‘সুভা’ গল্পটি চরিত্র প্রধান হলেও এটি মূলত ভাব-ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পরাজির মধ্যে এ গল্পের অনন্যতা বিশেষভাবে স্বীকৃত। চরিত্র অনুযায়ী গল্পের নামকরণ হলেও বিভিন্ন ভাবধারা এর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যেমন পোস্টমাস্টার, অতিথি, একরাত্রি গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের এই বাস্তব জীবনকে ছাড়িয়ে একটা অন্তর্লোকের আহ্বান পাই একটা অতিরিক্ত ভাবের দ্বারা আমাদের মন-প্রাণের সমস্ত গণ্ডিকে ভেঙে তছনছ করে দিয়ে বিশেষ একটা সর্বকল্যাণময় দিকের প্রতি মনোনিবেশ ঘটায় ‘সুভা’ গল্পটি তার ব্যতিক্রম নয়। বহু বিস্তৃত মানব জীবনের দুচারিটি অশ্রুজল নিয়ে লেখক তাঁর ছোটোগল্পের কাঠামোকে নির্মাণ করলেও প্রতিটি মানব জীবনের অন্তর্বহস্যকে উদ্ঘাটন করেছেন সে কথা মেনে নিতে আমাদের কোনও সংশয় থাকতে পারে না। ছোটো ছোটো আয়তনে জগৎ ও জীবনকে চরম সত্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলেই বোধহয় এই গল্পগুলি এত উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। একমুখীনতা, নাটকীয়তা, ব্যঞ্জনাধর্মীতা যদি ছোটোগল্পের শিল্প বিচারে মৌল বিষয় হয়ে থাকে ‘সুভা’ গল্প ও চরিত্রটি নিখুঁত নিটোল সর্বোপরি সৌন্দর্যের মহিমায় উত্তীর্ণ হয়েছে তা বলা যায়।
বাণী কণ্ঠের সুভাষিনী নামে একটি বোবা মেয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল। বড়ো দুই মেয়ে সুকেষিনী ও সুহাশিনীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বোধহয় তার ছোটো বোবা মেয়েটির নাম রেখেছিলেন সুভাষিনী। দুটো মেয়েকে খুব সুন্দর অথচ ভালো পাত্রের হাতে অর্পণ করেও সুভাষিনীর জন্যে বাণীকণ্ঠের মনে কেমন বিষাদ চেপে রইল, যেহেতু সুভাষিনী বোবা—তাই “পিতা-মাতার নীরব হৃদয় ভাবের মতো বিরাজ করিতেছে।” সুভা যখন একটু একটু করে বড়ো হতে থাকলো, যখন যে ভালোভাবে বুঝতে শিখল তখন নিজের এই বোবা হয়ে জন্মানকে বিধাতার অভিশাপ হিসাবে মেনে নিল। সবার মাঝে থেকে অথচ কথা না বলতে পারার হাস্যম্পদ হওয়ার চেয়ে নিজেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে এগিয়ে দিল। একেবারে আপন এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আত্মগোপন এবং সকলের দৃষ্টির অন্তরালে নিজেকে রেখে নিজের দুঃখতে মন্থন করতে সচেষ্ট হল। নিজেকে সবার অলক্ষ্যে রাখলেও তার জন্যে পিতার মাতার একটা অসহ্য বেদনা আছে সেটা তো সে ভুলতে পারে না। বিশেষ করে তার প্রতি মায়ের যে অনাদর—“মেয়ের অসম্পূর্ণতাকে তিনি নিজের গর্ভের কলঙ্ক জ্ঞান করিয়া তাহার প্রতি বড়ো বিরক্ত ছিলেন।” মায়ের এই মনোভাব মূলত মনস্তাত্ত্বিক প্রসূত।
সুভা বোবা হয়ে জন্মানোর জন্যে বাবা মায়ের কাছে অশান্তির বোঝা হয়ে থাকা, বিয়ে না হওয়ার দরুণ তার প্রতি বাবা মায়ের অনাদর পরিশেষে তার প্রতি করুণা করা সুভা মনে মনে আপন ভাগ্যকে দোহাই দিত। সে তো আর পাঁচটা ভালো মেয়ের মতো জন্মগ্রহণ করতে পারতো, তাদের মতো ভালো পাত্রের সাথে বিবাহ হতে পারতো ? কিন্তু বিধাতার নির্মম অভিশাপে সবথেকে সে বঞ্চিত। সুভা চরিত্রের অন্তর্লোকের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে দেখা যাবে বারে বারে এই দুঃখ বেদনা তার হৃদয় সাগরে মথিত হচ্ছে। ‘সুভার কথা ছিল না, কিন্তু তাহার সুদীর্ঘ পল্ব বিশিষ্ট বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ ছিল এবং তাহার ওষ্ঠাধার ভাবের আভাস মাত্রে কবি কিশলয়ের মতো কাঁপিয়া চলিত।” সুখে দুঃখে অনুভবের প্রবল তাড়নায় অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য তার এই ওষ্ঠ কম্পন ছাড়া আর কোনও ক্ষমতাই ছিলনা সমস্ত বিষয়কে পরিষ্কার করে জানানো। তার এই ভাব প্রকাশ কখনো ছিল স্পষ্ট, কখনো ছিল প্রচ্ছন্ন আবার কখনো ছিল গভীর বেদনায় উদ্বেলিত। বিশেষ কৌশলে গল্পকার এই পর্বে সুভার মুখচ্ছবি কে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন—ম্লান ভাব, ক্রোধান্বিত ভঙ্গিমা, কখনো বা অস্তমান চাঁদের মতো নিমেষহীন ভাবে চেয়ে থাকা, কখনো চঞ্চল বিদ্যুতের মতো আলোকজ্জ্বল হয়ে ওঠা ইত্যাদি। যখন নিজের কথা ভেবে একাকী কাল যাপন করত তখন নির্জন দুপুরের শব্দহীন উদাসীনতার মতো সে উদাসীন এবং সঙ্গীহীনতার মতো থাকত।
সুভার এই নীরবতাকে লক্ষ্য করে সাধারণ ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে মিশতে ভয় পেত। প্রতিবেশীরা তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখত, এর ফলে সকল সংস্পর্শ কাটিয়ে সুভা ছুটে যেত নির্জনে। ভালোদের কাছ থেকে একটা দূরত্ব তৈরি করে সে প্রকৃতির মতই বোবা হয়ে কাল যাপন করত। চণ্ডীপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে চয়ে যাওয়া গ্রাম লক্ষ্য স্রোতস্বিনীর সঙ্গে মানুষের যে নিবিড় যোগ ছিল, সুভা বোবা হলেও এই নদীর সঙ্গে তার সক্ষতা ছিল ভিন্ন ধরনের। নদীটির গতিপ্রবাহ ছিল বাণীকণ্ঠের গৃহের প্রান্তসীমায়। তাই সুভা অবকাশ পেলে ছুটে যেত নদীর কাছে। নদীর তীরে বসে সিবাসয়েই সে যেন অনর্গল ভষায় কত কথা বলে যেত। আর নীরব স্রোতার মতো শুনে যেত স্রোতস্বিনী। নদীর জল কল্লোল ধ্বনি, মাঝির গান, পাখির ডাক সমস্তই যেন বালিকার চির নিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে …ঝিল্লি রব পূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত ভঙ্গি, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘনিশ্বাস।” লেখক প্রকৃতির এই অনুপম বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে বোবা মেয়ে সুভার প্রকৃতি কী আশ্চর্যভাবে নির্মাণ করেছেন। তবে গোয়ালের দুটি গাভী সর্বশী ও পাঙ্গুলি বোবা মেয়ে সুভার ভাষা বুঝতো। তার আদর, অনুরাগ ভর্ৎসনা কে স্বচ্ছন্দে এই দুই মুক প্রাণী অনুভব করতে পারত। যে বোবা মেয়ে দুঃখের সঙ্গী হতে প্রকৃতিদেবী দুহাত বাড়িয়ে মুক পশুরা আহ্বান জানায় অথচ আশ্চর্যের বিষয় সংবেদনশীল মানুষের জগতে বাস করেও সুভা সেই মানুষদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল তাকে কেউ বুঝতে চেষ্টাও করলো না।
যদি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়, চরিত্র-রহস্যের উদ্ঘাটন হয়, তাহলে বলতে হয় সুভা চরিত্র পরিস্ফুটনে লেখক যে সমস্ত কৌশল অবলম্বন করেছেন তা সম্পূর্ণ রূপে যথাযথ হয়েছে। দুটি গাভীর ন্যায় আরও দুটি ছাগল ও বিড়াল শাবক ছিল সুভার নিত্য সঙ্গিনী, তবে গাভীর মতো এই শাবক দুটি তার বিশেষ পছন্দের না হলেও এরা সে নিত্য সাথী ছিল একথা স্বীকার করতেই হয়। অনেক সময় বিড়াল শাবকের গলা ও পিঠে কোমল আঙুল বুলিয়ে না দিলে তার ঘুম আসতো না। এ সমস্ত দেখে সুভা চরিত্র সম্পর্কে দুটি বিষয় বলা আবশ্যক, সুভা মনুষ্য সমাজ ও সংসারের অধিবাসী হয়েও সর্বদা সঙ্গীহীনা ছিল। যার জন্য সময় পেলে তাকে ছুটে যেতে হত নদীর ধারে। নির্জন নিস্তব্ধ মধ্যাহ্ন তাকে সঙ্গ দিত। দ্বিতীয়ত মানুষের সান্নিধ্য নয় গাভী, বিড়াল ছাগল ছিল সুভার প্রাত্যহিক জীবনের ভাব বিনিময়ের নিত্য সঙ্গী।
পরবর্তী পর্যায়ে সুভা চরিত্রের মধ্যে ভিন্নতর একটা বৈশিষ্ট্যের সন্ধান মেলে। নদীতীরে প্রায় গিয়ে বসে থাকার দরুণ সেখানে ছিপ ফেলায় রত গোসাইদের ছোটো ছেলে প্রতাপের সঙ্গে সুভার একটা সু-সম্পর্ক রচিত হয়ে যায়। প্রতাপ আদর করে সুভাকে মর্যাদার সঙ্গে সু’ বলে ডাকে, আর সুভা তার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিদিন তার জন্যে একটা করে পান সেজে এনে দেয়। প্রতাপের সঙ্গে সুভার এই মানবিক সম্পর্ক সুভার জীবনে বয়ে আনে এক অনাস্বাদিত আনন্দ, সুভা তাতে পরম প্রীত।
এমনি এক মুহূর্তে সুভা যৌবনে পদার্পণ করল—“ক্রমে সে যেন আপনাকে আপনি অনুভব করিতে পারিতেছে যেন কোনও একটা পূর্ণিমা তিথিতে কোনও একটা সমুদ্র হইতে একটা জোয়ারের স্রোত আসিয়া তাহার অন্তরাত্মাকে এক নূতন অনির্বচনীয় চেতনা শক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছে।” বোবা মেয়ের পক্ষে এ ভাবের প্রকাশ ঘটানো অসম্ভব। এদিকে বাবা-মা তাদের বোবা মেয়ের বিবাহ উপলক্ষ্যে কলিকাতা যাত্রার জন্য যখন তৈরি হচ্ছে তখন প্রতাপের কাছে বিদায় নিতে গেলে সুভাকে সে বলে—তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস? দেখিস আমাদের ভুলিসনে।” তাতে সুভার নীরব মর্মবাহু তার নির্মিমেষ ক্ষেত্রে অশ্রুপতন, হয়তো সে প্রতাপকে ভালোবেসে ফেলেছিল। গাভী দুটির কাছে শেষ বিদায় নিয়ে নদীতীরে এসে লুকিয়ে কাঁদতে থাকে—“তুমি আমাকে যাইতে দিও না মা, আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখ।” বোবা মেয়ের এই কাতর উক্তি শুধু তার একার নয়—আমাদেরও কথা।
কলিকাতায় যথাকালে পিতা মাতার জাতপাত সম্ভ্রম, পরকাল রক্ষা করে সুভার বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু সদ্য বিবাহিত বর অচিরেই যখন আবিষ্কার করলো তার—“নববধু বোবা” পিতা-মাতা প্রতিবেশীর ন্যায় সুভা শ্বশুরবাড়িতে অবহেলিতা হয়েই রইল। ফলত সুভার হৃদয় ‘অসীম অব্যক্ত ক্রন্দনে পরিপূর্ণা’ হয়েছিল তা—একমাত্র অন্তর্যামী ছাড়া আর কেহ শুনিতে পাইল না।” যে দুঃখিনী হয়ে সুভা পৃথিবীর প্রথম আলো দেখেছিল সেই দুঃখিনী হয়ে পৃথিবীর সেই আলোটুকু দেখতে দেখতে পরবর্তী জীবনটা কাটাতে হবে, তাছাড়া তার আর অন্য গত্যন্তর নেই। সে যে বোবা বিমাতার অভিশাপই তার জীবনের পরম শ্রেয়। অন্য কিছু সুখের কথা ভাবার অধিকার তার নেই। তাই তো—“এবার তাহার স্বামী চক্ষু এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা পরীক্ষা করিয়া এক ভাষা বিশিষ্ট্য কন্যা বিবাহ করিয়া আনিল।”
পরিশেষে বলতে হয় গল্পের প্রথম হতে সুভা সম্পর্কে যে তথ্য লেখক দিয়েছিলেন—তা গল্পের শেষাংশ পর্যন্ত অটুট আছে তা জানাতেই হবে। লেখকের যে মুখ্য উদ্দেশ্য, সুভা বোবা হওয়ার দরুণ আত্মীয়-পরিজনের কাছে অবহেলিতা কিন্তু জগতের যারা সৌন্দর্যের প্রতিভূ বিশাল প্রকৃতি রাজ্য, নদ-নদী, নির্জন দুপুর, মুক বধির পশুকুল সবাই সুভার চির আপন। তারা মনে প্রাণে সুভার দুঃখের কথা জেনেছে বুঝেছে এবং সহমর্মিতা দেখিয়েছি, কিন্তু যে মানুষ সবার শ্রেষ্ঠ জীব তাদের কাছে সুভা কোনও মর্যাদাই পেল না। বাবা-মা প্রতিবেশির নিকট লাঞ্ছত হওয়ার পর শেষে স্বামী কর্তৃক তিরস্কৃত হয়ে সুভা বোধহয় নিজেকে সঠিক ভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছে, এ সমাজ সংসারে সে কথা বলতে না পারায় উপযুক্ত মর্যাদা পাওয়া তার হল না।
Leave a comment