কবিতার উদ্দেশ্য হল ভাষানির্ভর সৌন্দর্যের সৃষ্টি। মনের কথাকে কাব্যের ভাষায় রূপ দিতে গিয়ে কবিগণ ভাষার বিচ্যুতি ঘটান। ফলত মুখের ভাষা ও সাহিত্যের ভাষা আলাদা হয়ে যায়। ভাষাতাত্ত্বিকরা একেই বলেন ‘প্রমুখন’।
কবিতার ক্ষেত্রে প্রমুখনের যে প্রয়োজনীয়তা আছে তার কারণ প্রথমত, প্রমুখনের ফলে ভাষা বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, কবিতা যে Organized massage প্রমুখন তার সহায়ক, তৃতীয়ত, প্রমুখনের উদ্দেশ্য হল কাব্যকে ভাষানির্ভর সৌন্দর্য দান কারা। শৈলী চর্চার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভাষার সেই প্রমুখনকে খুঁজে ফেলা, যার দ্বারা সাহিত্যের রসসমৃদ্ধি ঘটেছে। বলা যায় আধুনিক ভাষা বিজ্ঞান ও বিংশ শতকের সাহিত্য সমালোচনার মিলিত রূপ এই নতুন ধারাটি কবিতার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তার বিচ্যুতিগুলি নির্ণয় করে এবং ভাষা ছন্দে অলংকারের রূপ দেখে যুক্তিনিষ্ঠ বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে চায় তার রসস্ফূর্তির কারণকে।
কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী এই লেখক তাঁর রচনায় সমাজের দায়বদ্ধতাকে এড়াতে পারেননি। চা বাগানে, কয়লাখনিতে, পাহাড়ে অরণ্যে বঞ্চিত মানুষদের পক্ষে তিনি কলম ধরছেন। পুঁজিবাদী সভ্যতাও যেভাবে সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করে, তাও কবিকে ব্যথিত করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘আমি তোমাদেরই লোক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’ ‘কবিতাটিতে সেই ধূসর ফ্যাকাশে যন্ত্রণাকাতর ভারতের চিত্র অঙ্কন করেছেন। অত্যাচার অবিচার ক্ষতবিক্ষত এই ভারতবর্ষের অবস্থা দিয়ে শুরু এই কবিতা।
স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে
আমার ঝাঁঝরা বুকের ওপর ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র তার নাম ভারতবর্ষ
শৈলী প্রসঙ্গে আমরা বিচ্যুতির কথা জেনেছি। আলোচ্য কবিতাতেও এরকম প্রমুখন দেখতে পাই—
আদর্শ বাক্য
-
স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে আমার ঝাঁঝরা বুকের ওপর যে মানচিত্র ফুটে উঠেছে তার নাম ভারতবর্ষ
-
ভরাট গর্তের মতো আকাশে মেঘ কেঁপে উঠেছে।
বিচ্যুতবাক্য
-
স্টেনগানের বুলেট বুলেটে আমার ঝাঁঝরা বুকের ওপর ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র তার নাম ভারতবর্ষ।
-
ভরাট গর্তের মতো আকাশে আকাশে কেঁপে উঠেছে মেঘ।
এইভাবেই কবিতাটি প্রচলিত নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন বাক্য গঠন করে নিয়েছে।
শব্দালংকারের পাশাপাশি অর্থালংকারও সমান নজর কাড়ে
উপমা :
১। ভরাট গর্তের মতো
আকাশে আকাশে কেঁপে উঠছে মেঘ।
২। আর একটু পরেই প্রতিটি খাল-বিল পুকুর কানায় কানায় ভরে
উঠবে আমার মায়ের চোখের মতো।
সমাসোক্তি :
প্রতিটি পাথর ঢেকে যাবে উদ্ভিদের সবুজ চুম্বনে।
অমিতাভ দাশগুপ্তের এ কবিতায় যেন ছবির মালা গাঁথা। প্রতিটি স্তবকেই আছে যেন চিত্ৰস্পর্শ। যেমন—
সেই রাতে
সেই তারায় তারায় ফেটে পড়া
মেফিলের রাতে তোমরা
ভুলে যেও-না আমাকে।
প্রথম স্তবকে ঝাঁঝরা বুকের ওপর ফোটা মানচিত্র—তারই নাম ভারতবর্ষ। পরের স্তবকে এই ভারতের আসল পরিচয় কী তা দেওয়া হয়েছে, পাহাড়ে অরণ্যে, কয়লা খাদানে শ্রমিকের চোখে জলে ভেজা ভারতবর্ষ। এছাড়াও এসেছে চাষির কথা যারা হাড়ের ফসফেট ব্যবহার করে রুক্ষমাটি উর্বরা করে তোলে। চতুর্থ স্তবকে এসেছে সংগ্রামের গল্প।
আলোচ্য কবিতায় দ্বিরুদ্ধ শব্দের বহুল ব্যবহার হয়েছে যেমন—বুলেটে বুলেটে। দাউ দাউ, আকাশে আকাশে। আবার বেশ কিছু বিদেশি শব্দের ব্যবহারও কবি করেছেন, যেমন—মাইল, স্টেনগান, বুলেট, কফি, ফসফেট ইত্যাদি।
বিরাম চিহ্নও যথাযথ ব্যবহার করেছেন। পূর্ণচ্ছেদ, কমা এবং ড্যাস ছাড়া অন্য বিরাম চিহ্ন নেই। যাইহোক শৈলী বিচার করে দেখলে বোঝা যায় কবিটির গঠন নৈপুণ্যই কবিতার প্রাণস্পন্দন।
Leave a comment