বিংশ শতকের সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি ও আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের মিলিত ফসল হল শৈলী বিজ্ঞান। কবিগণ সাহিত্যের আসরে ভাবের খেলা খেলে থাকেন, ভাষা তার সহযোগী হয়। ভাব প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ভাষা। সাহিত্যের ভাব প্রকাশ ভাষার সাধারণ প্রকাশে ঘটে না, ভাষার norm থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়ে তাকে আরও গতিশীল করে তুলতে হয়। কবিগণ তাই ভাবের প্রকাশ ঘটান, ভাষাকে পরিবর্তিত করেন। শৈলী বিজ্ঞান ভাষার এই অন্তর্গঠনিক কৌশল বিন্যাস করে দেখতে চায় কোন গুণে তার রসসংবেদী। অভিজিৎ মজুমদার বলেন— ‘শৈলী বিজ্ঞানীর মূল উদ্দেশ্য কোনো রচনার নিবিড় পাঠের মধ্য দিয়ে ভাষাবুনোটে অনঃশায়ী ধ্বনি-শব্দ-শব্দার্থগত, বাক্যিক এবং সর্বোপরি অধিবাচনিক (discourse) বৈশিষ্ট্যের আবিষ্কার।

শৈলী বিচার করতে গিয়ে সমালোচক কবিতার রস সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রশ্নহীন থেকে খুঁজতে থাকেন ভাষার প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যকে।

দুটো বিশ্বযুদ্ধ জাতিকে চরম শিক্ষা দিয়েছে। জাতির জীবনে এসেছে বিচ্ছিন্নতা হতাশা। ফ্রয়েড ও মার্কসবাদ মানব জীবনকে স্পর্শ করেছে। সমকালীন কবিদের কবিতায় এই সমস্ত মতবাদ নানা ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বামপন্থী আন্দোলন মানুষকে স্পর্শ করেছে। কবিদের কবিতাও এইসব নানা অভিঘাতে পালটে গেছে। শঙ্খ ঘোষ এই সময়কার কবি, তিনি বলেছেন— ‘কী নিয়ে লেখা হবে কবিতা ? আমার বাইরের পৃথিবী নিয়ে ? নাকি আমারই ব্যক্তিগত জগৎ নিয়ে ……এই দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর যাওয়া আসা করেই কি বেঁচে নেই মানুষ’?

তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় কমিটমেন্টকে।

ঐতিহাসিক তথ্য থেকে বাবর সম্পর্কে জানা যায় যে তিনি পুত্র হুমায়নের অসুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে সুস্থতার প্রার্থনা করেছিলেন। তারপর হুমায়ন সুস্থ হলেও বাবরের মৃত্যু ঘটে। এই ঐতিহাসিক তথ্য কতটা সত্য তা বিচার্য নয়। শঙ্খ ঘোষ এই ঘটনাকেই তাঁর কন্যার অসুস্থতা থেকে আরগ্যে কামনার্থে ব্যবহার করেছেন এবং তা ব্যক্তিক স্তর থেকে উন্নীত হয়ে চিরন্তন আকুতিতে পরিণত হয়েছে।

ছয়টি স্তবকের চব্বিশটি পঙক্তিতে বিন্যস্ত কবিতায় কবি তাঁর মনোভাবকে এক মানবিক আবেদনের চেহারা দিয়েছেন। প্রার্থনার আবহকে অটুট রাখতে কোনো বিলাপ বা উচ্ছ্বাসকে কবিতায় স্থান দেননি। কবিতায় শুরু এক শূন্যতা দিয়ে। দ্বিতীয় স্তবকে সন্তানের জন্য পিতৃহৃদয়ের কাতরতা, তৃতীয় স্তবকে সেই শূন্যতা ঘুরে ফিরে আসে, নিজের প্রাণের বিনিময়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার আশা, চতুর্থ ও পঞ্চম স্তবকে আত্মবিশ্লেষণ, ষষ্ট স্তবকে দেখি, তার প্রার্থনা—

‘জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে ?

ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’

পুত্রের যৌবনের ক্ষয় বোঝাতে পিতা বাবর ব্যবহার করেছেন ‘বসন্তের শূন্য হাতে’ শব্দগুচ্ছ। পরের স্তবকেও এই ক্ষয় বোঝাতে ‘গোপন ক্ষয়’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যেকটি স্তবকেই এসেছে একপ্রকার পাপবোধ ও শূন্যতা। কবি জানেন না কীজন্য তার মনে এসেছে শূন্যতা, কেন সন্তানের যৌবন ক্ষয় হচ্ছে, তিনি অংশত নিজেকেও দায়ী করেছেন, বলেছেন—

আমারই বর্বর জয়ের উল্লাস 

মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে?

শঙ্খ ঘোষ এই কবিতায় অলংকার নির্মাণের ক্ষেত্রে চমৎকার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। যেমন—

  • ১। পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়-রূপক

  • ২। আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক— অনুপ্রাস

  • ৩। লক্ষ্য নির্বোধ পতঙ্গের রূপক

  • ৪। জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে— অনুপ্রাস।

কবিতার একটি প্রয়োজনীয় উপাদান তার চিত্রকল্প। কবিরা নানা ছবির মালা গেঁথে কবিতাকে চিত্ররূপময় করে তোলেন। আলোচ্য কবিতায় শঙ্খ ঘোষ সন্তানের গোপন ক্ষয়ে আশঙ্কিত হয়ে যে কল্পনার অনুভূতি পাঠককে দিয়েছেন তাতে আছে চিত্ৰস্পৰ্শ—

  • নাকি এ প্রাসাদের আলোর ঝলকানি

  • পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়

  • এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে

  • লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের

কবিতার নামকরণটিও উপমার দৃষ্টান্ত। কবির ব্যক্তিক অনুভূতি বাবরের প্রার্থনার সঙ্গে মিলে মিশে গেছে, কোথাও তাই বাবর-এর কথা নেই। প্রার্থনা দিয়ে শুরু আর শেষও সেই প্রার্থনাতেই। সন্তানের আরোগ্য কামনার যার মূল্য লক্ষ্য। একদিকে আছে কবির কাছে বর্তমান সমস্যা সম্পর্কিত চিন্তা, যা কবিকে প্রেরণা দিয়েছে। অপরদিকে আশাবাদ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা যা থেকে তার দৃপ্ত উচ্চারণ ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’। ভবিষ্যৎ ভাবনাতে কবির যে সংশয় তা প্রকাশ পেয়েছে জিজ্ঞাসাসূচক বাক্যে, যা চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ স্তবকে বিধৃত। মোট কথা, কবিতার সামগ্রিক রসাবেদন সৃষ্টিতে তাঁর এই অপূর্ব নির্মালন প্রতিভা সহায়ক হয়েছে ; সবকিছুর সীমা ছেড়ে যেন কবিতাটি সার্বজনীন রসাবেদন সৃষ্টি করেছে।