“Young Dramatist, এই পোড়ার দুঃখটারে তো খুইজ্যা বাড়াইতে হয় না, দুঃখটা তো নিজেই তোমারে খুঁজতে আছে; সেইটারে কিছুতেই পারসোনাল হইতে দিও না। আগুনের মধ্যে হাত বাড়াইয়া দিবা, তাইর পর ভাববা, পুরতাছে সারা দেশটা”— অভিজ্ঞতার উত্তপ্ত উপাদান থেকে বাংলা নাটকের গণমুখী বলিষ্ঠ রূপনির্মাণের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন যিনি, তিনি প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য।
বিজন ভট্টাচার্যের জন্ম ও কর্মজীবন:
বাংলা গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা বিজন ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯১৫ খ্রীস্টাব্দের (মতান্তরে ১৯১৫ খ্রীঃ) ১৭ই জুলাই পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত খানখানাপুর গ্রামে। পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন শিক্ষক, মা সুবর্ণপ্রভা এবং মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বিজন (ডাক নাম গোষ্ঠ) ভট্টাচার্য ছিলেন জ্যেষ্ঠ সন্তান। শিক্ষক পিতার আদর্শ, সঙ্গীতপ্রীতি, শেকসপিয়র-চর্চার প্রভাবে মানবিক উন্নতি এবং গ্রামের পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে আত্মিক সংযোগের অভিজ্ঞতায় তাঁর শৈশব ও কৈশোর জীবন হয় বৈচিত্র্যময়। যুগচেতনার বিশেষ আবহে এই অভিজ্ঞতা ব্যাপ্তি ও গভীরতা পায়। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতি, দেশে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম নীতি, মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ, বিশ্ব আলোড়নকারী রুশ বিপ্লব, ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম (১৯২২) ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহে এই সময়টি ছিল সুচিহ্নিত। স্বভাবতই এক সংগ্রাম মুখর সময় পরিবেশের মধ্যে বিজন ভট্টাচার্যের নাট্য-সত্তা বিকশিত হয়।
১৯৩০ খ্রীস্টাব্দে কলেজে শিক্ষালাভের জন্য তিনি কলকাতায় আসেন। প্রথমে আশুতোষ কলেজে, পরে রিপন কলেজে পড়াশুনা করেন ১৯৩১-৩২-এ শরীরচর্চার সঙ্গে জাতীয় আন্দোলনে এবং দেশের বামপন্থী আন্দোলনের কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন সংগঠনে যোগ দিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর ১৯৩৮-৩৯ খ্রীস্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে কাজ করার সূত্রে তাঁর কর্মজীবন এবং লেখক জীবনের সূচনা হয়। ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমেদের সংস্পর্শে এসে পার্টির সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৪৭-এ কবি মনীশ ঘটকের কন্যা মহাশ্বেতার সঙ্গে বিবাহ, ১৯৪৮-এ পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম, বিবাহিত জীবনে ভাঙন, দার্জিলিং ভ্রমণে বুকে আঘাত প্রাপ্তি ও ক্ষয়রোগ দেখা দেয়।
বিজন ভট্টাচার্যের সাহিত্যজীবনের সূচনা:
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম প্রকাশ গল্পকার রূপে। গল্পের নাম ‘জালসত্ত্ব’ (১৯৪০)। প্রথম দিকে রেবতী বর্মণের রচনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন। পরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠাকালে (১৯৪৩) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ডাকা ফ্যাসী-বিরোধী ‘জনযুদ্ধের’ আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাট্যকাররূপে ঘটে তার আত্মপ্রকাশ। যুদ্ধ, মন্বন্তর ও বন্যায় বিধ্বস্ত সারা দেশ তখন অগ্নিগর্ভ। মুম্বাইতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শাখা সংগঠন এদেশে বিভিন্ন জেলায় ও কলকাতায় স্থাপিত হয়। বিজন ভট্টাচার্য পার্টির এই সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নাটক লিখে, মঞ্চ নির্দেশনা দিয়ে এবং স্বয়ং অভিনয় করে তাঁর বৈপ্লবিক শিল্পীসত্তাকে প্রকাশ করেন। খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সহ অন্যান্য কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন। চিত্রনাট্য রচনাতেও তার পারদর্শিতা ছিল। সত্তরের দশকে নকশালদের কৃষিবিপ্লবকে সমর্থন করে নাটক রচনা করেন।
বিজন ভট্টাচার্যের রচনাসমূহ:
(ক) বিজন ভট্টাচার্যের নাটক: ‘আগুন’ (১৯৪৩), ‘জবানবন্দী’ (১৯৪৩, এই নাটকটির হিন্দী অনুবাদ হয় ‘অভিলাষ’ নামে), ‘নবান্ন’ (১৯৪৪), ‘‘অবরোধ’ (১৯৪৭), ‘জতুগৃহ’ (১৯৫২), ‘গোত্রান্তর’ (১৯৫৭), ‘মরা চাঁদ’ (১৯৬০), ‘’ছায়াপথ’ (১৯৬১), মাস্টার মশাই’ (১৯৬১), ‘দেবীগর্জন’ (১৯৬৬), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (১৯৬৬), ‘ধর্মগোলা’ (১৯৬৭), ‘গর্ভবতী জননী’ (১৯৬৯), ‘আজ বসন্ত’ (১৯৭০), ‘সোনার বাংলা’ (১৯৭১), ‘চলো সাগরে (১৯৭৭)।
একাঙ্ক : ‘মরা চাঁদ’ (১৯৪৬), ‘কলঙ্ক’ (১৯৫০), ‘জননেতা’ (১৯৫০), ‘সাগ্নিক’ (১৯৬৮), ‘লাস ঘুইরা যাউক’ (১৯৭০), ‘চুল্লী’ (১৯৭৪), ‘হাঁসখালির হাঁস’ (১৯৭৭)। রূপক-নাট্য : ‘স্বর্ণকুম্ভ’ (১৯৭০)। গীতিনাট্য : ‘জীয়ন কন্যা’ (১৯৪৭)। নাট্যরূপ এবং সম্পাদনা : ‘গুপ্তধন’ (১৯৭২), ‘নীলদর্পণ’ (১৯৭২)। নাট্যদল প্রতিষ্ঠা : ‘কবচকুণ্ডল’।
(খ) বিজন ভট্টাচার্যের উপন্যাস : ‘জনপদ’ (১৯৪৫), ‘রাণীপালঙ্ক’ (১৯৬০), ‘সোনালী মাছ’ (১৯৬২)।
(গ) বিজন ভট্টাচার্যের ছোটগল্প : ‘জালসত্ত্ব’ (১৯৪০), ‘জলসা’ (১৯৪৬), ‘জনপদ’।
(ঘ) বিজন ভট্টাচার্যের চিত্রনাট্য রচনা : ‘নাগিন’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘বসু পরিবার’, ‘তৃষ্ণা’, ‘ডাক্তারবাবু’ ইত্যাদি।
বিজন ভট্টাচার্যের গণনাট্যের উদ্ভব ও বৈশিষ্ট্য:
বর্তমান শতকের চতুর্থ দশক (বা বিংশ শতকের চল্লিশের দশক) থেকে রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তনে বাংলা নাটকে নতুন দিকপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সেই পরিবর্তনের এক অন্যতম চিহ্ন- ‘গণনাট্য’-সূচনা। এই নাট্য-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য স্বয়ং ‘নবান্ন’ নাটকের ভূমিকায় (চতুর্থ সংস্করণ) বলেছেন :- “সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এশিয়ায় যে গণ-অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছে, তাতে ভারতেরও মোহভঙ্গ হয়েছে। পূর্ণ স্বাধীনতা ভিন্ন আর কোন শর্তই তার পক্ষে প্রযোজ্য নয়। তাই ১৯৪২ সনের আগস্ট মাসে দেশব্যাপী যখন প্রত্যক্ষ গণ-অভ্যুত্থান আরম্ভ হল, ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক স্বার্থ বজায় রাখার শেষ প্রাণাস্তিক চেষ্টায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তখন সমস্ত হিংস্রতা নিয়ে ভারতের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। নিয়মতন্ত্র সম্মত ভাগ বাঁটোয়ারার পর নিরক্তের স্বাধীনতা এলো কালনেমীর অভিশাপ মাথায় করে। তাই বিনা রক্তপাতে অর্জিত স্বাধীনতার পাপক্ষালন হোলো আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। ‘নবান্ন’ নাটকের রচনাকাল এই রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের প্রারম্ভিক পর্বে।”
১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দের ২৫শে মে ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ (Indian People’s Theatre Association, IPTA) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংঘের উদ্দেশ্য ছিল ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের দাবী সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা”It is a move ment which seeks to make our arts the expression and organism of our people’s struggle for freedom, economic justice and a democratic culture.” (IPTA, Bulletine No. 1. 1943) ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘের ইস্তাহারে যে-কথা ঘোষণা করা হয়েছিল তা গণনাট্য আন্দোলনেরও মূল কথা—“ভারতের নবীন সাহিত্যিক বর্তমান জীবনের মূল সমস্যা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সামাজিক পরাঙ্মুখতা ও রাজনৈতিক পরাধীনতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।”
বিজন ভট্টাচার্যের পট-পরিবেশ:
এই আন্দোলনের পট-পরিবেশ হিসেবে স্মরণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও অব্যাহত; গান্ধীজীর আগস্ট আন্দোলন তখনও সক্রিয় এবং তার বিপরীতে ব্রিটিশ দমননীতি ভয়াবহরূপে প্রকট। অন্যদিকে শুরু হয়েছে হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ। দেখা গেছে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী পাশবিক মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ। এদেশে শ্রমিক-ধর্মঘট, নৌ-বিদ্রোহ, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য সংগ্রাম, আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির সংগ্রাম, চীনের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি চাঞ্চল্যকর ঘটনাধারার প্রকাশ ঘটে। জাতীয়ক্ষেত্রে দেখা দেয় আগস্ট আন্দোলন। অন্যদিকে মন্বন্তর, বন্যা আর মহামারীতে কবলিত হয় শহর ও গ্রাম বাংলার জনজীবন। এই প্রেক্ষাপটে গণনাট্যের জন্ম হয়। এই জাতীয় নাটকের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল- (ক) নাটকে সুতীব্র রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার প্রকাশ–‘শ্রেণী-চরিত্র বিশ্লেষণ’ শোষণের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নকে রূপ দেওয়া। (খ) ব্যক্তিমূলক একক অভিনয়ের পরিবর্তে গোষ্ঠী ঐক্যের প্রকাশ—একক নায়কের অবসান ঘটানো। (গ) নৈরাশ্যবাদ ও জীবনের অর্থহীনতাকে প্রকাশ করা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। (ঘ) দেশে-বিদেশে সমস্ত রকম অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ। (ঙ) ব্যয়বহুল মঞ্চসজ্জার রীতি পরিত্যাগ করে সাধারণের উপযোগী স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত মঞ্চোপকরণ ব্যবহার। (চ) গণসঙ্গীতের প্রচলন, গীতিকার সুরকারের বিশিষ্ট ভূমিকা পালন। (ছ) নাট্যশিল্পে প্রতীকী অভিনয়, মুকাভিনয়, নাচগান ইত্যাদির প্রয়োজনীয় প্রয়োগ প্রভৃতি।
গণনাট্য সংঘের উদ্যোগে অভিনীত হয় প্রথম নাটক বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ (এবং বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরী’) নাটকটি। পরে এটি ‘অরণি’ পত্রিকায় (এপ্রিল সংখ্যা, ১৯৪৩) মুদ্রিত হয়। ‘আগুন’ নক্সাধর্মী রচনা, কাহিনীর মধ্যে ধারাবাহিকতা অনুপস্থিত। খাদ্য সঙ্কটের প্রাক্কালে খাদ্যের তথা চালের সমবণ্টনের অসম্পূর্ণতাই এই নাটকের মূল বক্তব্য। কৃষক, শ্রমিক, শহুরে মধ্যবিত্ত, ওড়িয়া খদ্দের প্রভৃতি চরিত্রগুলির কোনটাই পূর্ণাঙ্গ নয়। এই অসম্পূর্ণতাই একে আশানুরূপ নাট্যসাফল্য দেয়নি। ‘জবানবন্দী’ একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারের দুঃখময় কাহিনী। এই নাটকের বিষয়বস্তু নাট্যকারের ভাষায় : “সেও এক সোনার ধানের দুঃস্বপ্ন মাঠের রাজা পরাণ মণ্ডল (‘জবানবন্দী’র নায়ক) যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে কোলকাতার ফুটপাতে না খেতে পেয়ে হুমড়ি খেয়ে মরেছিল।”
গণনাট্য সংঘের প্রথম সফল প্রযোজনা ‘নবান্ন’। বহুরূপী সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ শম্ভু মিত্র এবং বিজন ভট্টাচার্যের পরিচালনায় শ্রীরঙ্গমে (বর্তমানে বিশ্বরূপ) ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর থেকে নাটকটি সাতদিন ধরে অভিনীত হয়। অভিনয়ে ছিলেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, তৃপ্তি ভাদুড়ী (পরে মিত্র), গঙ্গাপদ বসু, মণিকুন্তলা সেন, শোভা সেন, সুধীপ্রধান, সজল রায়চৌধুরী, নিতাই ঘোষ, চারুপ্রকাশ ঘোষ, গোপাল হালদার প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিগণ। নাট্যকার নাটক রচনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেনঃ “ঘরে সেদিন অন্ন ছিল না, নিরন্নের মুখ চেয়ে সেদিন আমি নবান্ন লিখেছিলাম। নাটক আরম্ভ করেছিলাম ১৯৪২ সালের জাতীয় অভ্যুদয় আগস্ট আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে।” ভয়াবহ আগস্ট আন্দোলন ও পঞ্চাশের মন্বস্তরের পটভূমিতে নাটকটি লেখা হয়। এই নাটকে আমিনপুর গ্রামের চাষীরা নানা দুঃখভোগের পর নিরঞ্জন ও দয়াল মণ্ডলের নেতৃত্বে নবান্ন উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের শপথ নিয়েছে। নাট্যকার চারটি অঙ্কের ১৫টি দৃশ্যে (১ম ৫টি, ২য় ৫টি, ৩য় ২টি, ৪র্থ ৩টি) কাহিনী উপস্থিত করেছেন। মূল ঘটনাগুলি হলঃ আগস্ট বিপ্লব, বন্যা ও সাইক্লোন, অন্নাভাব ও রোগ, গ্রাম ত্যাগ এবং উদ্বাস্তুরূপে শহরে এসে নিদারুণ অভাবে পরিবারের কর্তার (প্রধান সমাদ্দার) মস্তিষ্ক বিকৃতি, নারী ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়া কৃষক বধূর দুরবস্থা, লম্পট ব্যবসায়ীদের চিত্র, সরকারী প্রচেষ্টায় কয়েক জনের গ্রামে ফেরা, চাষবাস করে নতুন ধানের ‘নবান্ন’ উৎসব পালন, বিকৃত মস্তিষ্ক কর্তার প্রত্যাবর্তন এবং সকলের সমবেত শপথে ভবিষ্যৎ দুর্ভিক্ষ রোধের প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। এইভাবে নাট্যকার নাটকের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন।
‘নবান্ন’ নাটকে বিজন ভট্টাচার্য প্রথাসিদ্ধ পথ পরিত্যাগ করে এক নতুন আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন ; যেমন (১) চারটি অঙ্কের নাটকের কাহিনী বিন্যাস, প্রতিটি অঙ্কের দৃশ্যগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ ; প্রতিটি অঙ্কের কোন না কোন সমস্যা উপস্থাপিত। (২) ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে নাটকীয়তা সৃষ্টি করে শেষে এক প্রবল ঘটনাগত নাটকীয়তা এনে দৃশ্যগুলির মধ্যে সমগ্রতার ভাব সঞ্চার করেছেন। (৩) নাটকের দৃশ্যে ইঙ্গিতময় পটভূমি রচনা করার জন্য পরবর্তী ঘটনার আভাস দেওয়া হয়েছে। (৪) নাট্য দৃশ্যের মধ্যে বিভাগ দেখিয়ে zonal acting-এর ব্যবহার করা হয়েছে।
বিজন ভট্টাচার্যের অন্যান্য নাটকগুলির বক্তব্য-বিষয়ও শোষণ-কেন্দ্রিক। মিল মালিকের মুনাফা লোভ এবং সামস্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে ভূমিচাষীদের বিক্ষোভের সফল রূপ ‘দেবীগর্জন’। জোতদার প্রভঞ্জন বেনামীতে সমস্ত জমি দখল করে। কৃষিঋণ আর কর্জ ধানের সুদ যোগাতে সর্বস্বান্ত হয় দরিদ্র ভুঁইচাষীর দল। প্রভঞ্জনের ধর্মগোলা তাদের উৎপাদিত ধানে পূর্ণ করে তারা হয় উপবাসী। শুধু তাই নয়, চাষীদের অন্দরমহলের দিকেও তাঁর দৃষ্টি পড়ে। সর্দারের নবযৌবনা পুত্রবধূ রত্না প্রভঞ্জনের জৈবিক বাসনার বলি হয়ে একদিন তার খোলান থেকে হয় নিরুদ্দিষ্টা। অবশেষে চাষীরা একত্র হয়, ধর্মগোলা আক্রমণের ডাক দেয়। প্রভঞ্জন লাঠিয়াল দিয়ে মোকাবিলা করতে চায়। কিন্তু উন্মত্ত জনতার আক্রমণে তারা পালায়। ধর্মগোলা লুঠ হয়। শেষে পলায়নে উদ্যত প্রভঞ্জনকে সকলে মিলে ঘিরে ধরে : “এইবার শুধু একটি কঠিন কর্তব্য। হাত বাড়িয়ে শস্ত্র খোঁজে মহাবলী। ঘুগরা মংলার হাতে টাঙি এগিয়ে দেয়। একটি মুহূর্ত মাত্র। দৃপ্ত ভঙ্গীতে দুহাতে মংলা ঘুরিয়ে ধরে টাঙি প্রভঞ্জনের মাথার ওপর। আশেপাশের সমস্ত অস্ত্রগুলি ঝিলিক দিয়ে ওঠে শত্রুকে লক্ষ্য করে।” এই শ্রেণী সংগ্রামের বক্তব্য পরবর্তীকালে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক দলের তাত্ত্বিক বক্তারাও স্বীকার করেছিলেন“আজ মনে হয়, মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘দেবীগর্জন’ ‘নবান্নে’র চেয়ে অনেক বেশি গণনাট্যের কাছাকাছি, কারণ শ্রেণী সংগ্রাম ও তার অবধারিত পরিণতির ছবিটি এখানে শুধুবাস্তবই নয়, অনেক বেশি বিশ্লেষণাত্মক”।
তার পরবর্তী নাটক ‘চলো সাগরে’র বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে রাজনীতিমূলক। কারণ সত্তরের দশকে নকশালবাড়ির সশস্ত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে এর (তৃতীয় নাটিকা) কাহিনী-অংশ। মাইকেল ও তার সঙ্গী জনৈক নরসিং রাজবংশী নকশালবাড়ি অঞ্চলে চা বাগানে কাজ করত। তার বন্ধু মাইকেলের জবানীতে, “গত চা-বাগিচা শ্রমিক আন্দোলনের সময় সাহেবের প্রতিবাদী হইয়ে হটাবাহার হইয়েছে। পরথম ছিল ভূমিহীন চাষী, দুই বছর অস্ত হয় বর্গাদার, ই বছর জোতদার উয়াক উঠবন্দী করাইছে।” আর একজন শ্রমিক সোমরার বাড়ি ছিল “বাংলা-বিহার বর্ডার সীমানা।” চিত্তরঞ্জন কারখানা করার জন্য একদিন বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়ি ঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা অনেকে মারা যায়। সোমরা শেষে চা-বাগানের ঠিকাদারের সঙ্গে পাড়ি দেয়। কিন্তু এসে দেখে এখানেও সেই একই অত্যাচার। প্রতিবাদে এখানেও শুরু হল যুদ্ধ, যার পরিণামে সে একসময় হল বিতাড়িত। কিন্তু নৈরাশ্যের আঘাতে সে নিশ্চিহ্ন হল না “ভাবতে ভাবতে মনটাক সমঝাইলম—ই একটা মস্ত ঠকবাজি। আমার দুনিয়াটাক আমাকই বনাইতে হবে।” এর পর শুরু হল কম্যুনিস্ট নেতা প্রভাত মজুমদারের নেতৃত্বে অঞ্চল জুড়ে সশস্ত্র আন্দোলন। মিলিটারি নামল, গুলি চলল। বিপ্লবী কর্মীরা আলোচনায় বসল। ৩নং বিপ্লবী কর্মী বললেন“শোধনবাদীদের চোেখ পোড়াবাড়ির ভূমিহীন চাষী ও ক্ষেতমজুরদের জমির লড়াইকে বিচার করে আমাদের রাজনৈতিক হঠকারী সাব্যস্ত করলে পার্টি নেতৃত্বের উপর যাঁরা অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মারছেন, তাঁদের প্রতিও-আর আমাদের আস্থা রেখে চলা সম্ভব হবে না।” এর বিপরীতে ২নং বিপ্লবী বলেছেন: “স্থান-কাল অবস্থা অস্বীকার করে অতিবিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী নির্দেশে দেশের জনসাধারণের মহা অকল্যাণ করা হবে। জমির লড়াইকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পর্যায়ে নিয়ে যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জনসাধারণকে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করুন।” এই ধরনের বিবাদ-বিসংবাদের পর একসময় মিলিটারী আসে। বিপ্লবীরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রভাতের স্ত্রী কালিন্দী তাদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। প্রভাতরা আত্মসমালোচনায় পথ খুঁজতে থাকেন।
বিজন ভট্টাচার্যের অন্যান্য নাটকগুলির বিষয়বস্তুর মধ্যেও বৈচিত্র্য দেখা যায়‘মরা চাঁদ’ এক যুগসচেতন রাজনৈতিক কর্মী অন্ধ হতাশ গায়ককে উদ্বোধিত করার কাহিনী। ‘কলঙ্ক’ বাঁকুড়ার সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবন নিয়ে লেখা নাটক। ‘গোত্রান্তরের’ বিষয়বস্তু পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ভাগ্যবিপর্যয়ের কাহিনী। ‘অবরোধে’ দেখা গেছে মিল মালিকের মুনাফা লোভ ও শ্রমিক শোষণের নগ্ন রূপ। ‘জীয়নকন্যা’ মনসার ভাসান বিষয়ে গীতিনাট্য। ‘গর্ভবতী জননী’ বাদা অঞ্চলের অধিবাসী বেদেদের ব্রতকথা নিয়ে লেখা নাটক। সাময়িক নৈরাশ্য কাটিয়ে মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য যৌবন-বসন্ত শক্তির প্রকাশ দুটি ছেলেমেয়ের জীবন অবলম্বনে দেখানো হয়েছে ‘আজ বসন্ত’ নাটকে।
বিভিন্ন ধরনের নাটক রচনার মধ্য দিয়ে বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে দেখা গেছে— (১) শ্রেণী-নির্যাতন ও শোষণ এবং জনগণের সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ ও সংগ্রামের চিত্র। (২) জীবন-সম্পর্কে বলিষ্ঠ আশাবাদী চেতনা। (৩) লৌকিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রাণচেতনাকে জাগাবার চেষ্টা। (৪) অবক্ষয়িত মধ্যবিত্তের সংগ্রামী-রূপের পরিচয়। (৫) বিষয়-অনুযায়ী নাটকীয় আঙ্গিক ব্যবহার।
বাংলা নাটকের এই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব গণনাট্য ছেড়ে কেন চলচ্চিত্রে চলে গেলেন সে ইতিহাস আজও হয়ত তেমনভাবে লেখা হয়নি। বস্তুত, গণনাট্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক, শম্ভু মিত্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং শেষে দূরত্ব, সত্তরের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাবে নাট্য রচনার পরিবর্তন ধারা ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলি নিয়ে পরিপূর্ণ তথ্যময় বিবরণ দিয়ে একখণ্ড ইতিহাস লেখা হতে পারে। তবু বাংলা গণনাট্যে তার পথিকৃতের ভূমিকা কোন মতেই বিস্মৃত হবার নয়।
Leave a comment