১৯৩৯-এ শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। এই সময় প্রকাশিত হয়—’বামপন্থী মাসিক পত্রিকা ‘অগ্রণী’। কমিউনিষ্ট পার্টি ব্রিটিশ রাজকে সাহায্য না করবার নীতিতে দৃঢ় সংকল্প। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ এই সময়ের মধ্যে মার্কসীয় ভাবধারায় প্রভাবিত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন বহু কবিতা। প্রকাশিত হল বিভিন্ন পত্রিকায় যেমন—‘কবিতা’, ‘পরিচয়’’ অগ্রণী’ ইত্যাদি। প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘পদাতিক’। ছন্দ-হিল্লোলে দোলায়িত অথচ সংগ্রামের সুরে শক্তির ব্যঞ্জনাময়, বিচিত্র শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ এই কবিতার বইটি মুহূর্তে জয় করে নিল বাঙালি পাঠককে। “প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখী আমরা।–এই সংকল্প উদ্ভাসিত হল কবিতার ছন্দে। ‘চিমনির মুখে শোনা সাইরেন শঙ্খ/ গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে।”—এই বিশ্বাস তরুন বাঙালি তরুণদের একাংশের মনে ছড়িয়ে গেছে।

শুধু তাই নয়, পদাতিক কবির পদধ্বনির মূর্ছনায় তৎকালীন যুবক বৃন্দ বিহ্বল উদ্বেলিত প্রাণে ভাবতে বসেছে, এই বিশ্বাস নিয়ে—

“শতাব্দীর লাঞ্ছিত আর্তের কান্না

প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা।

মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না

পরো পরো মুছে সজ্জা।” (মে দিনের কবিতা)

বোধকরি, নজরুলের পরেই এই সময়েই সজোের সংগ্রামের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছিল বাংলা কবিতায়। পরাধীন অথচ জাগ্রত চেতনা বাঙালি এইসব কবিতায় খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাণের ভাষা।

কিন্তু ‘পদাতিক’ এর সব কবিতাতেই—‘কমরেড আজ নবযুগ আসবে না ? / কুয়াশা কঠিন বাসর/কুয়াশা কঠিন বাসর যে সম্মুখে.’—এই ধরনের সরলোক্তির ভাষ্য পাওয়া যাবে না। এই সময় থেকেই মূলত সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতার অনুভবকে শাণিত বিদ্রুপাত্মক বাচনে প্রকাশ করতে অত্যন্ত অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। যেমন—

অস্ত্র মেলেনি এতদিন, তাই ভেঁজেছি তান।

অভ্যাস ছিল তির ধনুকের ছেলেবেলায়।

শত্রুপক্ষ যদি আচমকা ছোঁড়ে কামান— 

বলব, বৎস! সভ্যতা যেন থাকে বজায়।

চোখ বুজে কোন কোকিলের দিকে ফেরার কান৷৷

দেশ যখন প্রতিবাদের দিকে এগোচ্ছে, দেশের রিক্ত জনগণের পক্ষে যখন নতুন সমাজ গড়ে তোলবার আহ্বান হয়ে উঠেছে উত্তাল, সেই সময়ে সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী স্তরে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আকুলতা সব দেশেই লক্ষ্য করা যায়। সেই শ্রেণির প্রতি নির্ভুল ব্যঙ্গ উক্ত কবিতাংশটিকে উত্তীর্ণ করেছে। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ কবিতা থেকে পরিকল্পিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘বধূ’ কবিতায় গ্রাম ও শহরের ভেদ তুলে ধরা হয়েছে পুঁজিবাদী বিনিয়োগের তারতম্যের দিক থেকে। এখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা। নিপুণভাবে রচিত এই কবিতাটি কবির অল্প বয়সের রচনা হলেও এখনও কবিতাটি পাঠকদের প্রিয়— 

পাষাণ-কায়া, হায়রে, রাজধানী।

মাশুল বিনা স্বদেশে দাও ছেড়ে ;

তেজারতির মতন কিছু পুঁজি 

সঙ্গে দাও, পাবে দ্বিগুণ ফিরে॥

আসলে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন নতুন যুগের প্রত্যাশায় উদ্বেল। নিজেদের পথ সম্বন্ধে সেই সময়ে তাঁর কোনো সংশয় ছিল না। প্রতিরোধ স্তব্ধ করে দিতে হবে পুঁজিবাদী অত্যাচারীর লুণ্ঠন প্রয়াস, নবীন প্রাণের শক্তিতে সত্যিই গড়ে উঠবে এই সাম্যের নব সমাজ। কেবল সংগ্রাম প্রগাঢ় করে তোলবার অপেক্ষা। এই উপলব্ধি তাঁর তরুণ বয়সের উচ্ছ্বাসিত আবেগের কবিতাগুলিকেও প্রকৃত কবিতা করে তুলতে পেরেছে। সমালোচ্য কবিতায় তিনি অতিকৌশলের সঙ্গে জানিয়েছেন—

“ছাদের পরে হে’থাও চাঁদ ওঠে—

দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন

আসছে লাঠি উঁচিয়ে পেশোয়ারি

–ব্যাকুল খিল সজোরে দিই তুলে।”

তিনি জেনেছিলেন, যে সমাজের মধ্যে দিয়ে তাঁদের পদচারণা, সে সমাজ তাঁদের কোনো আশার আলো দেখাতে পারে না। কারণ দেশ যে যুদ্ধের কবলে নিপাতিত। তাই তিনি অকাতরে বলেওছেন—“বুঝেছি কাঁদা হেথায় বৃথা। কারণ “গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এলো।” আশার আলো নিভু নিভু।

মোটের উপর এই সুদূর প্রসারী কল্পনার প্রাবল্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবি হিসাবে নিজের আসনটিকে বাংলা কাব্য সাহিত্যে সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে এসেছিলেন বলে সাধারণ মানুষের ভাষাটি চমৎকার বুঝেছিলেন। তাই অতি সাবলীল ভঙ্গিতে ‘বধূ’ কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন সমসাময়িক দেশ ও রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি এখানেই কবি ও কবিতাটির সার্থকতা নিহিত।