বাধাবিঘ্ন ও কুসংস্কারের মায়াজাল ছিন্ন করে যে সমস্ত অন্তঃপুরবাসিনী বঙ্গললনা শিক্ষার অমল ধবল কিরণধারায় অবগাহন করেছিলেন, স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁদের মধ্যে অন্যতমা। মনস্পতি রবীন্দ্রনাথের অগ্রজারূপেই কেবল তাঁর খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, তিনিই প্রথম বঙ্গমহিলা— সাহিত্যের সর্বতোমুখী পথে ছিল যাঁর স্বচ্ছন্দ পরিভ্রমণ।
স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম ও কর্মজীবন:
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী ১৮৫৫ খ্রীস্টাব্দের ২৮শে আগস্ট (বঙ্গাব্দ ১২৬৫, ভাদ্রমাস) জন্মগ্রহণ করেন। গৃহে বিদ্যাচর্চা করেই তিনি বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজী ভাষায় ব্যূৎপন্ন হন। ১৮৬৭ খ্রীঃ ১৭ই নভেম্বর জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। এই জানকীনাথের উৎসাহে তাঁর শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চা, বহুদূর অগ্রসর হয়।
লেখিকা নিজেই সে সম্পর্কে স্মৃতিচারণায় বলেছেন— “It was my loving and revered father, Maharshi, Devendra Nath Tagore, who had prepared me for my life’s career by giving me an education unusual for Hindu girls of those days. Still, but for the help and encouragement given to me by my beloved husband, I do not think that it would have been possible for me to venture so far. It was he who moulded and shaped me in the fashion that the outside world knows today, and under his loving guidance I passed through stormy waves of literary life as easily and pleasantly; as a good swimmer through a rough sea.” (‘The Fatal Garland’ গ্রন্থের ভূমিকায় উদ্ধৃত)।
শৈশবেই স্বর্ণকুমারীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সঙ্গীত ও সাহিত্যানুরাগ। তিনি ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা ‘ভারতী’ সম্পাদনা করেছিলেন দুবার, যথাক্রমে ১২৯১ থেকে ১৩০২ সাল এবং ১৩১৫ থেকে ১৩২১ সাল পর্যন্ত। পরে তিনি এই পত্রিকা সম্পাদনার দাযিত্ব তার দুই কন্যা হিরণ্ময়ী ও সরলা দেবীর উপর অর্পণ করেন। স্বামী জানকীনাথের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী থিয়সফিতে বিশ্বাসী হন এবং বাংলাদেশে থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির মহিলা শাখার সভাপতি হন, পরে ‘সখি সমিতি’ গঠন করেন। কন্যা হিরণ্ময়ীর ‘বিধবা শিল্পাশ্রম’ গঠনে সহযোগিতা করেন এবং তার সমস্ত পুস্তকের গ্রন্থস্বত্ব ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে এই শিল্পাশ্রমকে দান করেন। শুধু তাই নয়, জানকীনাথের উৎসাহে তিনি কংগ্রেসেও যোগদান করেন। ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রতিনিধি হন এবং বহু দেশাত্মবোধক গান লিখে স্বদেশী মন্ত্রে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেন। সাহিত্যসম্রাজ্ঞী স্বর্ণকুমারী বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনীর কলকাতা অধিবেশনে (১৯২৮ খ্রীঃ) সভাপতিত্ব করেন। ১৯২৭ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ দেওয়া হয়। মহিলাদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম এই সম্মানের অধিকারিণী হন। ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দের ৩রা জুলাই (বঙ্গাব্দ ১৩৩৯, ১৯শে আষাঢ়) তার জীবনাবসান ঘটে।
স্বর্ণকুমারী দেবীর রচনাসমূহ:
(১) স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাস : ‘দীপ-নির্বাণ’ (১৮৭৬), ‘ছিন্নমুকুল’ (১৮৭৯), ‘মালতী’ (১৮৮০), ‘মিবাররাজ’ (১৮৮৭, ঐতিহাসিক উপন্যাস), ‘হুগলীর ইমামবাড়ী’ (১৮৮৮, ঐতিহাসিক উপন্যাস), ‘স্নেহলতা’ (প্রথম খণ্ড ১৮৯০, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৯৩ সামাজিক উপন্যাস), ‘বিদ্রোহ’ (১৮৯০, ঐতিহাসিক উপন্যাস), ‘ফুলের মালা’ (১৮৯৫), ‘কাহাকে’? (১৮৯৮), ‘রাজকন্যা’ (১৯১৩, নাট্যোপন্যাস), ‘বিচিত্রা’ (১৯২০), ‘স্বপ্নবাণী’ (১৯২১), ‘মিলনরাত্রি’ (১৯২৫)।
(২) স্বর্ণকুমারী দেবীর গল্পগ্রন্থ : ‘নবকাহিনী’ (১৮৯২), ‘গল্পসল্প’ (১৮৮৯)।
(৩) স্বর্ণকুমারী দেবীর নাটক-প্রহসন : ‘বসন্ত উৎসব’ (১৮৭৯, গীতিনাট্য), ‘বিবাহ উৎসব’ (১৮৯২), ‘কৌতুকনাট্য ও বিবিধ কথা’ (১৯০১), ‘দেবকৌতুক (১৯০৬, কাব্যনাট্য), “কনে বদল’ (১৯০৬, প্রহসন), ‘পাকচক্র (১৯১১, প্রহসন), ‘নিবেদিতা’ (১৯১৭), ‘যুগান্ত কাব্যনাট্য’ (১৯১৮)।
(৪) স্বর্ণকুমারী দেবীর বৈজ্ঞানিক পুস্তক : ‘পৃথিবী’ (১৮৮২)।
(৫) স্বর্ণকুমারী দেবীর কাব্য-কবিতা : ‘হাসি ও অশ্রু’ (১৮৯৫), ‘কবিতা ও গান’ (১৮৯৫)।
(৬) স্বর্ণকুমারী দেবীর শিশুপাঠ্য ও অন্যান্য রচনা গ্রন্থ : ‘সচিত্র বর্ণবোধ’ (১৯০২), ‘বাল্যবিনোদ’ (১৯০২), ‘আদর্শনীতি’ (১৯০৪), ‘প্রথম পাঠ্য ব্যাকরণ’ (১৯১০), ‘বিদায় গ্রহণ (১৩২২ বঙ্গাব্দ)।
(৭) স্বর্ণকুমারী দেবীর পত্রিকা সম্পাদনা : ‘ভারতী’ সম্পাদনা (১২৯১-১৩০২ বঙ্গাব্দ এবং ১৩১৫-১৩২১ বঙ্গাব্দ), ‘গাজীপুর’ পত্র (১২৯৬ বঙ্গাব্দ), ‘সখিসমিতি’ পত্রিকা (১৮৮৬)।
(৮) স্বর্ণকুমারী দেবীর সম্মান, সভ্যপদ গ্রহণ এবং পুরস্কারলাভ : লেডিস থিয়সফিক্যাল সোসাইটির সভানেত্রী (১৮৮২-১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত), সখিসমিতি স্থাপন (১২৯৩ বঙ্গাব্দ), কংগ্রেসের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ অধিবেশনে যোগদান (১৮৮৯ এবং ১৮৯০খ্রীঃ), বিধবা-শিল্পাশ্রম প্রতিষ্ঠা (১৯০৬), ‘জগত্তারিণী’ স্বর্ণপদক লাভ (১৯২৭), কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভানেত্রীর পদ গ্রহণ (মাঘ, ১৯-২১, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ)।
বঙ্গললনাদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী প্রথম ঔপন্যাসিক, যিনি ঐতিহাসিক এবং সামাজিক দু’ধরনের উপন্যাস লিখেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দীপ-নির্বাণ’ এর বিষয়, ইতিহাসে বর্ণিত পৃথ্বীরাজ এবং মহম্মদ ঘোরীর মধ্যে সংঘর্ষ। জাতীয়তাবাদ তথা দেশপ্রেম এর মূল প্রেরণা। এখানে হিন্দু রাজাদের পরস্পরের মধ্যে যখন গৃহবিবাদ দেখা দিয়েছিল তখন মুসলিম যোদ্ধারা কিভাবে সুযোগ বুঝে হিন্দু রাজগণের অনিষ্ট সাধন করেছিল তা এই গ্রন্থে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। তার পরবর্তী উপন্যাস ‘ছিন্নমুকুল’ একটি সামাজিক বৃত্তান্ত। উন্নতিশীল আধুনিক বঙ্গীয় সমাজের কয়েকটি চরিত্র-কথা, একটি প্রণয়কাহিনী ও আনুষঙ্গিক ঘটনা পরম্পরা চিত্রিত হয়েছে। সমাজ চিত্রণের দায়টি এখানে রোমান্টিক হওয়ায় সর্বাংশে বাস্তবচিত্র আত্মপ্রকাশ করে নি।
তার ‘মিবাররাজ’ এবং ‘বিদ্রোহ’ উপন্যাসের বর্ণিত বিষয়, রাজপুতদের শৌর্য-বীর্যের জয়গান। ‘বিদ্রোহ’ উপন্যাসটিতে অষ্টম শতাব্দীর মধ্য পর্বে মেবারের প্রথম রাজা গেহর অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্র নাগাদিত্যের সময়ে যে ভীষণ ভীলবিদ্রোহ ঘটে তার মূল কারণসমূহ বিবৃত হয়েছে। হুগলীর ইমামবাড়ী উপন্যাসে দানবীর ফকিরসম কোটিপতি মহম্মদ মহসীন এবং তাঁর ভগিনী মুন্নার মহিমা বিবৃত হয়েছে, এখানে ইমামবাড়ীর আনুপূর্বিক ইতিহাস ও হুগলীর ইতিহাস বিবৃত হয়েছে। এই গ্রন্থ সম্পর্কে গবেষকের অভিমত হল : “হুগলীর ইমামবাড়ীকে লেখিকা ঐতিহাসিক উপন্যাস বলিয়াছেন। ইহাকে বরং হাজি মহম্মদ মহসীনের উপাখ্যান বলা যাইতে পারে”
স্বর্ণকুমারীর ‘স্নেহলতা’ এবং ‘কাহাকে’ গার্হস্থ্য উপন্যাস। এখানেও দেখা গেছে এক রোমান্টিক ভাবমণ্ডল। ‘স্নেহলতা’য় কৌলীন্যপ্রথার তীব্র সমালোচনা আছে, যেমন জনৈক মহিলার উক্তিতে“বাইশ বছরে ছয়টা বিয়ে বেশি হইল? আমার কর্তা নব্বই বৎসর বয়সে একশ’র বেশী বিয়ে করিয়াছিলেন। কুলীনের শিরোমণি—অমন কুল কি আর আছে?” কিন্তু তবু বাল্যবিধবা স্নেহলতার সঙ্গে চারুর প্রণয়দৃশ্য বর্ণনা করেও লেখিকা সমাজ-সংসারের কল্যাণের কথা ভেবে উভয়ের মধ্যে লৌকিক বিবাহ ঘটাতে চাননি। তাই বিবাহের প্রস্তাবে স্নেহলতা চারুকে বলেছে : “তাহলে তোমার বাপ-মা তোমাকে ত্যাগ করবেন, সমাজ ত্যাগ করবে, এখন তুমি যাকে সুখ ভাবছ তা তোমার চিরস্থায়ী অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।” সমকালের সামাজিক-ধর্মীয় বিতর্ক ও আন্দোলনের প্রত্যক্ষ আলেখ্য এই উপন্যাসে বিস্তৃতভাবে দেখানো হয়েছে। বিধবার পুনর্বিবাহদান প্রসঙ্গে স্বর্ণকুমারীর চিন্তাধারার মধ্যে কিছু স্বাতন্ত্র্য দেখা যায়; যেমন তিনি বিধবাদের লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের আত্মনির্ভর করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই উপন্যাসের একটি অন্যতম চরিত্র জগৎবাবুর মধ্যে তাঁর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
স্নেহলতার মৃত্যুর পর জগৎবাবু ভেবেছিলেন “স্নেহকে লেখাপড়া না শিখাইলে সে বেশ সন্তুষ্ট চিত্তে আপনার অদৃষ্ট বহন করিতে পারিত, আপনার অধঃপতন মৃত্যু আপনি ডাকিয়া আনিত না।” এই হতাশা ও ক্ষোভের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলা লেখিকা যুক্তির এক সুক্ষ্ম সংশয় তুলে ধরেছেন। কারণ “যুক্তি যদি ভেতর থেকে মনকে নাড়া দেয় তাহলে উপেক্ষিত জীবনের বঞ্চনা ও ক্ষোভকে অদৃষ্ট বলে মেনে নেবার অপরিসীম শক্তির ভিত আসে দুর্বল হয়ে। নারী হয়ে স্বর্ণকুমারী এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারেননি। তাই বিধবাদের আত্মনির্ভরতা এবং অর্থোপার্জনের পথ দেখিয়ে দিলেই যে সব হল না সেটা তিনি জানতেন। ‘হিরণ্ময়ী বিধবা শিল্পাশ্রমে’র জন্য লেখা ‘নিবেদিতা’ নাটকেও তিনি এই সমস্যার আর একটি কুৎসিৎ রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে কোথাও তিনি সমাধানের পথ দেখাতে পারেননি এমনকি সে চেষ্টাও করেননি। তবু মনে হয় তিনি বিধবা মেয়েদের সমাজের মধ্যে সসম্মানে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সম্মানের পরিবর্তে শুধু অন্নের সংস্থান, অর্থোপার্জন শিক্ষা এমনকি পুনর্বিবাহ তাঁর মতে, কোন নারীকে পূর্ণ করে তুলতে পারে না” (দ্রষ্টব্য : ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’, চিত্রা দেব, প্রথম সংস্করণ, অষ্টাদশ মুদ্রণ, ১৮০৩, পৃষ্ঠা ৫০)।
‘কাহাকে’ উপন্যাসের নায়িকার মধ্যে দেখা যায় সূক্ষ্ম মনোবিশ্লেষণ, বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ এটি তার শ্রেষ্ঠতম অবদান। এই উপন্যাসে মহিলাসুলভ রচনা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এখানে অন্য কোন রকম সামাজিক সমস্যার পরিবর্তে প্রাধান্য পেয়েছে এক আধুনিকা নারীর আত্মকথন। শিক্ষিতা এক আধুনিকা নারী নিজেকে বিশ্লেষণ করে তার ভালোবাসার স্বরূপ সন্ধান করেছে। একাধিক সমালোচক এই উপন্যাসের মধ্যে লেখিকার নিজস্ব সমাজ পরিবেশের সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। তবে এটি আত্মজীবনীমূলক নয়। বাঙালী পাঠক-সমাজের সীমানা ছাড়িয়ে ‘কাহাকে’ উপন্যাস এক সময় বিদেশীদেরও মুগ্ধ করেছিল। এই উপন্যাসটি ‘An unfinished Song’ নামে লেখিকা নিজেই অনুবাদ করেছিলেন।
১৯১০ খ্রীস্টাব্দে ‘To Whom’ নামে কলকাতা থেকে এর আর একটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছিলেন স্বর্ণকুমারীর ভাইঝি, শোভনা, তবে স্বর্ণকুমারীর লেখাটিই অধিকতর স্বচ্ছন্দ ছিল। লন্ডন থেকে যথাক্রমে ১৯১৩ এবং ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে গ্রন্থটির দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। চিত্রা দেবের জবানী থেকে জানা যায় : “লন্ডন থেকেই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর।” ১৮৭৬-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯১৩-র ডিসেম্বর—দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে স্বর্ণকুমারী এসে দাঁড়ালেন শীতার্ত রজনীর তুষার-কুয়াশাঢাকা লন্ডনবাসী পাঠকের কাছে। তারা দেখলেন একটি বিদেশী বই, শেষ করে মনে হল অসমাপ্ত গানের কলি যেন। ঝরে পড়ল মুগ্ধ পাঠকের প্রশংসাবাণী : “Remarkable for the picture of Hindu life and the story is overshadowed by the personality of the authoress, one of the foremost Bengali writer to-day.” (Clarion)
আর একটু সোচ্চার প্রশংসা করলেন ‘ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেটের’ সম্পাদক : “Mrs. Ghosal, as one of pioneers of the women movement in Bengal, and fortunate in her own upbring, is well qualified to give this picture of a Hindu maiden development.”
স্বর্ণকুমারীর ‘ফুলের মালা’ উপন্যাসটিও অনূদিত হয়। অনুবাদিকা ছিলেন ক্রিস্টিনা আলবার্স। ‘Modern Review’ পত্রিকায় ‘The Fatal Garland’ নামে প্রকাশিত হয়। তবে এই অনুবাদ রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেনি। ইন্দিরা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে (৬.৫.১৯১৩) তিনি বলেছেনঃ “নদিদি আমাকে তাঁর ‘ফুলের মালার’ তর্জমাটা পাঠিয়েছিলেন। এখানকার সাহিত্যের বাজার যদি দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন এসব জিনিস এখানে কোনমতেই চলতে পারে না। এরা যাকে reality বলে সে জিনিষটা থাকা চাই।”
স্বর্ণকুমারী দেবীর ছোটগল্প:
স্বর্ণকুমারী বেশ কয়েকটি ছোটগল্প লিখেছিলেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মালতী’, ‘লজ্জাবতী’, ‘গহনা’, ‘যমুনা’, ‘কুমার ভীমসিংহ’ ইত্যাদি। ইংরেজীতে গল্পগুলি short stories’ নামে অনূদিত হয়।
স্বর্ণকুমারী দেবীর নাটক:
নাটক রচনার ক্ষেত্রে স্বর্ণকুমারী সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর ‘বসন্তোৎসব’ নাটকটি অপেরাধর্মী এবং বাংলা সাহিত্যে সম্ভবতঃ এজাতীয় নাটক প্রথম লেখা হয়— “ইদানীংকালে হয়ত অনেকেই ভুলে গেছেন যে, বাংলায় অপেরাধর্মী গীতিনাটিকা লেখার ব্যাপারেও স্বর্ণকুমারী পথিকৃতের গৌরব দাবি করতে পারেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ এমনকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘মানময়ী’রও আগে রচনা করেন বসস্ত উৎসব” (দ্রষ্টব্যঃ “ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৪৪) তাঁর ‘দিব্যকমল’ নাটকটি জার্মান ভাষায় ‘Princess Kalyani’ নামে অনূদিত হয়।
স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রবন্ধগ্রন্থ:
বাংলা ভাষায় জ্ঞানগর্ভ বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধ রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম পথ-প্রদর্শক। আর বঙ্গমহিলাদের মধ্যে স্বর্ণকুমারীই প্রথমা। তাঁর ‘বিজ্ঞানরহস্য’ (১৮৭৫) গ্রন্থ প্রকাশের মাত্র সাত বছর পরে স্বর্ণকুমারী লেখেন ‘পৃথিবী’ (১৮৮২) নামে অনবদ্য গ্রন্থ। বিজ্ঞানসাধক রামেন্দ্রসুন্দর তখনও সাহিত্যের আসরে দেখা দেননি। তার আগেই স্বর্ণকুমারী “নবজাগ্রত বাঙালী মানসে পৃথিবী সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের যথাসম্ভব ভাল উত্তর দেবার জন্যে” বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভূ-বিজ্ঞানীদের মতামত সংকলন করে সাতটি প্রবন্ধ লিখলেন। এঁরা হলেন লাপলাস, হারসেল, টমসন, নর্মান, লাকিয়ার, গডফ্রে, ব্যালফোর, ফিগুয়ে প্রমুখ। এই গ্রন্থের অন্যতম অবদান হল, লেখিকা কর্তৃক সহজ ও সুশ্রাব্য বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সৃষ্টি; যেমন—ফার্ণ=পর্ণীতরু, পেনামব্রা=উপচ্ছায়া, সোলারস্পট= সূর্যবিম্ব, ট্রায়াসিক=ত্রিস্তর প্রভৃতি। এই ধরনের সুনির্বাচিত শব্দ দিয়ে পরিভাষা সৃষ্টিতে লেখিকার সচেতন মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
স্বর্ণকুমারী দেবীর পত্রিকা পরিচালনা:
পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও স্বর্ণকুমারীর ভূমিকা গৌরবময়। ১৮৭৫ খ্রীঃ থেকে ১৯১০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে অন্তত ২৬ জন সম্পাদিকার আবির্ভাব হয়েছিল। এঁদের মধ্যে স্বর্ণকুমারীর স্থান দ্বিতীয়। নতুন বৌঠানের মৃত্যুর পর এক চরম দুর্দিনে ‘ভারতী’ পত্রিকাটি উঠে যাবার মুহূর্তে স্বর্ণকুমারী ১২৯১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে সম্পাদনা ভার গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স মাত্র ঊনত্রিশ। প্রথম পর্যায়ে একটানা বারো বছর এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সাত বছর ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী। একসময় সম্পাদনার ভার অর্পণ করেছিলেন দুই মেয়ে হিরণ্ময়ী ও সরলাদেবীর হাতে। স্বর্ণময়ীর সম্পাদনাকালে ‘ভারতী’তে প্রবীণ নবীন সব মিলিয়ে লেখক-লেখিকার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৬৬ জন। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের মধ্যে ছিলেন রামদাস সেন, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ। নবীনদের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার বড়াল, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, দেবেন্দ্রনাথ সেন, সরোজকুমারী দেবী, প্রমীলা নাগ, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, বনোয়ারীলাল গোস্বামী, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, জলধর সেন, দীনেন্দ্রকুমার রায় ইত্যাদি। স্বর্ণকুমারী অন্যের লেখা সংশোধন পরিমার্জন ব্যাপারে এক নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। সেই যুগের চিত্ররচনায় একজন লেখক বলেছেন— “স্বর্ণকুমারীর জানতে বাকি ছিলো না যে তিনি বেশি কাটাকাটি করলে লেখকেরা রাগ করবেন নিঘাত এবং অনেক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। তাই তিনি অন্য রাস্তা নিলেন। যে যে লেখা কিছু বদলালে ঠিক হবে মনে করতেন সেই সেই লেখা ফেরৎ পাঠিয়ে সঙ্গে ‘সবিনয় নিবেদন’ চিঠি মারফৎ জানাতেন যে, ঐ লেখা প্রাথমিকভাবে মনোনীত হয়েছে—কিন্তু এই জায়গায় এই আপত্তি—লেখক মহাশয় যদি সেগুলি সংশোধন করে পাঠিয়ে দেন, তাহলে ছাপার আর কোন বাধা থাকবে না। পরবর্তী বাংলা সাময়িক পত্রের কোনো কোনো সম্পাদক ওঁর এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন।” (দ্রষ্টব্যঃ ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং’, সুজিতকুমার সেনগুপ্ত, ১৩৯৮, পৃষ্ঠা ৬৬)।
বস্তুত, পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ব্যাপারে সম্পাদিকার মতামতের প্রাধান্য স্বর্ণকুমারী স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন – “স্বর্ণকুমারী একেবারে সাফ জানিয়েছিলেন তাঁর মতের সঙ্গে মিল থাক আর নাই থাক, লেখা যোগ্য হলেই তা ‘ভারতী’তে স্থান পাবে, কারণ জ্ঞানের পুষ্টি সাধনের জন্য এক-একটি প্রস্তাবিত বিষয় নিয়ে, তাকে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে নানাভাবে দেখা দরকার”।
ভারতীতে প্রকাশিত স্বর্ণকুমারীর গদ্য নমুনা:
“মাতা-পিতা আত্মীয়স্বজন ছাড়িয়া শ্বশুরালয়ে যাইবার সময় কন্যা গভীর দুঃখে অশ্রুজল ফেলিতে থাকেন, তাহার পিতামাতা স্বজনবর্গও দুঃখে অভিভূত হইয়া পড়েন, তাঁহাদের সাধের প্রতিমা পরের ঘরে প্রতিষ্ঠিত হইতে চলিল— তাঁহাদের মত যত্ন আদর তাহাকে আর কে করিবে। কিন্তু শ্বশুরালয়ে আসিয়া কন্যা যখন দেখিতে পায় এখানেও তাহাকে আদর করিবার, এখানেও তাহার মলিন মুখ দেখিলে প্রাণে ব্যথা পাইবার লোক আছে, তখন সেই যত্নে সেই আদরে কন্যা ক্রমে প্রফুল্লচিত্ত হইয়া উঠে এবং কন্যাকে সুখী দেখিয়া কন্যার পিতামাতা আত্মীয়বর্গও তখন সুখী হইয়া থাকেন, ‘ভারতী’র সম্বন্ধেও আমরা পাঠকদিগকে বিনীতভাবে বলিতেছি যে ‘ভারতী’ আমাদের হাতে অযত্নে পড়িবেন না। ‘ভারতী’র পূর্বতন বন্ধুগণ তাঁহার মঙ্গলের নিমিত্ত যেরূপ শ্রম স্বীকার করিতেন আমরাও ‘ভারতী’র জন্য সেরূপ শ্রম স্বীকার করিতে চেষ্টা করিব।”
সাহিত্য রচনায় কেবল নয়, ‘সখি সমিতি’ এবং ‘মহিলা শিশুমেলা’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও স্বর্ণকুমারীর সংগঠন-প্রতিভার নিপুণ স্বাক্ষর সুস্পষ্ট। সর্বতোমুখী প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত সাহিত্যসম্রাজ্ঞী স্বর্ণকুমারীর প্রতিভার যথোচিত সমাদর হয়নি। অথচ তার রচনাবলী যে বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ সে কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
Leave a comment