কবিতার উদ্দেশ্য হল ভাষানির্ভর সৌন্দর্যের সৃষ্টি। মনের কথাকে কাব্যের ভাষায় রূপ দিতে গিয়ে কবিগণ ভাষার বিচ্যুতি ঘটান। ফলত মুখের ভাষা ও সাহিত্যের ভাষা আলাদা হয়ে যায়। ভাষাতাত্ত্বিকরা একেই বলেন ‘প্রমুখন’।
কবিতার ক্ষেত্রে প্রমুখনের যে প্রয়োজনীয়তা আছে তার কারণ প্রথমত, প্রমুখনের ফলে ভাষা বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, কবিতা যে Organied massage প্রমুখন তার সহায়ক, তৃতীয়ত, প্রমুখনের উদ্দেশ্য হল কাব্যকে ভাষানির্ভর সৌন্দর্য দান কারা। শৈলী চর্চার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভাষার সেই প্রমুখনকে খুঁজে ফেলা, যার দ্বারা সাহিত্যের রসসমৃদ্ধি ঘটেছে। বলা যায় আধুনিক ভাষা বিজ্ঞান ও বিংশ শতকের সাহিত্য সমালোচনার মিলিত রূপ এই নতুন ধারাটি কবিতার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তার বিচ্যুতিগুলি নির্ণয় করে এবং ভাষা ছন্দে অলংকারের রূপ দেখে যুক্তিনিষ্ঠ বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে চায় তার রসস্ফূর্তির কারণকে।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের বোধন কবিতা খুব ছোটোখাটো নয়, বরং বেশ দীর্ঘ, ৯৩টি চরণ ও ১০টি স্তবকে বিন্যস্ত এই কবিতায় রাজনৈতিক ভাবনা আশ্রিত। এই কবিতাটিতে জনজাগরণের ও বিদ্রোহের ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। ‘বোধন’ নামকরণটি বেশ প্রতীকধর্মী। দুর্গার অকালবোধনের সঙ্গে মিলিয়ে, দুর্গা যেমন অসুরদের নিপাত করেন কবিও চান বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষ শোষক সম্প্রদায়কে এভাবে নিপাত করুক।
মহামানবের প্রতি আহ্বান বাণী দিয়ে শুরু হয়েছে ‘বোধন’ কবিতাটি। লোকচক্ষুর আড়ালে জমে থাকা অনুকার। মহামারি জাতির জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। এখানে চরম দুঃখে কেটেছে সর্বনাশের খাল’ শব্দটি প্রমুখিত। দুঃখ দারিদ্র্য যে মানুষকে তার নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে তার ফাঁক দিয়েই শোষকের দল শোষণ করে চলেছে। ‘নির্জনতার কালো শব্দটি চৈতন্যহীন নির্বাক মানুষকে বুঝিয়ে দেয়। ‘শুকনো পাতা’ সর্বহারা শোষিত মানুষদের প্রতীক। দ্বিতীয় স্তবকে ‘ধুকে’ শব্দটি নিপীড়িত মানুষের কর্মক্ষীণতাকে বোঝাচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের নিষ্ক্রিয়তা তাদের ওপর শোষণের মাত্রাবৃদ্ধির কারণ—
তোমার খেতের শস্য
চুরি করে যারা গুপ্তকক্ষেতে জমায়
দাদেরি দুপায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়।
চতুর্থ স্তবকের চিত্রকল্প কবিতাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। বাকি স্তবকগুলিতে এসেছে সেই শ্রেণিদ্বন্দ্ব। কখনও স্বার্থপর পুঁজিপতি সমাজের কাছে কবি জবাব চেয়েছেন যে দরিদ্র জনসাধারণের এত মৃত্যু কেন। তিনি বলেছেন—
‘কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র
দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র’
তিনি ধূর্ত বণিক মজুতদারদের বলেছেন ‘স্বদেশ প্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি’। তাই তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা—
প্রিয়কে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
………..
স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই
শেষ করেছেন এই বলে যে এখনই তাদের দেশপ্রেমের উপযুক্ত পরীক্ষা দিতে হবে। তিনি বলেছেন পূর্বপুরুষদের মহিমা ভুলে গেলে এখান থেকে আমাদের বিতাড়িত হতেই হবে।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কবিতায় ‘আমির’ গুরুত্ব অসীম। আমিকে ঘিরেই তার সমস্ত অনুভব, অনুভূতি। প্রথম স্তবকে ‘আমি’ কবি স্বয়ং। ‘তুমি’ মহামানব। দ্বিতীয় স্তবকে আমি কবি। তুমি শোষিত মানুষ যেন অত্যাচারী।
আবার পঞ্চম স্তবকে আমি কবি হলেও তুমি দেশমাতৃকা। এছাড়াও কিছু কিছু শব্দ তাঁর হাতে বহুমাত্রিক রূপ পেয়েছে। যেমন ‘মানুষ’ শব্দটি বিপ্লবী ভারতবাসীকে বোঝাচ্ছে।
‘বোধন’ কবিতাটি লোক উপাদান সমৃদ্ধ। যেমন ‘ভাঙা ঘর। ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জণতার আলো’ এই বাক্যটির অন্তরে থাকতে পারে—মাতৃ ভিটাতে ঘাস জন্মনোর বাগধারাটি। আবার ‘রক্তের ভাগীরথী আনো’ বাক্যটি পড়লে ভগিরথের গঙ্গা আনার প্রসঙ্গ মনে আসতে পারে। এছাড়াও আছে পৌরাণিক বিশ্বাস যা কবিতাতে ক্রিয়াশীল—
ভেবেছ সংসার সিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার’ ‘সংসার সিন্ধু পার’ বাঙালির একটা পৌরাণিক বিশ্বাস নয় কি?
ছন্দ অলংকার ও চিত্রকল্প সৃষ্টিতে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি লাটানুপ্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে শব্দের সমান্তরাল সৃষ্টি করেছেন—তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল’। এছাড়াও পায়ে পায়ে, চুপি চুপি ইত্যাদি শব্দগুচ্ছও সমান্তরাল সৃষ্টি করেছে।
চিত্রকল্প কাব্যের মাধুর্যতা দান করে। আত্মজাগরণ ও উদ্বোধনের এই গানেও আছে চিত্রকল্প। যেমন—
‘আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড় ;
আজকের নৈঃশব্দ্য হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি।
দুহাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা।
বোধন কবিতাটি তিনটি কালকে আশ্রয় করে গঠিত; অতীতে বিশ্বাস, বর্তমান জাগরণ ও ভবিষ্যতে নতুন স্বপ্নের ইঙ্গিত বর্তমান। এছাড়াও স্তবক সজ্জার ক্ষেত্রেও নতুনত্ব এনেছেন। ভাবপ্রবাহের সঙ্গে বিষয়ের পরিবর্তনের ফলেই এরূপ নির্মাণরীতি এসেছে। ভাবের প্রয়োজনে কখনও বিস্তৃত, কখনও সংকীর্ণ, কখনও স্তম্ভাকৃতি হয়েছে। যাইহোক ভাষার প্রমুখন ঘটিয়ে, স্তবক সজ্জায় নূতনত্ব এনে ছন্দের মাধুর্য দান করে যে সৃষ্টি কবি সুকান্ত করলেন তা অমর হয়ে রইল।
Leave a comment