মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ বীরসা মুন্ডার জীবনালেখ্য, বীরসা বিদ্রোহের ইতিহাস। বীরসার জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, সংগ্রামী জীবন খুব সুন্দর চিত্রের পরে চিত্র সাজিয়ে গড়ে উঠেছে ‘অরণ্যের অধিকার’। সেই বীরসার সংগ্রামী জীবন পর্বের উপাত্তে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার জীবনধারার উপর যবনিকা পতন ঘটছে এবং কাহিনি ধারায় সমাপ্তির রেশ ফুটে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লেখিকা ‘অরণ্যের অধিকারে’ বহু আড়ম্বরে বীরসার মৃত্যু দিয়ে তার জীবনের অন্তিম রেশ টানলেও নিজের কলম থামাননি, রচনা করেছেন উপসংহার। এই উপসংহার অংশটুকু মূল উপন্যাসের ক্ষেত্রে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বিষয় তা ভেবে দেখবার বিষয়। তাও আবার উপসংহার অংশটুকু অমূল্যের নোটবই আকারে প্রকাশ পেয়ে, সমস্যার জট পাকিয়ে তুলেছে। তবে এ উপসংহার রচনায় লেখিকার যে একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল সেকথা বলাই বাহুল্য। এখন দেখা যাক কোন প্রয়োজনে কথাকার উপন্যাসের শেষ অধ্যায় উপসংহারটি রচনা করেছেন।

ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় অবলম্বনে রচিত ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসখানি, যার সময়সীমা ছিল ১৮৯৫-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়ই সংঘটিত হয়েছিল সমগ্র ছোটোনাগপুর অঞ্চল জুড়ে স্বাধীকারের দাবিতে মুণ্ডা বিদ্রোহ তথা বীরসা বিদ্রোহ। সেই বীরসা বিদ্রোহের বাস্তব দলিল হল ‘অরণ্যের অধিকার’। অর্থাৎ এ উপন্যাসখানি ঐতিহাসিক উপন্যাস তবে একথা সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস কখনো ইতিহাসের হুবহু তথ্য নির্ভর গ্রন্থ নয়। ইতিহাসের মতো বীরত্ব, হত্যা, বিদ্রোহ, আন্দোলন উপন্যাসে স্থান পেলেও তার সঙ্গে যুক্ত হয় মানবিক গুণ। ঐতিহাসিক চরিত্রকে মানবীয় গুণে সমৃদ্ধ করে উপন্যাসের মধ্যে সৃজন করলে তবেই তা ঐতিহাসিক উপন্যাস। কাজেই ইতিহাসের মতো জননায়কের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসের কাহিনি চরিত্রের ক্রিয়াকলাপ থেমে যায় না। ফুটিয়ে তোলে এক বিষাদঘন মুহূর্ত। যে মুহূর্তটির জন্য পাঠক ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। অচিরেই ফুটে ওঠে অশ্রুকণা। ইতিহাসকে জেনেও পাঠ নেয় অমর জীবনের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের। একাত্মতা অনুভব করে। ভাবে তারা আমাদের মতো রক্তমাংসের মানুষ।

রাঁচি জেলের ছোটো খুপরির মধ্যে অসহনীয় নির্যাতনে বীরসার মৃত্যুর পর উপন্যাসে শেষ হলে হয়তো কোনো একটি থাকত না। কিন্তু মনের মাঝে কেমন একটা জিজ্ঞাসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে—বীরসার মতো বিদ্রোহী বীর এত সহজে আমাদের মন থেকে বিদায় নেবে ? মন উৎসুক হয়ে ওঠে কীভাবে সে মরল, তার মতো মুণ্ডা বিদ্রোহীর জন্য ইংরাজ সরকার কী কৌশল অবলম্বন করেছিল। তার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া মুণ্ডাদের মধ্যে কীরূপ হয়েছিল, এসব প্রশ্নের নিরসনের জন্য লেখিকা উপন্যাসের শেষে উপসংহার যুক্ত করেছেন। এই উপসংহারটি আসলে অমূল্যের নোটবই আকারে প্রকাশিত। জেলখানার ডাক্তার হয়ে বন্ধু বীরসার নিষ্ঠুর মর্মান্তিক মুহূর্তে মানসিক আঘাত পেয়ে চাকরি ছেড়ে, বীরসার আশৈশব বিচরণক্ষেত্র অরণ্যাণী অঞ্চলে গিয়ে ডুরান্ডা নদীর তীরে বসে ১৯০১ সালের শেষে এই নোটবইটি রচনা করেছিল। এই নোটবইটি পাঠ করলে সহজে বোঝা যায় উপন্যাসের চাবিকাঠি এই উপসংহার অংশের মধ্যে নিহিত। এখানে অমূল্য ও ব্যারিস্টার জেকবের মহৎ গুণগুলির সঙ্গে ফুটে উঠেছে প্রশাসনিক কর্তাদের বর্বর নির্যাতন। ডি.সি. স্ট্রিটফিল্ডের নিষ্ঠুরতা, ম্যাজিস্ট্রেটের অন্যায় বিচার প্রভৃতি চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে চমকিত হয়ে অমূল্য তার লেখনীর মধ্যে তুলে ধরেছে ইংরাজ সরকারের অত্যাচারের ইতিহাস।

বীরসা ধরা পড়েছিল ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। জেলের মধ্যে অসহ্য নির্যাতনে মারা গিয়েছিল ৯ জুন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। এই দীর্ঘ চার মাসের অধিক সময়েও সরকার পক্ষ থেকে কোর্টে কেস দাঁড় করাতে পারেনি। তাদের একটাই অজুহাত বীরসার অপরাধের তালিকা তৈরি এবং তদন্তে তারা নিমগ্ন। কিন্তু অমূল্য বুঝেছিল কী তার কারণ। তাই সে অশরীরী বীরসার প্রতি জানায়—“বিচারাধীন অবস্থায় তোমার মৃত্যুই ছিল অভিপ্রেত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেও তোমাকে জীয়ন্ত রাখতে হত। তোমার মৃত্যুই অভিপ্রেত ছিল। বিচারাধীন অবস্থায়।” তাই ঠিকমতো তাড়াতাড়ি বিচার হোক সরকার পক্ষ চায়নি। সরকার বুঝেছিল চার দেয়ালের মাঝে আলোবাতাস দেখতে না দিয়ে বিচারাধীন অবস্থায় মুণ্ডাদের নিঃশেষ করতে হবে। ফলশ্রুতি হিসাবে রাঁচি জেলে বিচার শেষ হওয়ার পূর্বেই বীরসাসহ কুড়িজন মুণ্ডা মারা যায়। মুণ্ডারা জানত না তাদের অপরাধ কী। তারা শুধু একুটু জানে—“ভগবান ডেকেছে মোরা সামিল হয়েছি। মোদের আদি অধিকার চেয়েছি। মোরা কুন দুষে দুষী নয় হে।” মুণ্ডারা তো সরকারের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুই বোঝে না। শুধু জেলখানায় বসে প্রশাসনের নির্মম প্রহার সহ্য করে আর তাদের ভগবানের নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রৌদ্রে হাতে পায়ে মোটা লোহার বেরি পরিয়ে সকালে খেতে না দিয়ে অসুস্থ বন্দিদের এভাবে জেলখানায় নিয়ে যাওয়ার অর্থ বিচারাধীন অবস্থায় যেন তাদের মৃত্যু ঘটে।

সুবিচার পাওয়ার আশায় মুণ্ডাদের আত্মীয়-স্বজন জেলখানায় আসলে জেল কর্তৃপক্ষ তাদের বলত—টাকা আন, খাবার আন, শুধু হাতে কেউ আসামি দেখতে আসে।” মুণ্ডাদের বাবা, মা, ভাই, বোনেদের তেমন ক্ষমতা ছিল না তবু তারা কষ্টেসৃষ্টে নিয়ে আসত। আর নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরত। ফেরার পথে বন্ধু ব্যারিস্টার জেকবকে বলত—“সাহেব গো আজও দেখতে দিল না। আর জেলের পুলিশরা মুণ্ডাদের কাছে বলত—“কেউ দেখতে আসে নাই তোদের। কেও খোঁজ নেয়না। নিজেদের বীরসাইত বলিস ? তোদের আপন জন সব বীরসার ধর্ম ছেড়ে দেছা।” নিরীহ মুণ্ডাদের সঙ্গে এমন হঠকারিতা সভ্যতার মুখে কলঙ্ক লেপন বলাই বাহুল্য। এরপর গভীর তদন্ত ও চিরুণি তল্লাসির পরে বিচারের নামে প্রহসন সৃষ্টি করে সরকার পক্ষ থেকে ৪৮২ জন মুণ্ডাদের মধ্য থেকে মাত্র ৯৮ জনের কেস দাঁড় করানো হয়। দলে দলে মুণ্ডা খালাস পেতে থাকে। অবশেষে ১৯০০ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যেমন—‘দি বেঙ্গলী’, ‘দি স্টেটসম্যান’-এর একজোটে যুদ্ধের ফলে একদিন মুণ্ডা রায়ট কেস শেষ হয়। ৯৮ জনের শাস্তি হয়। বাকি মুণ্ডাদের ৬৮ জনের শান্তি রক্ষা করে চলতে বলা হয়। ২৯ জন খালাস পায়। বিচারাধীন অবস্থায় ২০ জনের মৃত্যু ঘটে। আর সাজাপ্রাপ্ত মুণ্ডাদের মধ্যে গয়া মুণ্ডা, সানরে মুণ্ডা, সুখরাম মুণ্ডার ফাঁসি হয়। ৪০ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, পাঁচজনের সাত বৎসর কারাদণ্ড, ৫ বছর কারাদণ্ড হয় ৪ জনের। ৩ বছর হয় ৬ জনের এসব তথ্য আমরা উপসংহার থেকে পাই।

অমূল্যের নোটবই-এ অর্থাৎ উপসংহার অংশে ১৯০০ সালের ১৫ মে এর একটা ঘটনা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ২১৭ জন বিচারাধীন মুণ্ডার মধ্যে তিনজনের জামিনের জন্য ব্যারিস্টার জেকব দাবি জানান। জেকবের বক্তব্য ছিল—“ওদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আছে শুধু ডি.সি. স্ট্রিফিল্ডের রিপোর্ট, যে ওরা বিদ্রোহে জড়িত বলে অনুমান। ওদের বিরুদ্ধে কোনো একদিন না একদিন সাক্ষ্য পাওয়া যাবে বলে ওদের দীর্ঘদিন হাজতে রাখা হয়েছে। বহু বিচারাধীন বন্দি জেলে মারা গেছে।” ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে জেকবের বাকযুদ্ধ হুবহু কপি করা আছে অমূল্যের নোটবইয়ে। প্রতিলিপিটি পাঠ করে সরকার পোষিত ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিও তার বিচার পদ্ধতি সম্পর্কে একটা সুন্দর ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। আরও বিস্মৃত হতে হয় ইংরেজের সমগোত্রীয় হয়েও জেকবের এই জামিনকে কেন্দ্র করে লড়াই সমগ্র বাঙালি তথা আদিবাসীদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিল।

সর্বোপরি মুণ্ডাদের বিচার হয়ে গেলে অমূল্য জেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল ছোটোনাগপুরের আদিবাসী অঞ্চলে। সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিল দণ্ডপ্রাপ্ত মুণ্ডাদের আত্মীয় পরিজনদের দুর্দশা। অমূল্য দেখেছিল সালী তার ছেলে পরিবারকে নিয়ে স্বামী ডোনকাকে হারিয়ে কী দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছিল। করমি কীভাবে ডুরান্ডা নদীর তীরে বসে বীরসার জন্য অপেক্ষায় রত। সে গিয়েছিল চালকাড়, বোতোদিতেও। অর্থাৎ বীরসার মৃত্যুর পর সাজাপ্রাপ্ত মুণ্ডাদের সাজা হয়ে গেলেও তার পরবর্তী বিষাদজনক চরম কী মর্মান্তিক রূপ ধারণ করতে পারে তা উপসংহার অংশটুকু প্রমাণ দেয়। তাই সব মিলিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে হয় ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক যদি উপসংহার অংশটুকুর সংযোজন না করতেন তাহলে কেমন একটা অসম্পূর্ণতা, ত্রুটি পাঠকের মনকে কুরে কুরে খেত, সেটুকুর অবকাশ না দিয়ে উপসংহারের দ্বারা উপন্যাসটি সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।