“অরণ্যের অধিকার কৃষ্ণ ভারতের আদি অধিকার। যখন সাদা মানুষের দেশ সমুদ্রের অতলে ঘুমোচ্ছিল, তখন থেকেই কৃষ্ণ ভারতের কালো মানুষেরা জঙ্গলকে মা বলে জানে।”
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আদিবাসীরা এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। পূর্বভারতের ছোটোনাগপুর অঞ্চলের এই আদিবাসীরা যারা কোল, ভীল, সাঁওতাল মুণ্ডা, ওঁরাও, হো বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে বসতি স্থাপন করেছিল, তাদের মধ্যে ধূমায়িত হয়েছিল বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। হয়তো সভ্য সমাজের মানুষের মতো তাদের ছিল না কোনো শিক্ষা দীক্ষা, জানতো না। কোনো আদব কায়দা। তথাপি তাদের স্বাজাত্য বোধ সম্পর্কে তারা ছিল বেশ সচেতন। কিন্তু সভ্য জগতের সুচতুর মানুষের নজর পড়ল এই সকল নিরীহ সহজ সরল মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর। একে একে তারা অর্থের বিনিময়ে আদিবাসীদের অরণ্যভূমিকে গ্রাস করতে থাকে। বিশেষত আদিবাসী অঞ্চল ইংরাজ সরকারের নিকট হস্তান্তরিত হওয়ার পর আদিবাসীরা হারাতে থেকে তাদের স্বভূমি। তারা প্রতিবাদ করেও সুবিচার পায় না। কেউ কর্ণপাত করে না তাদের মর্মবিদারক হাহাকারের প্রতি। কিন্তু থামলে তো চলবে না। অসহনীয় যন্ত্রণায় তারা প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। সরকারি তৎপরতায় তাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দমন করা হয়। তবে আন্দোলন বিদ্রোহ যে থেকে থাকে না তা স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে লক্ষিত হয়। আদিবাসীদের এমন বহু বিদ্রোহ যা ইতিহাসের পাতায় ‘আদিবাসী বিদ্রোহ’ নামে সুপরিচিত। এমন এক বিদ্রোহ হল ‘মুণ্ডা বিদ্রোহ’ যার নেতৃত্বে ছিল অসম সাহসী বীরসা মুণ্ডা। এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৯৫-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে। ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতাদেবী তাঁর “অরণ্যের অধিকার” উপন্যাসে তুলে ধরলেন এই বিদ্রোহী বীর বীরসা মুণ্ডার সংগ্রামের ইতিহাস।
গরীব ঘরের চাষা পরিবার জন্মেছিল বীরসা মুণ্ডা। বাবা সুগামা মুণ্ডা, মা করমি। আশৈশব হতে ভাতের মুখ দেখেনি। খাদ্য বলতে ছিল ঘাসের দানা সেদ্ধ যাকে তারা ঘাটো বলত। তবুও তার অদম্য ইচ্ছা ছিল জীবনে বড়ো হবে। তাই তো বাড়ি ছেড়ে প্রথমে মামাবাড়ি, তারপর মেসের বাড়ি, তারপর বুরজুর জার্মান মিশনে লোয়ার প্রাইমারী শিক্ষা সমাপ্ত করে চলে আসে চাইবাসার খ্রিস্টান মিশনে।
মিশন থেকে ফিরে বীরসা কেমন মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিল। মানসিক সুস্থিরতা ফিরে পেতে সে ছুটে গিয়েছিল বন্দগাঁও বৈঘ্নব সেবাইত আনন্দ পাঁড়ের কাছে। সেখানে— “পইতে নিল, চন্দন মাখল, তুলসী পূজা করল। রামায়ণ মহাভারত পুরাণ সব শুনব, পড়ল কিছু কিছু।” কিন্তু এত করেও সে মনে আনন্দ ফিরে পায় না। দীর্ঘ দিন ধরে যে অরণ্যভূমিকে মুণ্ডারা নিজেদের মাতৃভূমি, জন্মভূমি বলে জানতো সেই অরণ্য ভূমি থেকে সরকার তাদের উৎখাত করতে ব্যস্ত। স্বাভাবিক ভাবেই মনের মাঝে ভেসে ওঠে প্রতিবাদী ভাষা। বীরসা গর্জে ওঠে—’না! অর্থাৎ তাঁর অরণ্য জননীকে সে এভাবে বিদেশি শয়তানের কাছে নির্যাতিত হতে অধিকার কৃষ্ণ ভারতের আদি অধিকার। যখন সাদা মানুষের দেশ সমুদ্রের অতলে ঘুমোচ্ছিল, তখন থেকেই কৃষ্ণ ভারতের কালো মানুষরা জঙ্গলকে মা বলে জানে।”
কিন্তু বীরসা নিঃস্ব রিক্ত দরিদ্র সন্তান। কীভাবে সে দিকু সরকারদের তাড়িয়ে অরণ্য জননীকে মুক্ত করবে। কি প্রকারে ধর্ষিতা অরণ্যকে সে নিষ্কলুষ করবে। অরণ্য জননীর কাছ থেকে নির্দেশ আসে—“ধরতি আবা হতে হবে। ধরতির বাপ না বলে ধরণীর লাজ ঢেকে দিতে পারে কে ?” বীরসার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল। সমগ্র আদিবাসী অঞ্চল জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল বীরসার বাণী—’নগ্নিকা, ধর্ষিতা অরণ্য জননীর অশ্রুমোচন করতে হবে।
সংগ্রামের ডাক দিয়ে বীরসা মরিয়া হয়ে উঠল, কারণ, তার আজানা ছিল না—অরণ্য জননীকে বিদেশি, দিকুদের হাত থেকে উদ্ধার করা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। সকল মুণ্ডারীকে এক ধরতে হবে। শুধু অবতার হয়ে মুণ্ডাদের মোহাবিষ্ট করে রাখলে চলবে না উপযুক্ত বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তবেই অরণ্য জননীর ক্রন্দন মোছাতে হবে। কিন্তু মন তার অশান্ত। প্রতিনিয়ত শুনতে পায় অরণ্য জননীর কথা—“শুচি-শুচি হব আমি।” বীরসার অন্তরে রক্তের তীব্র ধারায় যে অনুভব করে অরণ্য জননীকে—“নগ্নিকা মুণ্ডারী যুবতীর মতো তার কৃষ্ণ জননী—আদিম আরণ্যক কাঁদছিল আর বলছিল, বেবস্ত রবনা আমি। ওরা আমার লাজ লজ্জা কেড়ে লয়ে লেংটা করে আকাশের দিকে দাঁড় করায়ে দিয়েছে।” বীরসা বুকের সন্তানের মতো অরণ্য জননীর কণ্ঠে শুনেছে, তার আর্ত ক্রন্দন অরণ্য মা কাঁদতে কাঁদতে বলছে—“মোর বুকে আজো ক্ষীর আছে, তবু মোর সন্তানদের বেরাগী করে রেখে দিল ওরা, এমন কপাল।” বীরসা অরণ্য জননীর যোগ্যতম সন্তান। মায়ের অপমান ঘোচাতে সে ছাড়া আর কেউ পারবে না। কাজেই তারই নেতৃত্বে দিকে জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। কিন্তু প্রশাসক মহল থেকে থাকল না, উদ্ধৃত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সরকার বীরসাকে বন্দি করল, এবং দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল।
দীর্ঘ দু’বছর পর ১৮৯৭ সালের নভেম্বরে বীরসা মুক্তি পেল। রাঁচির জেল থেকে স্বভূমি চালকাড়ে আসতে আসতে বীরাস দেখল বৃষ্টির অভাবে চারিদিক জ্বলে খাক হয়ে গেছে, ঘরে ঘরে অভাব আর অনটন। তাই জেল থেকে মুক্ত হবার পর আর প্রকাশ্যে নয় গোপনে বীরসা সভা করে চলল। যে সভার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নির্ধারণ করা। সালীর বাড়িতে বসল প্রথম সভা, সেখানে ঘোষিত হল—“এখন আর ধিমা ধিমায় কাজ হবে না। আগে মোরা একসঙ্গে সকল কাজ করব। লড়াই শিখা, নানক যোগাড়, পঞ্চায়েত, ঘাঁটি তৈরি, রসদ জোগাড় সকল কাজ চলবে। কিন্তু মোরা মোদের পুরানো দখল পেতে চাই। পুরানো দেবস্থানই চাই। তাই চুটিয়া আর জগন্নাথপুরের মন্দির কেড়ে নিব। মুণ্ডাদের আদি রাজধানী নত্তরতনগড়ের কেল্লা হতে জল আনব মাটি আনব! দখল নিব।” আসলে অরণ্য আর বীরসা এক সত্ত্বার দুইরূপ। অরণ্য জননীর অপমানিতা কণ্ঠস্বর যখন স্ফুরিত হয় তখন তো তা বীরসার উদ্দেশ্যেই—“করমির মতো, অবোধ মুণ্ডা মায়ের মতো, অরণ্যভূমি বীরসাকে গুণ গুণ করে সান্ত্বনা দিচ্ছিল।” অরণ্যের এ সান্ত্বনা বীরসা পেয়েছিল জেল থেকে ফিরে পুনরায় বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে, বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ইংরাজ সৈন্যের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে সেনত্রার জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকাকালীন। অরণ্যের পাতার মর্মরে, বাঘের ভয়ে চলাফেরার বীরসা তবে অরণ্য জননীর ওপর অধিকার ফিরিয়ে দিতে। তবে স্নেহময়ী অরণ্য জননী তাকে বলতে ভোলেনি—“তুমি তো চেয়েছিলে বাপ। তুমি তো জানতে না সকল তোমার হাতে নাই। আমি এক বনভুইটা কি আমার আছি ? যখন তোমার পিতা পুরুষ আচোটা জঙ্গলে গাছ কেটে আবাদ করে তখন আমি ছিলাম। তা বাদে মুণ্ডার হাত হতে দিকুর হাতে, দিকুর হাত হতে সরকারের হাতে কিনা বিচা, বিচা কেনা হতে হতে আমি তোমার আদি জননী, অশুচিয়া গিয়াছি বীরসা। তোমার কোনো দোষ নাই বাপ।”
বীরসা তার অরণ্য জননীর অধিকার নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রথম দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ফিরে এসে তারপর ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে পুনঃ ধৃত হয়ে বন্দগাঁও, তারপর খুনটি, তারপর রাঁচি জেলে এসেছিল। এই রাচি জেলে অকথ্য অত্যাচার নির্যাতনে রক্তবমি করে মৃত্যুবরণ করে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন। সরকারি রিপোর্টে বলা হয় বীরসা কলেরায় মারা গেছে। মৃত্যুর আগে জেলখানায় যখন সে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল তখন তার মনে হয়েছিল অরণ্যের মাঝে আত্মগোপন করে থাকাকালীন একটু ভুলের জন্য সে ধরা পড়েছে। কিন্তু সে যে উলঙ্গলানের ডাকে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চলেছে। তার তো মরণ নেই। কারণ “উলগুলানের আগুনে জঙ্গল জ্বলে না, মানুষের হৃদয় আর রক্ত জ্বলে। সে আগুনে জঙ্গল জ্বলে না। জঙ্গলে নতুন করে মুণ্ডা মায়ের মতো, বীরসার মায়ের মতো, জঙ্গলের সন্তানদের কোলে নিয়ে বসে। তাইতো বীরসা অরণ্যের অধিকার চেয়েছিল।” কিন্তু দিকুদের হাত থেকে বীরসা তার অরণ্য জননীর অধিকার আদায় করতে না পেরে চিরতরে বিদায় নিলেও সকলে এই স্থির জানলো—“উলণ্ডলানের শেষ নাই। ভগবানের মরণ নাই।” অর্থাৎ যুগে যুগে প্রবঞ্চিতদের কখনও কণ্ঠ রোধ করা সম্ভব নয়। বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ চলতেই থাকবে।
লেখিকা মহাশ্বেতাদেবী তাঁর অরণ্যের অধিকার উপন্যাসের নামকরণ করেছেন, মূলত বীরসা মুণ্ডাকে মধ্যমণি করে। যে বীরসা মুণ্ডা তার জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল মুণ্ডা জাতির উদ্ধার কল্পে। রক্ত মাংসদেহী মনুষ্য জননীর গর্ভে মুণ্ডাদের জন্ম হলেও অরণ্য জননীই তো তাদের পালিতা জননী। তার উদ্ধারকল্পে বীরসার নেতৃত্বে সমগ্র মুণ্ডা জাতি বিদ্রোহের সামিল হয়ে ছিল এবং এই বিদ্রোহের উজ্জ্বল আলেখ্য ‘অরণ্যের অধিকার’। কাজেই উপন্যাসের নামকরণ যে যথাযথ হয়েছে তা মানতেই হয়।
Leave a comment