অধ্যাপক টার্নার শৈলীবিজ্ঞানের স্বরূপ নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন— “Stylistics is that part of linguistic which concentrates on variation in the use of language, often but not exclusively, with special attention to the most concious and complex use of languge in literature.” এই বক্তব্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, শৈলীবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রকে টার্নার শুধুমাত্র সাহিত্যের ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি—সাহিত্য ভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থাৎ লৌকিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভাষা ব্যবহারের বৈচিত্রকে এর অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে শৈলীবিজ্ঞান দু’প্রকার–সাহিত্যিক শৈলীবিজ্ঞান এবং সাহিত্যের শৈলীবিজ্ঞান।
কেবলমাত্র অধ্যাপক টার্নার নয়, উইডোেসন, অধ্যাপক জন লিয়স প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ শৈলীবিজ্ঞান সম্পর্কে অনুরূপ ভিন্ন ভিন্ন অভিমত পোষণ করলেও সার্বিক পর্যালোচনায় বোঝা যায় কিছু কিছু ব্যাপারেও পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ভাষা বিজ্ঞানের সঙ্গে শৈলীবিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ব্যাপারে সকলেই একমত। তাই যোন তাঁর এই শ্রেণির একটা প্রবন্ধের শুরুতেই বলেন—“The name ‘Stylistics’ is given to studies of many different kinds. About the only thing they all have in common is that they involve in some form or another an analysis of the linguistic structure of texts.”
ভাষা বিজ্ঞান হচ্ছে ভাষার গঠন সম্পর্কিত বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা। বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানে মুখের ভাষাই প্রাধান্য পেলেও তার লিখিত রূপটিও উপেক্ষিত নয়। যদিও এ দুয়ের মধ্যে উপস্থাপন রীতির পার্থক্য আছে। মুখের ভাষার অস্তিত্ব বক্তার উচ্চারিত ধ্বনি সমষ্টির ওপর। কিন্তু লিখিত ভাষা ধ্বনির প্রতীক চিহ্নের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া মুখের ভাষায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, বক্তা ও শ্রোতা প্রত্যক্ষ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু লিখিত ভাষায় সেই সম্পর্ক অনুপস্থিত। তা সত্ত্বেও উভয় ক্ষেত্রেই মূলত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ভাববিশেষের সঞ্চরণ ঘটে থাকে—যা ভাষা মাত্রেরই প্রধান কাজ। ভাষাবিজ্ঞানে বক্তার দিক থেকে প্রক্রিয়াটির আলোচনাকে বলা হয় Onomasiology এবং শ্রোতার দিক থেকে আলোচনাকে বলে Semasiology. লিখিত ভাষার পাঠ জনিত ভাষা বৈজ্ঞানিক আলোচনা Semasiology-র অন্তর্ভুক্ত, শৈলীবিজ্ঞানও এই পর্যায়ের।
ভাষার দৈনন্দিন স্বাভাবিক সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বক্তা ও শ্রোতার পারস্পরিক সম্পর্কে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। কারণ, বক্তা যা বলতে চান পাঠক বা শ্রোতার তা সঠিক ভাবেই গ্রহণ করেন। না হলে, ভাষার সামাজিক কাজই ব্যহত হত, কিন্তু সাহিত্যের ভাষার ক্ষেত্রে একথা বলা যায় না। যদি যেতো তাহলে বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা এই কবিতার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হত না। শৈলীবিজ্ঞানও সাহিত্য সমালোচনার প্রসঙ্গে ব্যাপারটা আলোচনা করা যাবে।
সাহিত্যে যেহেতু ভাষাশ্রয়ী সেইহেতু বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানীরা স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যের ভাষার বিশ্লেষণকেও তাঁদের আলোচনা করেছিলেন। ভাষা বিশ্লেষণে তাঁরা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেন। সঞ্জনক ও রূপান্তরক ভাষাবিজ্ঞানীরাও এই পদ্ধতিকে অস্বীকার করেননি। তাই বিজ্ঞান বস্তুনিষ্টভাবে বিশেষ বিশেষ তথ্যের পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে সাধারণ সত্যে উপনীত হতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘আরোহণ ধর্মী অবরোহণ ধর্মী’, নয়। ক্ষেত্র বিশেষে বৈজ্ঞানিক একটা অনুমানকে ভিত্তি করে অগ্রসর হলেও বিশেষ বিশেষ তথ্যের পরীক্ষান্তে যদি পূর্বগৃহীত, সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয় তবে তা নির্দ্বিধায় বর্জন করেন। বস্তুনিষ্ট এই বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিকেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বলে ধরতে হবে।
তাই বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানীরা যখন সাহিত্যের ভাষার দিকেও দৃষ্টি দিলেন, তখন তাঁদের লক্ষ্য সাহিত্য ভাষার বর্ণনামূলক বিশ্লেষণের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ রইল না। এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তাঁরা বস্তুনিষ্ট ভাবে সাহিত্যের স্বরূপ নির্ধারণের পথে পা বাড়াতে চাইলেন। সম্পাত চৌমস্কির মতবাদ ও প্রতিবাদের সম্মুখীন হচ্ছে। হয়তো অদুর ভবিষ্যতে ভাষা সম্পর্কে আরও নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা দেবে। কিন্তু সঞ্জনক ব্যাকরণ বর্ণনামূলক ব্যাকরণের যান্ত্রিকতা থেকে ভাষাকে মুক্ত করায় শৈলীবিজ্ঞান যে পায়ের নীচে একটা দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, শৈলীবিজ্ঞান এই দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে মূলত ইংরেজি সাহিত্যের আলোচনাকে কেন্দ্র করেই। কারণ, প্রায় অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীরাই আলোচনা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ইংরেজি ভাষাকে অবলম্বন করে। কিন্তু আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলা ভাষা সম্পর্কে সেরকম মৌলিক ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ব্যাপকতা না থাকায়, বাংলা ভাষার স্বরূপ বিশ্লেষণ এখনও বিজ্ঞানসম্মত দৃঢ় ভিত্তি লাভ করতে পারেনি, বাংলা ভাষার বিভিন্ন প্রকাশ বৈচিত্র্যের বিশ্লেষণ তো দূরের কথা। ফলে, বাংলা সাহিত্যকে কেন্দ্ৰ করে শৈলীবিজ্ঞান প্রথম ও সঠিকভাবে বিজ্ঞানসম্মত পথে চলার সুযোগ খুঁজে পায়নি। কিন্তু এই ব্যাপারে যে সচেতনা দেখা দিয়েছে তা হয়ত ভবিষ্যতে আমাদের সামনে নতুন পথ খুলে দেবে।
Leave a comment