সবাই যখন চলমান সমাজের গতানুগতিকায় গা ভাসিয়ে দেয় আরাম আয়েশে, লারেলাম্পা, ডামাডোলে হাতে হাত মিলিয়ে অনির্দেশ্য পথে স্রোতের কুটোর মতো ছুটে চলে, তখনো কোনো কবি ছল ছল চোখে জেগে থাকেন। কেঁপে কেঁপে ওঠেন সময়ের ভবিতব্যে, শিউরে ওঠেন তাদের বেঘরো মানসিকতায়, পাঁচের দশকে সেই জেগে থাকা, কেঁপে ওঠা, শিউরে ওঠা কবি শঙ্খ ঘোষ। ‘বাবরের প্রার্থনা’র অন্তরালে সকল পিতার আত্যাস্তিক প্রার্থনার শব্দ উচ্চারণ করেছেন। শান্তি, শান্তি, সুস্থ, ভালোবাসা ও সুখের প্রচেতনায় স্তব্ধতার এই কবিতা নিঃসন্দেহে আমাদের বাংলা কবিতার অঙ্গনে সজীব সংযোজন।

সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ ‘বাবরের প্রার্থনা’র নাম কবিতাটি আমাদের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে চেতনায় একটি সম্পূর্ণ মুঘল ইতিহাস উন্মোচিত হয়ে যায়। সে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বাবর। যিনি তার বাহুবল কূটনীতি ও আধুনিক সমরাস্ত্রের প্রয়োগে এই ভারতের ইতিহাসকে কণ্টকিত, কলঙ্কিত ও গৌরবদীপ্ত করেছেন। কবি শঙ্খ ঘোষ এই কবিতার প্রাণকেন্দ্রে ইতিহাসের মূল সত্যটুকুকে স্থান দিয়ে বাকিটুকু কল্পনার রসে রাঙিয়ে নিয়েছেন। আবুল ফজল উল্লিখিত বাবরের জীবনী ইতিহাস থেকে বাবর-পুত্র হুমায়ুনের অসুস্থতার সংবাদটুকু সংগ্রহ করে বিষয়টিকে নামিয়ে এনেছেন দেশ-কাল-পাত্রভেদে পৃথিবীর প্রতিটি জনকের কোমল হৃদয়ে। পিতার পুত্রস্নেহের যে কোনো বিকল্প হতে পারে না, এবং তা পৃথিবীর প্রতিটি পিতার হৃদয়েই সমানভাবে গুরুত্ব পায়। এই বিশেষ স্পর্শকাতর ব্যাপারটিকে কবি শঙ্খ ঘোষ অত্যন্ত সুন্দরভাবে মানসিক আবেদনে পুষ্ট করেছেন।

কবি শঙ্খ ঘোষ ইতিহাসের অনালোচিত দিকটিকেই তার কবিতার কথ্যবস্তু করেছেন। সম্রাট বাবর দিনে ক’বার নামাজ পড়তেন বা তিনি কতবেশি ধর্মভীরু ছিলেন যে বিষয়ে ইতিহাস নীরব। তবে এটুকু সত্য বাবর তার পুত্রের অসুস্থতার জন্য চিন্তিত হয়েছিলেন। কবিতায় উল্লিখিত হয়েছে বাবর জানু পেতে পশ্চিমদিকে মুখ করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনায় বসেছেন। বসন্তকাল তার উপকরণরাজি আজ আর ভরে দিতে পারছে না। বাবর তার সম্ভুতির সুখের জন্য নিজের ধ্বংস বা মৃত্যু কামনা করছেন। যদিও ব্যাপারটি অযৌক্তিক অবৈজ্ঞানিক যে কারো পরমায়ু অন্য কারোর পরমায়ুর সঙ্গে যোগ বা বিয়োগ করা যায়। জীবন-মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায়ভার ঈশ্বরের। তবুও বাবরের একান্ত ইচ্ছা যে আর পুত্র তার পরমায়ুর দৌলতে যেন বেঁচে থাকে।

বাবর তার পুত্রের ঝকঝকে যৌবন মিলিয়ে যাওয়ার জন্য যারপরণায় অনুতপ্ত। তিনি অনুভব করছেন কোনো এক গোপন দুষ্ট রোগ তার সন্তানের পরমায়ু, যৌবনের সব রঙ নষ্ট করে দিচ্ছে অহরহ। তার পুত্রের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে মৃত্যুর কালো দৃপ্ত দাগ, তার ফুসফুস, ধমনী, শিরা সব যেন অকেজো হয়ে যাচ্ছে এবং তার যন্ত্রণাজনিত প্রতিচ্ছবি তার সন্তানের চোখে মুখ ফুটে উঠছে—এই দৃশ্য পিতা হয়ে বাবরের পক্ষে সহনশীলতার ঊর্ধ্বে।

বাবর চাইছেন শহরে, গ্রামে, প্রান্তরে দিকবিদিক প্রতিধ্বনিত হোক আজানের ধ্বনি। যে আজান গান প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প বা বৈদেশিক আক্রমণের প্রাক্কালে সমস্ত মানুষকে একযোগে তার প্রতিরোধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার উন্মাদনা জাগায়, বাবর এক্ষণে তাই করতে চাইছেন। তাঁর সন্তানের মৃত্যু-প্রায় অবস্থা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের চাইতে কম অর্থময় নয়। বাবর এক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাইছেন। কিন্তু এতে একটা তাঁর শর্ত আছে, সেটি হল তার পুত্রের অনন্ত যৌবন, পুত্রের প্রাণ।

বাবর প্রচণ্ডভাবে অনুতপ্ত এই ভেবে যে তাঁর পুত্রের এই মরণোম্মুখ অবস্থার জন্য তার নিজের পাপ কর্ম দায়ী। তিনি নিজেকে তাই ধিক্কার দিতে পিছপা নন, বাবর তাঁর নিজের বর্বর জয়ের উল্লাসে আজ নিজের ঘরে মৃত্যু ডেকে এনেছেন। এই রাজ্যজয়মূলক পাপ বা অপকর্মের জন্য তার পুত্রের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বাবর ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ জানাতে প্রার্থনায় বসেছেন। ঈশ্বরকে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন যে কারো পাপের পরিণতি অন্যের ওপর বর্তায় কীভাবে। শুধু তাই নয় বর্তমান বাবরের আলোয় ভরা রাজপ্রসাদের আলোর রোশনায় পবিত্র, নিষ্পাপ, মানুষের হৃদয়, হাড় পুঁড়িয়ে দেয়। আলোকপ্রিয় পতঙ্গেরা যেমন আলো চুমতে গিয়ে মৃত্যুমুখে ফেরে বাবরের রাজপ্রাসাদের আলোর দ্যুতি কি শেষ পর্যন্ত তার নিজের ছেলেকেই পুঁড়িয়ে দিল। এরকম নানারকম অনুশোচনামূলক উক্তি বাবর করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত বাবর তাঁর সৃষ্ট রাজকীয় প্রসাদের অসামান্য বৈভব ও সুখের উপকরণের বিনিময়ে এবং নিজেকে আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে যদি তার প্রিয় পুত্র দীর্ঘজীবন ও সুস্থজীবন লাভ করে তাই তাঁর পক্ষে শ্রেয়। শেষপর্যন্ত বাবর তার পুত্রের সুখের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গের মধ্যে দিয়ে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে নৈবেদ্য হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। এক্ষেত্রে বাবরকে কোনো রাজ্যলোভী সম্রাট হিসেবে না দেখে বরং পুত্রের সুখের জন্য নিজের জীবন বিসর্জনে অটল এক সাধারণ পিতাকে দেখে আমরা চমকিত ও আশ্চর্য হই। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় বাবরের এই মাত্রাতিরিক্ত অপত্য স্নেহ আমাদের চোখের সামনে পিতা-পুত্রের ভালোবাসার এক ভুলে যাওয়া শিক্ষার নবীকরণ ঘটাতে পারি। কবিতার সার্থকতা এখানেই।