনভাবে চিত্রিত করেছেন তা যেন চিত্রকল্পই। শিল্পের সাধনা যে মানুষের জন্যই তা বুদ্ধদেব বসু দেখালেন আলোচ্য কবিতায়।