“আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে”— ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকাতে উচ্চারিত এই উক্তি থেকে কবি জীবনানন্দের সজাগ মনোভাব আমরা বুঝি, কিন্তু পাই না এ ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়ার কোন স্পষ্ট প্রমাণ।

জীবনানন্দ দাশের জন্ম ও কর্মজীবন:

কবি জীবনানন্দের ব্যক্তিগত স্বভাব সম্বন্ধে যে স্বল্প তথ্য তাঁর পরিচিতজনেরা জানিয়েছেন (যেমন ‘জীবনানন্দ স্মৃতি’ গ্রন্থে বাণী রায়, সুবোধ রায়, ‘মানুষ জীবনানন্দ’ গ্রন্থে লাবণ্য দাস, ‘কালের পুতুল’ বইতে বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ) তাতে জানতে পারি, জীবনানন্দ ছিলেন মিশুকে মানুষ, কিন্তু যতদূর সম্ভব কোণচর, সভা সমিতি ইত্যাদি এড়িয়ে চলার পক্ষপাতী। কবির জন্ম হয় পূর্ববাংলায় বরিশাল শহরে ১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারী। পিতার নাম সত্যানন্দ, মা সে যুগের এক খ্যাতিমান লেখিকা কুসুমকুমারী দেবী। ছোট ভাই অশোকানন্দ ছিলেন কবির ছেলেবেলায় হা-ডুডু, কুস্তি, মার্বেল খেলার সঙ্গী। মায়ের কণ্ঠে ব্রাহ্মসংগীত আর বাবার গলায় উপনিষদের মধুময় শ্লোক শুনে কবির শৈশবের আনন্দময় পরিবেশ গড়ে ওঠে। শিক্ষা শুরু হয় ব্রজমোহন স্কুলে। বাংলা, ইংরেজি উভয় ভাষাতেই কবিতা রচনার সূচনা স্কুল থেকেই। কবি ছবিও আঁকতেন। ১৯১৫ খ্রীস্টাব্দে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপরে ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই. এ. পাশ করে ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন এবং ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি. এ. পাশ করেন। ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় বিভাগে এম. এ. পাশ করেন। অসুস্থ থাকার জন্য পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয়নি।

পূর্ববঙ্গে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে জীবনানন্দ অধ্যাপনা করেন। কর্মসূত্রে বারংবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়। কোনদিনই কর্মক্ষেত্রে কবির জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি। বিভিন্ন কলেজ ও পত্রিকা অফিসে অধ্যাপক এবং সহ-সম্পাদক রূপে কাজ করেছেন। অধ্যাপনা করেছেন কলকাতার সিটি কলেজে (দু’বছর), খুলনা জেলার বাগের হাট কলেজে (তিন মাস), দিল্লীর রামযশ কলেজে কিছুকাল। এছাড়া ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর স্ত্রী লাবণ্যদেবী সহ কলকাতায় চলে আসেন। ফলে বেকার হয়ে যান। কয়েক মাস পরে স্বল্প বেতনে বন্ধুবর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সহায়তায় ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় রবিবারের সাহিত্যবিভাগে সম্পাদকের চাকরী গ্রহণ করেন। পত্রিকাটি অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেলে চরম অর্থসংকটে পড়েন। তারপরে খড়গপুর কলেজে চাকরী করেন কিছুদিন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী লাবণ্যদেবী অসুস্থ হয়ে পড়ায় কলকাতায় চলে আসেন কবি। শেষে হাওড়া গার্লস কলেজে মাসিক একশ পঞ্চাশ টাকা বেতনে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। গোপালচন্দ্র রায় এই চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে কবিকে সহায়তা করেছিলেন। এখানে তিনি ছাত্র-অধ্যাপক সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর কারণ সিগনেট প্রেস তাঁর প্রথম কাব্য ‘বনলতা সেন’ প্রকাশ করে। কবিরূপে জীবনানন্দের খ্যাতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর অশ্লীলতার অভিযোগ এনে জনৈক কর্তৃপক্ষ কবিকে কলেজের চাকরী থেকে বরখাস্ত করেন। স্বল্পবাক্, আত্মপ্রচারে বিমুখ কবি ছিলেন কিছুটা নির্জনতাকামী। ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দের ১৪ই অক্টোবর কলকাতায় আনমনে পথ চলার সময় ট্রামের ধাক্কায় কবি গুরুতর আহত হন। ২২শে অক্টোবর তার মৃত্যু হয়।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ:

‘ঝরা পালক’ (১৯২৭), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮), ‘রূপসী বাংলা’ (রচনাকাল ১৯৩২; পরিবর্তিত সংস্করণ ১৯৫২), ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১), ‘আমিষাশী তরবার’ (১৯৬৯), ‘সুদর্শনা’ (১৯৭৩)।

জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস:

‘মাল্যবান’ (১৯৭৩), ‘সুতীর্থ’ (১৯৭৭), ‘জলপাইহাটি’ (১৯৮১)। এইগুলি কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় নি। পরে দেবেশ রায়ের সম্পাদনায় ‘জীবনানন্দ সমগ্র’ (১ম ও ২য় খণ্ড ১৯৮৫) প্রকাশিত হয়।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধগ্রন্থ:

‘কবিতার কথা’ (১৯৫৫)।

জীবনানন্দ দাশের কাব্য-বিশ্লেষণ:

জীবনানন্দের কাব্য-বিশ্লেষণে দেখা যায় ‘নির্জনতা’র অনুভব জেগে ওঠে তাঁর কবিতায় কয়েকটি বিশিষ্ট চেতনায় প্রথমত, স্বপ্নের প্রসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্নতাবোধে; দ্বিতীয়ত, মৃত্যুচেতনায়; তৃতীয়ত, প্রকৃতি-প্রসঙ্গ; চতুর্থত, চিত্রকল্প সন্নিবেশে।

ঘুম এবং স্বপ্ন : ঘুম এবং স্বপ্নের প্রসঙ্গ জীবনানন্দের কবিতায় যে বারবার এসেছে একথা তাঁর প্রথম কবিতা পাঠকের কাছেই প্রায় ধরা পড়ে। দৃষ্টান্ত দিয়ে ভারাক্রান্ত না ক’রেও দেখা যায় ‘স্বপ্নের হাতে’ ধরা দিতে চেয়ে কবি জানান : “এখানে চকিত হ’তে হবে নাকো ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়।” কারণ উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়, মানুষের আয়ু শেষ হয়, পৃথিবীর পুরানো পথের রেখা মুছে যায়, এমনকি, নক্ষত্রেরও আয়ু শেষ হয়, অথচ “এই স্বপ্নের জগৎ চিরদিন রয়।” কাজেই চিরায়ত এই স্বপ্নের জগতে, নির্জনতার অখণ্ড অবকাশে বর্তমানের রূঢ় আঘাতে আহত রক্তাক্ত সুবেশী মানুষ স্বভাবতই ভাববে“এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেকদিন জেগে থেকে / ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে।” (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বর্তমানের নৈরাশ্যে বিষ্ণু দে-ও বলেছেন “ক্যানিভ্যাল এ জীবনে আমার ঘুম পায়!”)। শুধু ঘুম ও স্বপ্ন নয়, কবির আত্মসমর্পণ সেখানে, যেখানে

“সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে ; 

সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাকে 

নির্জনতা আছে।…..

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।”

এই স্বপ্নের হাতে ধরা না দিতে পারার যন্ত্রণায়, বস্তু জগতের সঙ্গে আত্মজগতের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, ‘বোধ’ কবিতার স্বগত-নায়ক; প্রেম ছিল, আশা ছিল, বধূ ছিল, শিশু ছিল তবু “উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিঃস্তব্ধতা” দেখে আত্মহত্যা করেছে ‘আট বছর আগের একদিন’-এর এই বিচ্ছিন্ন ক্লান্ত মানুষটি।

মৃত্যুচেতনা এবং প্রকৃতি প্রসঙ্গ : মৃত্যুচেতনা’ জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতাতেই এক লক্ষণীয় প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের মত মানবজীবনের পূর্ণতার কারণে তার প্রতিফলন নয়, নির্জনতার বোধে তার জন্ম। যদিও তুলনামূলক দৃষ্টিকোণে বিশ্বকবির ব্যক্তিধারণার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব এবং সর্বগ্রাহ্য। জীবনানন্দ যখন বলেন

“আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর?

জানি না কি আহা। 

সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেওয়ালের মতো এসে জাগে

ধূসর মৃত্যুর মুখ ;”

নির্জনতার নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ গড়ে ওঠার মূলে প্রকৃতির প্রশ্রয় সব চাইতে বেশি।

‘মাঠের গল্প’, ‘অবসরের গান’, ‘ঘাস’, ‘হায় চিল’ প্রভৃতি জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতায় যেখানেই প্রকৃতির প্রসঙ্গ বর্তমান, সেখানেই শেষ পর্যন্ত ধূসরতা নির্জনতার আবহ অনুভূত হয়। অথচ নিরপেক্ষ বিচারে একথা সত্যি, প্রকৃতি শুধু কবিকে নির্জনতার স্বাদ দেয় না, সংগ্রামেরও প্রেরণা যোগায়; শুধু ফাগুনের পাড়ায় ডাক দেয় না, অত্যাচার অবিচারের আগুনের বেড়ার মধ্যেও কবিকে যেতে নির্দেশ দেয়—হাতের কাছে এক রবীন্দ্রনাথই তার যথেষ্ট প্রমাণ। কিন্তু জীবনানন্দ বলেন

“যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,

যখন চড়াই পাখি কঁাটালীচাপার নীচে ঠোট আছে গুঁজে,

যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে উঠোনের খয়েরী পাতায়

যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়”।

সেই অপরূপ মুহূর্তে তার সে আকাঙ্ক্ষা “বাসমতী চালে ভেজা শাদা হাতখান রাখো বুকে, হে কিশোরী গোরোচনারূপে আমি করিব যে স্নান” সেখানে মনে হয়, এই নগরজীবনের কোলাহলে নিপীড়িত ক্লান্ত কবি এই স্নিগ্ধ হাতে যেন শুশ্রূষাই খুঁজেছেন।

বর্ণময়তা : বর্ণবিন্যাসের অভিনবত্বে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের পৃষ্ঠা রীতিমতো রঙিন। দৃষ্টান্ত তুলে ভারাক্রান্ত না করেও দেখা যায়, শালিখের খয়েরী ডানা, খই রঙা হাঁস, তমালের নীল ছায়া, লাল লাল বট ফল, হলুদ বাদামী পাতা, শ্যাওলার মলিন সবুজ, পুকুরের লাল সর, সবুজ বাঁশের বন, রূপালি মাছের কণ্ঠ প্রভৃতি পরিচিত বর্ণ যেমন আছে, আছে তেমনি কড়ির মতন শাদা হয়ে থাকা দূরের পাহাড়, ঘিয়ের সোনার দীপে লাল নীল শিখা, শিশিরের নীল জল, নদীর গোলাপী ঢেউ ইত্যাদি স্বল্প পরিচিত কল্পরঙে রূপসী বাংলার সমাপ্ত প্রসাধন, বিশ্বপ্রকৃতির যৌবনপুঞ্জে অবনমিতা ধরাবধূর রূপছবি। কবির স্বীকারোক্তিতেও সেই সত্যের সুর বাজে“বাঙলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”

চিত্রকল্প : চিত্রকল্পের অভিনব সন্নিবেশে, উপমার নিত্যনব প্রয়োগে জীবনানন্দ অদ্বিতীয়। চিত্রকল্পের দৃশ্য-দ্রব্য-ঘ্রাণ-স্পর্শযোগ্য আস্বাদ্য সব কটি রূপই জীবনানন্দের কবিতায় পাঠক আবিষ্কার করতে পারে। জানি ইতিহাসের পট ও ভূগোলের ভূমিতে তার কবিতার ভূমিকা রচিত। তবু সেই মানচিত্র প্রথমত এবং প্রধানত কবি ও তাঁর পাঠকের মানস-চিত্রের সীমানা-সমন্বিত। স্বভাবতই সুসা-নিনেভ-গ্রীক-হিন্দু-ফিনিশীয় সভ্যতার সমাধিস্তূপ পার হয়ে, বিম্বিসার-আটিলার কীর্তি-অকীর্তির ধূসর পাণ্ডুলিপিতে বদ্ধ সেই পথ নির্জনকামী মানুষের কাম্য হতে পারে না। বরং তার হাঁটার পথ সেখান দিয়ে, যেখানে “নির্জন খড়ের মাঠ পউষ সন্ধ্যায়, দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার”, যেখানে “সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে” (শোনা যায়, তিব্বতীয় কবি মিলারেপাও নৈঃশব্দের ধ্বনি শুনতেন), যেখানে “ডানার রৌদ্রে গন্ধ মুছে ফেলে চিল”। তারপর “পাখির নীড়ের মতো চোখ” নিয়ে দেখা দেয় ‘বনলতা সেন’। সেই আত্মবৃত্ত শান্ত চিত্তে ‘নির্জনতা’ ছাড়া আর কি কাম্য হতে পারে? আধুনিক বাংলা কাব্যের আকাশে জীবনানন্দ দাশ তাই আজও এক অদ্বিতীয় নির্জন নক্ষত্র।