ইতিহাসের এক রক্তঝরা কলঙ্কময় অধ্যায় নিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রকে মানবীয় মহিমায় সমৃদ্ধ করে রচিত হওয়ার জন্য আলোচ্য উপন্যাসখানি সার্থক ঐতিহাসিক আলেখ্য রূপে পরিগণিত হতে পারে। মূলত ১৮৯৯–১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসীদের বিদ্রোহ যা বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল তা এই উপন্যাসের পটভূমি। যে মুণ্ডারা যুগযুগ ধরে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে জমি চাষ করে আসছিল, ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে জমিদার, ঠিকাদার, জায়গিরদার ও মহাজনের দল, যারা কিনা ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করত। তারা এই সমস্ত মুণ্ডা শ্রমিকদের উপর অকথ্য অত্যাচার করত। খ্রিস্টান পাদরিরা এইসময় তাদের আশ্বাস দিতে থাকেন। তবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুণ্ডাদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করা। শেষপর্যন্ত বাঁচার তাগিদে ১৮৯০ এর দশকে মুণ্ডা সর্দাররা আদালতে পরদেশী জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। কিন্তু ইংরাজ সরকার তাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করল না। এইসময় আবির্ভাব ঘটে মুণ্ডাদের ত্রাণকর্তা বীরসা মুণ্ডার। বীরসাকে নিজের ত্রাণকর্তা হিসাবে মনে করে তার আচার-আচরণে আকৃষ্ট হয়ে মুণ্ডারা দলে দলে তার নিকট জমায়েত হতে থাকে। মুণ্ডাদের কাছে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার চালানোর জন্য ইংরাজ সরকার বীরসাকে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দান করেন। দু’বছর পরে ছাড়া পেয়ে বীরসা আবার শুরু করে বিদ্রোহ। তার অরণ্যের অধিকার নিয়ে মুণ্ডাদের একত্রিত করে বিদ্রোহ করার ফলে ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে এবং কয়েকদিনের মধ্যে অকথ্য অত্যাচারে বীরসার মৃত্যু হয় কারাগারের মধ্যেই। আর তার সঙ্গীদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড ও কয়েকজনের যাবজ্জীবন হয়।

মূলত বীরসা আন্দোলন বা উলগুলান সম্পর্কিত ইতিহাস এরূপ তথ্য দান করে। ইতিহাসের কোনো ঘটনাকে অবিকৃত রেখে বর্ণনাভঙ্গি ও রচনা কৌশলের দ্বারা একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস গঠন করা সম্ভব। তার প্রমাণ মেলে মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ নামক উপন্যাসে। মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাসটির সূচনা অংশে বলেছেন— “এই উপন্যাস রচনায় সুরেশ সিং রচিত “The Storm and the Hanging Mist’ বইটির কাছে আমি সুবিশেষ ঋণী। সুলিখিত তথ্যপূর্ণ গ্রন্থটি ছাড়া বর্তমান উপন্যাস রচনা সম্ভব হত না।”

কে. এস. সিং ছোটোনাগপুরের আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণা কালে বীরসা মুণ্ডার বিদ্রোহী জীবনকাহিনি তাঁকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। তার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৬৬ সালে তিনি উক্ত গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন। এ থেকে সহজেই অনুমান করা চলে ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটি ইতিহাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। এখন দেখা যাক ইতিহাস এই উপন্যাসখানিকে কী তথ্য প্রদান করেছে।

‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে দেখা যায় আদিবাসীদের পর যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল তারা ছিল ‘দিকু’। এরা সাধারণত বিভিন্ন প্রদেশীয় ও বিভিন্ন জাতীয় মহাজন ও ব্যাবসাদার। এরা আদিবাসীদের বেগার খাটাত, ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলত, বেদম মারধোর করত, প্রতিবাদে মুখর আদিবাসীরা যদি সুবিচারের প্রত্যাশায় প্রশাসনের দ্বারস্থ হত সেখান থেকে সরকার ও দিকুদের অশুভ আঁতাতের ফলে বিতাড়িত হত। এর ফলে তাদের মনে দেখা দেয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, বিদ্বেষ আর ঘৃণা। এই ঘৃণা পুঞ্জীভূত হতে হতে যখন আগ্নেয়গিরির আকার নেয়, তখন তারা টাঙি, বর্শা, বলোয়া নিয়ে প্রশাসনের গুলির সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। সমালোচক জানালেন—“খাদ্য ও বাসস্থানের এই অনন্ত অভাবই আদিবাসী বিদ্রোহ ও সেই বিদ্রোহের জনক—এই প্রেক্ষাপটটি যথাযথ ও জীবন্তভাবে উপস্থাপিত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী।”

আসলে ষাটের দশকের শেষ থেকে মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসখানি রচনা করেন। এবং তা যে সম্পূর্ণ সত্যতা নিয়ে আলোচিত হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আদিবাসীদের স্বপ্নের পৃথিবী হল অরণ্যভূমি। “সে ধরিত্রিতে মহাজন নাই, দিকু নাই, সাহেব নাই।” কিন্তু তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল এই দিকুরা। “চেছ গ্রামে সুরজ সিং দিনান্তে এক থালা ঘাটো আর এক চেলা নুন, বছরে তিনটে খাটো কাপড় দিয়ে ওর জীবন মরণ কিনে নিয়েছিল।” ফলে ভাত ছিল মুণ্ডাদের একটা স্বপ্ন। কিন্তু বীরসার মনে প্রশ্ন জাগে—“মুণ্ডা শুধা ঘাটো খাবে কেন ? কেন সে দিকুদের মতো ভাত খাবে না।” এই ভাত রাধতে গিয়ে সে একদিন ধরা পড়ল ইংরাজদের হাতে। সমস্ত আদিবাসী মুণ্ডাদের মতো বীরসারও বাসনা ছিল পেট ভরে খাবার পাওয়া, মাথায় তেল মাখতে পাওয়া। কিন্তু তার বাবা সুগানার হতদরিদ্র সংসারে তা সম্ভবপর ছিল না। তাই সে মামারবাড়ি, পরে মাসির বাড়ি চলে আসে। সেখানে থেকে তার উপলব্ধি হয়—“খেতে না পেলে, পরতে না পেলে মানুষ বীরসার বাপের মতো কমজোরি আর ভীতু হয়ে যায়। তখন সবসময় মনে হয় আই আকা জড়ে কথা বলব না, যদি কেউ রেগে যায়। আবার খেতে, পরতে, মাখতে পারলে মানুষ জোনি মাসির মতো কমজোরি আর ভীতু হয়ে যায়। তখন মনে হয় আই আবা! চড়া কথা বলব না যদি সে সুখটুকু ঘুচে যায়।” আদিম আকাঙ্ক্ষার এই স্ববিরোধী সংকটটি পরবর্তীকালে বীরসার মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সে বিরোধ মূলত ভাতবিহীন জীবনের ক্রম অবক্ষয়ের প্রতিবিধান কল্পে ঔপন্যাসিক তাঁর চমৎকার লেখনী স্পর্শে উপন্যাসের মধ্যে এমনই ঐতিহাসিক সত্যটি ফুটিয়ে তুলেছেন।

উপন্যাসটির পটভূমি নির্মাণেও লেখিকা সম্পূর্ণরূপে ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন। ১৮৯৫–১৯০০ খ্রি. মধ্যে বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে আদিবাসী বিদ্রোহ এক ব্যাপক আকার ধারণ করে একথা ইতিহাস প্রমাণ করে। এবং এ ঘটনাও তা আদিবাসীদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এবং তাদের মধ্যে থেকে স্বতোৎসারিতভাবে উচ্চারিত হতে থাকে—“বীরসার মরণ নাই, উলগুলানের শেষ নাই।” এই ঐতিহাসিক সত্যটি উপন্যাসের মধ্যে প্রকট করেছেন। এছাড়া বীরসার সঙ্গে যে সমস্ত মুণ্ডা সর্দাররা অংশগ্রহণ করেছিল যেমন— গিডিয়ন, ইলায়াজার, প্রভুদয়াল এবং তৎকালীন ইংরাজ প্রতিনিধি যেমন—মী আর্স,‌ ফর্বসরোশ, স্ট্রিটফিল্ড প্রভৃতি নাম, এ উপন্যাসে সুপ্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ছোটোনাগপুর অঞ্চলের যে সমস্ত এলাকা জুড়ে এই আদিবাসী বিদ্রোহ চলেছিল যেমন তামার, চালকাড়, আথুভাতু, খুনটি এই উপন্যাসের পটভূমি রচনা করেছে। মুণ্ডারী সমাজ বিশ্বাস করত তাদের ত্রাণকর্তা তাদের ভগবান বীরসার কখনও পরাজয় হবে না। কিন্তু তাদের ভগবান বীরসা ধরা পড়েছিল গহণ অরণ্যে ক্ষুধায় কাতর হয়ে ভাত রাঁধতে গিয়ে। এই সকল ঘটনার প্রমাণ আমরা ইতিহাস থেকে পাই। তাই বলা যায় আলোচ্য উপন্যাসখানি যে ঐতিহাসিক উপন্যাস সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।

কোনো উপন্যাসকে ঐতিহাসিক উপন্যাস রূপে সার্থকতা অর্জন করতে গেলে তাতে যেমন ঐতিহাসিক ঘনটার প্রেক্ষাপট থাকতে হবে তেমনি তার চরিত্রের ঐতিহাসিকতা, তাদের সমাজের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ প্রভৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক সত্যটি ফুটিয়ে তুলতে হবে। আলোচ্য উপন্যাসের মধ্যেও সেই লক্ষ্যটি প্রকট হয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ দেয় বহু প্রাচীন বাদল মুণ্ডা সমাজের উপর বৈষ্ণব ধর্মের একটি সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল। এই ঘটনাটিও উল্লেখ আছে ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসখানিতে। তরুণ বীরসা মনের অস্থিরতায় দংশন থেকে মুক্তি পাবার জন্য আনন্দ পাঁড়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে ছুটেছিল। সেখানে এসে সে “পইতে নিল, চন্দন মাখল, তুলসী পূজা করল, রামায়ণ-মহাভারত সব শুনল, পড়লে কিছু কিছু।” এরপর মনে শান্তি না পেয়ে আবার ফিরে এল নিজের সমাজে সেখানে সে নিজেকে প্রতিস্থাপন করল নতুন ধর্মের প্রবক্তা রূপে। নিষেধাজ্ঞা জারি করল মুণ্ডা সমাজে প্রচলিত উৎসবগুলিতে। যেমন আদিবাসী পরব হোলিতে জাপি নাচগান, করম, মাগে, পাইকা নাচ, মহুয়া পান, যৌন সম্পর্ক প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিল বীরসার। বীরসার চরিত্রটি সম্পর্কেও আদিবাসী সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তবে তা খুব সংযমের সঙ্গে। ইতিহাসের বীরসা একাধিক নারীকে মোহগ্রহ করতে পারত। অনেক নারীর সঙ্গে তার প্রণয় স্থাপন হয়েছিল। উপন্যাসে এই রকম ঘটনা খুব সংযমের সঙ্গে উপস্থাপন হলেও ‘সালী’ ও ‘পরমী’-র কথপোকথনে বিষয়টি বিশেষভাবে উপলব্ধ হয়।

এতদসত্ত্বেও বলতে হয় বীরসার চরিত্র রূপায়িত করতে গিয়ে লেখিকা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিহাসকে পিছনে ফেলে স্বাধীন চিন্তা ভাবনার দ্বারস্থ হয়েছেন। বসন্ত সম্পর্কে বীরসার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ইতিহাস সত্যতাকে ব্যক্ত করে না। “সকলকে নিমপাতা ভিজে জল খাও, নিমপাতা জলে জলে সিজে সে জলে গা মুছ।” হয়তো মিশনারী শিক্ষা গ্রহণের বীরসার মনে এমনই বিজ্ঞান ভাবনার উদয় হয়েছে। কিন্তু তা আদিবাসীর ইতিহাসে সিদ্ধ নয়। তাছাড়া বীরসাকে লেখিকা জীতেন্দ্রীয় পুরুষ রূপে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আদিবাসী ইতিহাস প্রমাণ দেয় বীরসার সঙ্গে ছিল একাধিক নারীর প্রণয় সম্পর্ক। এ সম্পর্কে সমালোচক সুমিতা চক্রবর্তী জানালেন—বীরসার প্রণয় সম্পর্কজনিত দিকটিকে ও ইতিহাস সম্পর্কিত রূপে দেখালে কি বীরসা চরিত্রের মহত্ন কিছু কমে যেত? আমাদের তা মনে হয় না। বরং বাড়ত তার স্বাভাবিক মানবিক দিকটির আকর্ষণ। মানুষ ও নেতারূপে তার অন্তঃসংকট ও অন্তদ্বন্দ্ব দেখবার অবকাশ থাকত। চরিত্রটি হত আরও নাটকীয়।” তবে স্বীকার করতেই হয় সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও মুণ্ডা বিদ্রোহের ইতিহাসের মূল নির্যাসকে অপরিবর্তিত রেখে নায়কের আদ্যোপান্ত জীবনধারার এমনকি বর্ণনার মাধ্যমে লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের ঐতিহাসিক কাঠামোতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। তাঁর মহৎ সৃষ্টির মধ্যে যে ইতিহাসের তত্ত্ব ও তথ্যকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটিকে একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস বললে অত্যুক্তি হয় না।