“দূরগামী জাহাজ নানা কল্পনায় বেদনায় মিশ্রিত হয়ে চিদ্-সমুদ্রের তরঙ্গে দুলে ওঠে কখনো দেশের কখনো সুদূর প্রাণ তটের আহ্বানে” –সহজ জীবনের অভিজ্ঞতায় যে ছবি সত্য চোখে লাগে মনে ধরে এমন সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতাকে কাব্যের বিষয়-গৌরব দেওয়াই যে কবির কৃতিত্ব, কবি অমিয় চক্রবর্তী তাদের মধ্যে অন্যতম। ইংরেজী সাহিত্যের কৃতী অধ্যাপক, বিদেশী সাহিত্যপাঠে পরিমার্জিত, রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ সান্নিধ্যে লালিত এই কবি স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী।

১৯২১ সালে ‘সবুজপত্রে’ প্রকাশিত দুটি কবিতা এবং ১৯২২ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘ভারতীয় শিল্প প্রতিভা’ শীর্ষক প্রবন্ধ বা প্রথম গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে অমিয় চক্রবর্তীর আত্মপ্রকাশ শুরু হয়।

বস্তুতঃ “বাংলা তথা ভারতীয়ত্বের সংস্কার এবং ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেও তিনি আধুনিক মানুষের আন্তর্জাতিক চেহারা, পরিচয় এবং বিস্তারে বিশ্বাসী। তার স্বভাব শান্ত, কিছুটা অনুচ্ছ্বসিত; আবেগ গভীর কিন্তু জমাট। মিলন-বিরহে তো বটেই, বিক্ষোভেও তিনি তেমন উত্তেজিত হন না। সংযম তাঁর স্বভাবের মৌল উপাদান, তাই সংগতি তাঁর কবিতার স্বাভাবিক লক্ষণ। তার দৃষ্টিভঙ্গী সুস্মিত, পরিশীলিত, অসম্ভব মার্জিত—স্বচ্ছ, স-মনন। কখনো একটু ব্যঙ্গের মিশেল দেওয়া। তিনি অহিংসায় বিশ্বাসী এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী।

তিনি একজন বিশিষ্ট দার্শনিকও। একটু তাত্ত্বিক ধরনের নানা ভাবনা তাঁর মনে দৃঢ়মূল যা তার কবিতাতেও স্বপ্রকাশ। সবশেষে তিনি একজন কালসচেতন কবি—আধুনিককাল যাঁকে কখনো ক্ষুব্ধ, কখনো চমৎকৃত করেছে এবং সব মিলিয়ে গভীরভাবে ভাবিয়েছে”

অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম ও কর্মজীবন:

১৯০১ খ্রীস্টাব্দের ১০ এপ্রিল হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে মাতামহের বাড়িতে তাঁর জন্ম হয়। আদি নিবাস ছিল পাবনার ভারেঙ্গা গ্রামে। বাবা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী, মা অনিন্দিতা দেবী। অমিয় চক্রবর্তীরা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন।তবে বড়ো ভাই অরুণচন্দ্র আত্মহত্যা করেছিলেন। দ্বিজেশচন্দ্র আসামের গৌরীপুর স্টেটের দেওয়ান ছিলেন। অনিন্দিতা দেবীও ছিলেন সমকালের তুলনায় যথেষ্ট প্রগতিশীলা। ‘বঙ্গনারী’ ছদ্মনামে তিনি লিখতেন। দ্বিতীয় সন্তান অমিয় চক্রবর্তীসহ অন্যান্য পুত্র কন্যাদের উপর তাঁর সাহিত্যর চির প্রভাব পড়ে। গৌরীপুরের প্রতাপচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে অমিয়র লেখাপড়া শুরু হয়। তারপরে কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই সময় তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত। ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দে হাজারিবাগের ‘সেন্ট’ কলম্বাস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে প্রথম হয়ে গ্রাজুয়েট হন।

এই সময়ে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ-পত্র’ দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯২২-এ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় অমিয়-র প্রথম গদ্যরচনা ‘ভারতীয় শিল্প প্রতিভা’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৪-২৫-এ তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন ‘কবিতাবলী’ প্রকাশিত হয়। ‘প্রবাসী’, ‘উত্তরা’, ‘বিচিত্রা’, ‘কল্লোল’ প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি লিখতে থাকেন। ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম. এ. পাশ করেন। ১৯২৭-এ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসচিব নিযুক্ত হন। এই বছরের ডিসেম্বরে হিয়োর্ডিস সিগোর নামে ডেনমার্কের এক তরুণীকে বিবাহ করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামকরণ করেন হৈমন্তী। 

কবি অমিয় চক্রবর্তীর দ্বিতীয় কাব্যসংকলন ‘উপহার’ এই সময় প্রকাশিত হয়। ১৯৩০-এ বার্মিংহামে উডব্ৰুক কলেজে ‘ফেলোশিপ লেকচারার’ হয়ে বিদেশে পাড়ি দেন। ১৯৩১-এ শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৩২-এ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইরান, ইরাক ও আফগানিস্তান ভ্রমণে যান। ১৯৩৩-এ গবেষণার বিষয় ছিল, ‘The Dynasts and the Post-war Age in Poetry’) উদ্দেশে অক্সফোর্ডে যান। ১৯৩৬-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো’ মনোনীত হন। ১৯৩৭-এ এখান থেকে টমাস হার্ডি সম্পর্কে গবেষণা করে পি. এইচ. ডি. করেন। এই বছরে লাহোর খ্রীস্টান কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই কাজে যুক্ত ছিলেন। এখানে কবি ইকবালের সঙ্গে পরিচয় হয়। প্যারিসে জেমস জয়েসের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। জয়েস অমিয় চক্রবর্তীর নামটিকে ‘Ambrose Wheeltumer’ শব্দে রূপান্তরিত করেন। এরপরে কবি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছিলেন।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে যথাক্রমে ওয়াশিংটনের হাওয়ার্ডে ধর্মতত্ত্ব ও ইংরেজি সাহিত্যের অতিথি অধ্যাপক এবং আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো’ নিযুক্ত হন। ১৯৫০-৫১-তে জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সরকারী উপদেষ্টা মনোনীত হন। ১৯৫১-তে পশ্চিম ও পূর্ব বার্লিন প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি রূপে যোগদান করেন। ১৯৫৩-তে ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

১৯৫৩-১৯৬৫ পর্যন্ত বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্যধর্ম ও সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৪-তে আফ্রিকার ল্যামবারেনেতে অ্যালবার্ট শ্বোয়াইট্জারের কর্মকেন্দ্রে এবং ১৯৫৫-তে Indian Council for Cultural Relations এর আমন্ত্রণে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। ১৯৫৮-তে মস্কো যান। সেখানে বরিস পাস্তারনাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ১৯৬২-তে স্বল্পকালের জন্য ভারতে আসেন। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সিংহলে যান। ১৯৬৩-তে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র অধ্যাপক পদে যোগদান করেন (১৯৬৩-৬৪)।

‘চলো যাই’ ভ্রমণগ্রন্থের জন্য ১৯৬৪-তে ইউনেস্কো পুরস্কার পান। এই বছরে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যাণ্ড ও জাপান ভ্রমণ করেন। ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভাষণ দেন।

১৯৬৬-তে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এমেরিটাস প্রফেসার’ হিসেবে সম্মানিত হন। ১৯৬৬-৬৭-তে আমেরিকার স্মিথ কলেজে ভারতীয় ও প্রাচ্যধর্মের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৬৭-তে নিউ ইয়র্কের ন্যু-পল্ল্জ ইউনিভার্সিটিতে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান (১৯৭৭ পর্যন্ত) করেন। আন্তর্জাতিক শাস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ওয়াটুমল ফাউণ্ডেশন পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৬৮-তে কলকাতায় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদানের জন্য স্বদেশে আসেন। ১৯৬৯ পাঞ্জাবের পাতিয়ালা বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাসের জন্য অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রিত হন। এই বছরে বিশ্বশাস্তি সম্মেলনে যোগ দিতে জেনেভায় যান। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি. লিট উপাধিতে সম্মানিত করে। ১৯৭০-এ ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি পান। ১৯৭২-এ পি. ই. এন.-এর অল ইণ্ডিয়া রাইটার্স কনফারেন্সের সভাপতি রূপে নির্বাচিত হন। এই বছরে আমেরিকায় ‘বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ’ রূপে সম্মানিত হন। ১৯৭৩-এ কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যরূপে মনোনীত হন।

১৯৭৪-এ আমেরিকার ফ্রেণ্ডস ইউনিভার্সিটি কলেজের ট্রাস্টি নিযুক্ত হন। ১৯৭৫-এ আমেরিকার প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে বিশিষ্ট নাগরিক হিসাবে তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এই বছরেই কবি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ‘অতিথি অধ্যাপক’ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৭-এ নিউ ইয়র্কের ন্যু-পল্জ কলেজের দর্শন বিভাগে অধ্যাপনা করেন। বিশ্বভারতীতে ‘অতিথি অধ্যাপক’ রূপে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হন।

১৯৮০-তে চীনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অতিথি অধ্যাপক’ হিসেবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রন পান। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে যাওয়া সম্ভব হয় না। ১৯৮৩-তে দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে শান্তিনিকেতনে তৈরি নিজের বাড়ি ‘রাস্কা’য় বসবাসের জন্য ফিরে আসেন। এই বাড়িতেই ১৯৮৬ খ্রীস্টাব্দের ১২ জুন কবি অমিয় চক্রবর্তী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আধুনিক কবিদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী বিশেষভাবে রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ ছিলেন রবীন্দ্র সচিব হয়ে বেশ কিছুকাল কাজ করার সুবাদে। বিশ্বকবির মত তার মধ্যেও এক ধরনের বিশ্বাসের ভিত্তি ও বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দেখা যায়। কিন্তু এই সাদৃশ্য সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য মেরু প্রমাণ। এই পার্থক্যের সীমারেখা কবি বুদ্ধদেব বসু নির্দেশ করেছেন “তিনি কী এনেছেন যা রবীন্দ্রনাথে নেই। এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো যে এ দুজনের জগৎ মূলতঃ এক হলেও উপাদানে ও বিন্যাসে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রধান কথাটা এই যে রবীন্দ্রনাথের স্থিতিবোধ, অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে স্থায়িত্বের ভাব অমিয় চক্রবর্তীর নেই তাঁর কবিতার পটভূমিকা চার মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের যে শানাইয়ের সুর কলকাতার গলির অসংগতিকে মিলিয়ে দিয়েছিলো, তাকে অমিয় চক্রবর্তী প্রয়োগ করেছেন আমাদের সমকালীন পরিচিত পৃথিবীর বিবিধ, বিচিত্র, পরস্পরবিরোধী তথ্যের উপর; যে-পরিবেশের মধ্যে আমরা প্রতিদিন বেঁচে আছি এবং যুদ্ধ করছি, তার মিলনমন্ত্র একেবারে তার কেন্দ্র থেকে উত্থিত হচ্ছে। এই উপাদানের আয়তন ও বৈচিত্র্য তাকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে; রবীন্দ্রনাথের কাছে যা পেয়েছেন তার ব্যবহারের ক্ষেত্র আলাদা বলে তার কবিতার রসবস্তুও স্বতন্ত্র, তাঁর কাছে আমরা যা পাই, রবীন্দ্রনাথ তা দিতে পারেন না” (‘কালের পুতুল’)।

অমিয় চক্রবর্তীর রচনাসমূহ:

কাব্যগ্রন্থ : ‘কবিতাবলী’ (১৯২৪-২৫) : ‘খসড়া’ (১৯৩৮), ‘এক মুঠো’ (১৯৩৯), ‘মাটির দেওয়াল’ (১৯৪২), ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ (১৯৪৩), ‘দূরযানী’ (১৯৪৪), ‘পারাপার’ (১৯৫৩), ‘পালাবদল’ (১৯৫৫), ‘ঘরে ফেরার দিন’ (১৯৬১), ‘হারানো অর্কিড’ (১৯৬৬), ‘পুষ্পিত ইমেজ’ (১৯৬৭), ‘অমরাবতী’ (১৯৭২), ‘অনিঃশেষ’ (১৯৭৬), ‘নতুন কবিতা’ (১৯৮০)।

প্রবন্ধ সঙ্কলন : ‘সাম্প্রতিক’ (১৯৬৩)।

ইংরেজি রচনা এবং অনুবাদ: ‘Tagore in Canada (1929) Viswabharati Quarterly-তে প্রকাশিত, The Dynasts and the Post-war Age in Poetry (1938), ‘Modern Tendencies in English Literature (1942), ‘The Indian Testimony (1953, Pendlé Hill Series), ‘Science and Religious Humanism’ (1965)।

অমিয় চক্রবর্তীর অনুবাদ বা অনুবাদ কর্মে সহায়তা:

১. শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন ফরাসী অধ্যাপক এফ. বেনোয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটক অনুবাদে সাহায্য করেন। প্যারিস থেকে ‘লা মেশিন’ (1929), নামে Reider সেটি প্রকাশ করেছিলেন। অনুবাদকের নাম ছিল যথাক্রমে ‘বেজোয়া’ এবং ‘অমিয় চক্রবর্তী’।

২. অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’ বইটির অনুবাদে ফরাসী শিল্পী আঁদ্রে কার্পেলকে সাহায্য করেছিলেন। ‘ক্ষীরের পুতুল’ ও ‘নালক’ একত্রে ‘লা পুপে দ্য ফ্রোমাজ’ ( La Paupee Framage) নামে প্যারিস থেকে 1933 খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

৩. রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ধরনের লেখার একটি সংকলন ম্যাকমিলান অ্যাণ্ড কোম্পানী থেকে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। এই সংকলনের সম্পাদক ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। তিনি এই সংকলনে রবীন্দ্রনাথের সতেরোটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন।

৪. রবীন্দ্রনাথের জার্মান অনুবাদের একটি সংকলন তিনি ‘এইন অ্যানথলজি’ (Eine Anthologie) নামে সম্পাদনা করেছিলেন। এটির প্রকাশকাল 1961, স্থান, হাইপেরিয়ান, ভের্ল্যাগ, ফ্রাইবুর্গ।

৫. ‘The House Warming and other selected writings’ নামে New Ameri can Library থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা আর একটি ইংরেজি অনুবাদের সংকলন 1965 সালে প্রকাশিত হয়। ছোটগল্প-নাটক-কথিকা এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। যৌথভাবে অনুবাদ করেন ম্যারি লাগো, তরুণ ঘটক এবং অমিয় চক্রবর্তী।

৬. রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের ‘Four Chapters’ নামে অনুবাদ করেছিলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। কিন্তু রবীন্দ্র, সহচরবর্গের ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় সেই পাণ্ডুলিপি লেখকের নামে মুদ্রিত করা হয়নি। এ সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক তথ্যমূলক আলোচনা করেছেন : ‘রবীন্দ্র উপন্যাসের একটি উপেক্ষিত অনুবাদ’, সুমিতা চক্রবর্তী। (প্রাপ্ত তথ্যসমূহের জন্য দ্রষ্টব্য : ‘জলদর্চি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২-৪২)।

বিশ শতকের তৃতীয় দশকে আবির্ভূত এই কবি নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব হওয়ার সৌভাগ্য তো ছিলই, তাছাড়া তাঁর প্রতিভা ও শক্তির উপর বিশ্বকবির বিশ্বাস ও নির্ভরতা তাঁকে সমকালেই সুচিহ্নিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সাহিত্যের পথে’ গ্রন্থ উৎসর্গ করে ভূমিকায় এক দীর্ঘপত্র লিখেছিলেন, যার থেকে বোঝা যায় সাহিত্যের সুরসিক সমঝদার রূপে তিনি মহাকবির কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত ‘নবজাতক’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা নির্বাচনের দায়িত্ব তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন : “নিশ্চিত্ত ছিলুম কারণ দেশ-বিদেশের সাহিত্যে ব্যাপক ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ।”

‘বিচিত্রা’ পত্রিকার পাতায় ১৯২৭ খ্রীস্টাব্দে কবি অমিয় চক্রবর্তীর প্রথম আত্মপ্রকাশ। তখন তিনি অনেক পরিমাণে রবীন্দ্রানুসারী। কিন্তু তারপর ‘খসড়া’, ‘একমুঠো’ ইত্যাদি কাব্যে কবির যে জীবনদর্শন লক্ষিত হল সেখানে দেখা গেল তাঁর প্রতিভার দীপ্তি। এই পর্যায়ে আছে দুচোখ মেলে জগৎ ও জীবনকে দেখার অভীপ্সা; যেমন, ‘খসড়া’ কাব্যে বর্ণিত এক জাহাজযাত্রী মানুষের কথায় পটভূমির চিত্ররূপ

“চিনি কারে, সে কোথায় 

নামব না ঘাটে।

দূরে ভেসে চলে যাও ছবি আঁকা পটে,

ভাঙ্গো ঝোড়ো জল,

জাহাজ মরাল।”

আবার কোথাও বা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে যেন মানুষের প্রসন্ন বা বিষণ্ন মনের চিত্র

“অগণ্য ধান-খুশি সোনালি

প্রসন্ন মেঘ,

বিষণ্ণ পুকুর জলে চাদের ছায়া ডোবা চাঁদের ছায়া,

ডোবা চাদের ফালি; 

মা কথা কননি, আমার মা,

ডালটা কাটতে হবে পুরনো শিশুগাছের…”

এখানে আছে চারটি ছবি—প্রথমটি সোনালী ধানের ছবির সঙ্গে প্রসন্নতা, দ্বিতীয় ছবিটি বিষণ্ণতার, তৃতীয়টি মায়ের স্মৃতি-ভাবনা, আর শেষে কাজের চিন্তা—সব মিলে সংসারের এক পূর্ণ রূপ।

কবি অমিয় চক্রবর্তীর জীবনদর্শনের দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যায় গভীর ধ্যানের জগতের চিত্তা ও চেতনা। তৃতীয় পর্যায়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের ভিত্তিতে আধুনিক বিশ্বজীবন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণার প্রকাশ। বস্তুত, স্বদেশে ও বিদেশে পরিব্যাপ্ত তার জীবন অন্বেষণ কবিতায় এনেছে ব্যপ্তি, দিয়েছে হতাশা ও নিরাশার জগৎ থেকে উত্তরণের দিশা। শুধু তাই নয়, চিত্ররচনা, শব্দপ্রয়োগ, অনুপুঙ্খ উল্লেখ এবং ভাবের ক্ষেত্রে বিশ্বজনীন অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস ইত্যাদি সব মিলিয়ে তাঁর কাব্যে ইউরোপের যে-কোন দেশ বা এশিয়ার অংশবিশেষের রূপ চোখে পড়তে পারে। সেই রূপ কল্পনায় প্রখর আবেগ নেই, অনুভূতির তীব্র সংবেদন আছে। অনুভূতির অগম্য ব্যঙ্গ নেই, জানাশোনার বিস্মিত আনন্দ আছে, আছে জগৎ ও জীবনের এক অমূর্ত রহস্যময় প্রবাহিত স্রোতের উপলব্ধি।

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় বহির্গামী এক মানুষের পরিচয় প্রকাশিত। ‘খসড়া’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘বাড়ি’ থেকে যার সূচনা, তারপর ‘দূরযান’, ‘পালাবদল’, ‘পারাপার’ ইত্যাদি কাব্যের অনেক কবিতায় দূরবাসী এক পথিকের গৃহছাড়া মনের উৎকণ্ঠা-বিস্ময় বেদনার সংরাগ দেখা যায়। বুদ্ধদেব বসু এর ব্যাখ্যায় বলেছিলেন : “বাসা ভেঙ্গে গেছে মানুষের; বুদ্ধিজীবী মাত্রেই উদ্বাস্তু; ‘বাড়ি’ নামক ব্যাপারটা একটা আইনঘটিত কল্পনায় পরিণত হয়েছে—এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘ন্যাশনালিটি’ জিনিসটাও তাই। এই পরিবর্তিত এবং পরিবর্তমান পৃথিবী বিষয়ে অমিয় চক্রবর্তী সূতীক্ষ্ণভাবে সচেতন” (অমিয় চক্রবর্তীর ‘পালাবদল’, ‘কালের পুতুল’)। তাই ‘খসড়া’র “বাড়ির কথা ভাবি” আর ‘অভিজ্ঞান-বসন্ত’র “কোথায় চলেছে পৃথিবীর” সুরে আছে গৃহহীনতার বেদনা।

এখানে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই কিন্তু বাংলাদেশ তথা ভারতের স্বদেশের ছবিটি অনুভব করা যায়। আবার ‘পারাপার’ এবং ‘পালাবদল’ কাব্যের মধ্যেও শাস্তিনিকেতন, শুভলক্ষ্মীর রেকর্ড, বোষ্টমী ভিথিরী, রাধা-কৃষ্ণ, শিব-পার্বতীর ঐতিহ্য ‘মণ্ডিত ‘স্বদেশ’ মূলক কবিতাগুলি হার্দ্য অনুভবে আঁকা হয়েছে। অনুরূপভাবে এক গৃহপ্রত্যাশী মন বাংলার স্মৃতিসহ ‘অমরাবতী’র মধ্যেও উপস্থিত। সেখানেও দেখা যায় দশটা সাগর বারোটা দেশ পেরিয়ে পরবাসী বুঝেছে “দেশ পেরোনো যায় না”

চিরদিনই সেই অনিমেষ

প্রাণ রয়েছে গঙ্গাতীরে,

চেয়ে থাকি মেঘলা নীরে

ফোটে ভোরের আয়না-

প্রাচীন দেউল, শিমুল ছায়া

বুকের ঘাটে বাংলা মায়া

সুধার অতল পায় না-

দেশ পেরোনো যায় না।” (“অনতিক্রান্ত’)

এইভাবে নিরাসক্ত পথিকচিত্ত বিশ্ব পরিভ্রমণ করে কিন্তু “সংসারে এই চির পরবাসী” তার নিজের ঘর খুঁজে পায় না। অবশ্য একালের সমালোচকের কাছে এই গৃহচেতনার মধ্যে সুপ্ত হয়ে আছে মৃত্যুচেতনা : “অমিয় চক্রবর্তী ‘দূর পরবাস’ শেষ করে বসুমতীর অঞ্চলের ভিতর আশ্রয় খোঁজেন—এ-সবই এক অর্থে মৃত্যুচেতনা, এ-সবই এক অর্থে গৃহপ্রত্যাশা, যে মৃত্যু যে গৃহ অস্তিত্বের, চেতনার প্রত্যস্ত, প্রদেশে দীপ্যমান”।

অমিয় চক্রবর্তীর স্বদেশপ্রসঙ্গ:

অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন দীর্ঘকাল বিদেশবাসী। তাই তাঁর কাব্যে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার উল্লেখ আছে, আছে ব্রডওয়ের নিউইয়র্কের কথা, এম্পায়ার স্টেটের উল্লেখ। তবু বাংলাদেশ-ভারতবর্ষের প্রসঙ্গ বিভিন্ন কবিতায় উপস্থিত। ‘পালাবদলে’র অনেক কবিতাই স্বদেশের অনুরাগে রঞ্জিত। কোথাও আবার স্বদেশ কেবল স্মৃতিমাত্র, কোথাও মানুষই স্বদেশের পটে মূর্ত। তার কবিতায় মানুষজন সাধারণ, সরলতম। তারা ফ্যাক্টরির পাশের রেস্তোরাঁয় বসে চিনি নিয়ে কফি খায়, একটু বেশি মদ খাওয়া স্বামীর ঘর ফেলে দুঃখী স্ত্রী চলে আসে, নির্লিপ্ত সংসারে যে শুধু সাধারণ প্রশ্ন করে ঘড়িতে কি দম দেওয়া হয়েছে? এভাবেই শোনা যায় গুরুচরণ কামারের কথা

“গেল 

গুরুচরণ কামার, দোকানটা তার মামার,

হাতুড়ি আর হাপর ধারের (জানা ছিল আমার) দেহটা নিজস্ব”

তিনি জানেন, মানুষে মানুষে সম্পর্কের প্রাচীন বন্ধনগুলি আজ জরাজীর্ণ, অনেক জায়গায় ছিন্নভিন্ন। ক্ষয় সর্বব্যাপী। কিন্তু এই কারণেই তিনি কোন ক্লান্তি বা গ্লানিতে কালিমালিপ্ত হন না। তাই সব হারানো দিনের অনিবার্যতা মনে রেখেও তিনি ভাবতে চান সমকালের যুগ-দস্যু “কী কী কেড়ে নিতে পারবে না”, যেমন

“যতদিন বাঁচি ভোরের আকাশে চোখ জাগানো

হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো। 

কুয়োর ঠাণ্ডা জল, গানের কলি, বইয়ের দৃষ্টি

গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।

আপনজনকে ভালোবাসা,

বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।”

আর তার সঙ্গে যুক্ত হবে

“শত শতাব্দীর

তরু বনশ্রী

নির্জন মনশ্রী।”

এই বিশ্বাস আছে এই কাব্যের ‘চিরদিন’ কবিতাটির মধ্যে

“আমি যেন বলি, আর তুমি যেন শোনো

জীবন জীবনের তার শেষ নেই কোনো। 

দিনের কাহিনী কত রাত চন্দ্রাবলী 

মেঘ হয়, আলো হয়, কথা যাই বলি। 

ঘাস ফোটে, ধান ওঠে, তারা জ্বলে রাতে 

গ্রাম থেকে পাড়ি ভাঙে নদীর আঘাতে। 

দুঃখের আবর্তে নৌকো ডোবে, ঝড় নামে, 

নূতন প্রাণের বার্তা জাগে গ্রামে গ্রামে; 

নীলাস্ত আকাশে শেষ পাইনি কখনো 

আমি যেন বলি, আর, তুমি যেন শোনো।”

শ্রেয়বোধ কবির মন খাঁটি ভারতীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত। তিনি জানেন আনন্দের মধ্যেই সবকিছুর জন্ম, লালন ও লয়। তাই ইউরোপীয় পাপবোধ, ভীতি, অস্তিত্বহীনতার সংশয় ও নৈরাশ্য তাঁকে স্পর্শ করে নি। তার দ্বন্দ্বহীন জিজ্ঞাসা-বিহীন কাব্যের পটভূমি এক স্থির বিশ্বাসের ভূমিলগ্ন। সেই বিশ্বাস শ্রেয়বোধের প্রকাশ। কবি নিজেই তার ‘কাব্যাদর্শ’ বোঝাতে গিয়ে বলেছেন : “আজ আমরা বলব সাহিত্যের আর একটি রূপ আছে যা নিঃসংলগ্ন, যা বর্ণাঢ্য কিন্তু শ্রেয়োধর্মী–অথচ সেই শ্রেয়তা সমাজের উপস্থিত ভালো-মন্দের সঙ্গেও স্পষ্টভাবে যুক্ত নয় তো (ত্রিকাল’, ১৯৪৫)।” অর্থাৎ তাঁর মতে, দৃষ্টির দর্শনই সব কথা নয়। কাব্যসৃষ্টির একটা বড় অংশ সামাজিক স্রোতের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু শ্রেষ্ঠ কাব্য শুধু তাকে নিয়েই রচিত হতে পারে না। অসংলগ্নতা শ্রেয়তা সংসারের সাধারণ সুখ-দুঃখ থেকে ভিন্ন। তাকে দৃষ্টির দ্বারা নয়, ধ্যানে লাভ করা যায়।

ভারতের দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছিন্নমূল মানুষের বেদনা, আমেরিকার জনজীবনে অনিশ্চয়তা দেখে তিনি শঙ্কিত। তিনি শেষে উপলব্ধি করেন, মুক্তি শুধু ধ্যানে নেই, বিজ্ঞানেও নেই, সমাজের মুক্তির জন্য চাই বিজ্ঞানের কল্যাণ শক্তির সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের ধ্যানের সঙ্গতি।

‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ কাব্য থেকেই তিনি জীবনের টুকরো অভিজ্ঞতা বিচিত্র বেদনার অনুষঙ্গকে একটি সঙ্গতি ও সংহতির মধ্যে মেলাবার চিন্তা করেন। আর তখনই মনে হয়

“মেলাবেন তিনি ঝড়ো হাওয়া আর

পোড়া বাড়িটার

ঐ ভাঙা দরোজাটা

মেলাবেন”।

এই কাব্যের ‘সঙ্গতি’, ‘বীজমন্ত্ৰ’ ইত্যাদি কবিতায় তিনি দৃষ্টির এক নতুন তত্ত্ব উপলব্ধি করেছেন – “যে দৃষ্টি সকল সুর দেখে”। এই দৃষ্টি বা চেতনায় জীবন-মৃত্যুও তাঁর কাছে সমুদ্রের এপার ওপার ব’লে মনে হয়েছে

“এপারে ওপারে, বন্ধ, হয়তো ওপারে 

সব মিলে এক হওয়া মোহনায় দুই নদী মিলে।”

তিনি মনে করেন, কবির জীবন-সাধনা কোন কিছু বাদ দিয়ে হতে পারে না, বৃক্ষের মতো তা সব কিছুর সঙ্গে প্রাণরসে যুক্ত 

‘আলোয় রয়েছে ডুবে, হাওয়া তাকে স্পর্শ করে 

মন্ত্র লাগে তারাময় ভোরে।

নিগূঢ় সঞ্চারে তাকে মৃত্তিকার দান, 

করায় প্রাণের রস পান।”

অমিয় চক্রবর্তীর ‘ঘরে ফেরার দিন’ কাব্যগ্রন্থটি স্বদেশে ঘরে ফেরার কথায় বা বেদনায় ব্যক্ত হয় নি। কারণ কবি জানেন, দেশে দেশে তাঁর দেশ আছে। এখানে তাই স্বদেশভাবনা নয়, প্রকাশ পেয়েছে মৃত্যুচেতনা

“যম নেয় প্রাণ

রেখে দিই লুকিয়ে

তবু একরত্তি 

চোখের দিনের সোনা 

কানে ভোরের আজান”

অমিয় চক্রবর্তীর আঙ্গিক-সচেতনতা:

অমিয় চক্রবর্তী আঙ্গিক-সচেতন কবি। তাঁর কবিতার কায়াগঠনে ছবি ও ছন্দ দুই-ই সমানভাবে ক্রিয়াশীল। তিনি নিজেই তার ‘সাম্প্রতিক’ গ্রন্থভুক্ত ‘কাব্যের ধারণাশক্তি’ প্রবন্ধে বলেছেন – “পড়ন্ত রোদের একটি গ্রন্থিতে বাঁধা পড়ে গেল অনেক কিছু পানের দোকানে সবুজ পান, সোনালী ডিবে, ঝিলমিলে ঝোলানো আয়না, দোকানের লাল টালির উপরে চুপ করে বসে আছে কাক। কী বলতে চায় জানি না, কিন্তু এই একটি সমগ্র রচনা, ছবির ঘেরে অহৈতুক একতা। এর রহস্য বিষয়ে ছন্দে ধরা দিতে চাইল।”

অবশ্য তুলনামূলকভাবে এই রীতিকে কেউ কেউ ‘ক্যাটালগিং’ বলে তাঁর কবিতার দোষ ধরেছেন।

ব্যঙ্গ রীতির বৈশিষ্ট্যও তাঁর কবিতায় দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে তার ‘সাবেকি’, ‘চেতন স্যাকরা’, ‘গন্তব্য’ প্রভৃতি কবিতার কথা মনে আসে। এছাড়া বাংলার লোকসঙ্গীত ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক আবহ তাঁর কবিতায় ধরা দিয়েছে। তাঁর ‘খসড়া’ কাব্যের “নাগরদোলা”, “ঠারেঠোরে”, “একমুঠো” কাব্যের “গন্তব্য”, “মাটির দেওয়ালে” “ঘুমের ঘোরে” ইত্যাদি কবিতা লোকজীবনের অনুষঙ্গে সমৃদ্ধ।

অমিয় চক্রবর্তীর স্তবক নির্মাণ রীতি:

কবিতার স্তবক-নির্মাণরীতির ক্ষেত্রে স্তবক গঠনে কারুকার্যের চেয়ে “এক একটি পঙ্ক্তিকে বাজানোর ও সাজানোর দিকেই তার মন বেশি। দুই তিন বা চার পক্তির বহু ছোট ছোট স্তবক তিনি রচনা করেছেন যেগুলি হয়তো একটি স্তবকেও লেখা যেতো। তিনি খুব ছোট পক্তি লিখতে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন একটি পক্তির দু’পাশে এবং ওপরে নিচেও জায়গা ছেড়ে রাখতে। সেজন্য তার স্তবক নির্মাণ খুব গাঢ় নয়। অস্পষ্টভাবে একবার ভেবেছি—ভালো ছবির চারিদিকে যেমন শূন্যতার অবকাশ রাখা জরুরী—তাঁর চিত্ররূপময় পক্তিগুলির চারিদিকেও হয়তো সেভাবে জায়গা ছেড়ে রাখা তিনি দরকার মনে করেছেন” (সুমিতা চক্রবর্তী, “কবিতার নির্মাণ : অমিয় চক্রবর্তী’’, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার বিচার ও বিশ্লেষণ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১৫ ২১৬)। আর এক সমালোচক কামিংস-এর সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য অনুভব করে বলেছেন : “কামিংস কবিতায় টাইপোগ্রাফি ব্যবহার করেছেন। কবিতায় শব্দ এমনভাবে সাজিয়েছেন—তা যেন যে বিষয়ের তিনি বর্ণনা দিচ্ছেন ছবির আকারে বা নকশায় মূর্ত হয়ে ওঠে। অমিয় চক্রবর্তীর কয়েকটি কবিতার বিন্যাস দেখে বোঝা যায় কামিংস-এর প্রভাব তিনি এড়াতে পারেন নি।”

অমিয় চক্রবর্তীর ইমেজ/চিত্রকল্প:

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় ইমেজ বা চিত্রকল্প-নির্মাণে বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তাঁর কবিতার অধিকাংশ ইমেজ বস্তুজগৎ থেকে আহরিত। এই বস্তুজগতের সঙ্গে মননজগতের সংযোগ ঘটেছে। অনেক চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়ে প্রতীকে পরিণত হয়েছে ; যেমন—সিঁড়ি, বাড়ি, বৃক্ষ, বৃষ্টি, এরোপ্লেন। তাঁর ‘চেতন স্যাকরা’ ও প্রতীক পর্যায়ী।

অমিয় চক্রবর্তীর ছন্দ-নির্মাণ:

ছন্দ-নির্মাণের ক্ষেত্রে অমিয় চক্রবর্তী বিশেষভাবে অক্ষরবৃত্তের চালকে গ্রহণ করেছেন তার কবিতায়। এই অক্ষরবৃত্ত ঠিক প্রচলিত রীতিতে পয়ারের অনুবর্তী হয় নি। স্বরবৃত্তের ব্যবহারে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ও কুশলতা দেখা গেছে। এখানে চার মাত্রার জায়গায় পাঁচ বা তিন মাত্রা ব্যবহার করেছেন ; যেমন—

“প্রকাণ্ড বন প্রকাণ্ড গাছ

বেড়িয়ে এলেই নেই

ভিতরে কত লক্ষ কথা

পাতা পাতায় শাখা শাখায়

সবুজ অন্ধকার।” (“বৈদান্তিক’)

পদ্যের আবেগ এবং কথ্যবাচনের স্বাভাবিকতাকে মিশিয়ে অমিয় চক্রবর্তী আর এক নতুন রীতি সৃষ্টি করেছেন। নাম তার ‘ফ্রী ভার্স’। তাঁর কবিতার ছন্দে শৃঙ্খল মুক্তি ঘটেছে—অনিয়মিত পর্ববিভাগ, অনিয়মিত ছন্দ গঠনরীতি, ছন্দফুট পক্তির উপস্থিতি তাঁর কবিতায় দেখা যায়, যা অন্যান্য আধুনিক কবিদের মধ্যে বিরলদৃষ্ট।

অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যে ‘স্প্রাং রিদম্’ ছন্দের প্রয়োগও দেখা গেছে। এই ছন্দের স্রষ্টা হকিন্স। এই জাতীয় ছন্দে প্রতিটি ‘ফুট্’ সুরু হয় একটি ‘stressed syllables’ দিয়ে, কথোপকথন ও বাক্রীতি মিশ্রণে তা এক বিশেষ রূপ নেয়। W. H. Gardner-এর মতে, “Sprung Rhythm is so-called because of the syncopated spring…..the occasional abrupt juxtaposing of stressed syllables, as in ordinary speech.” (Introduction, Poems of G. M. Hopkins, Ed. 1967) এই কথ্য বাচনরীতি অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় প্রায়শই চোখে পড়ে; যেমন—

“তখন দরজায় দেখলেন দাঁড়িয়ে- হঠাৎ 

আছি সবাই, জানো ভাই, 

–আর সবাই”

তাই বলা চলে, আধুনিক বাংলা কাব্যে অমিয় চক্রবর্তী দক্ষতম প্রকরণ-শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম।