রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসমূহ
১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দে কিশোর রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীর প্রেরণায় প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন ‘করুণা’। প্রায় বছর খানেক ধরে ‘ভারতী’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়। তবে স্বয়ং লেখক এর প্রতি কোনো গুরুত্ব দিয়ে গ্রন্থভুক্ত করেননি। পরবর্তী কয়েকটি মাত্র উপন্যাস গ্রন্থগৌরব লাভ করেছে।
বিষয়-বৈচিত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্র-উপন্যাসগুলিকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে—
(ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস : ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩), ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭)।
(খ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামাজিক উপন্যাস : ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৩)।
(গ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশচেতনামূলক উপন্যাস : ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬), ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)।
(ঘ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোমান্টিক উপন্যাস : ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬), ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪)।
কালগত বিচারে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস ঊনবিংশ শতকের বাংলা উপন্যাস ধারার অন্তর্ভুক্ত। পূর্বসূরী বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই খুব সম্ভবতঃ তার ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্টিক উপন্যাস রচনার প্রেরণা লাভ। কিন্তু দৃষ্টিকোণে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল মেরুপ্রমাণ। ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে ইতিহাসের অংশটি হল রাজা প্রতাপাদিত্যের কাহিনী। তবে প্রতাপের পিতৃব্য বসন্ত রায়, পুত্র উদয়াদিত্য এবং কন্যা বিভা-র অনৈতিহাসিক কাহিনী অংশই প্রধান। প্রতাপের নির্মম অমানবিক আচরণে কিভাবে অন্তঃপুরের শাস্তি ধ্বংস হল, ছেলে-মেয়ের জীবনে বিপর্যয় ঘটল, পিতৃব্য নিহত হলেন, সেই বেদনাময় করুণ কাহিনীই এই উপন্যাসের উপজীব্য। কাহিনী-বয়নে ও চরিত্র-চিত্রণে পরিণত প্রতিভার অভাব সুস্পষ্ট। তবে প্রতাপের স্বৈরাচারী শক্তির বিপক্ষে উদয়াদিত্যের প্রেমশক্তির গৌরবময় ভূমিকা নির্দেশে ঔপন্যাসিকের জীবন দর্শনের আভাস মেলে। দ্বিতীয়ত, প্রতাপাদিত্যকে আদর্শ বীর ও মহৎ শাসক বলে চিত্রিত না করে তার চরিত্রগত ত্রুটিগুলির উল্লেখে লেখকের সমকালীন চিন্তাধারা থেকে স্বাতন্ত্র্যের দিকটি সুস্পষ্ট হয়। খুব সম্ভবত প্রতাপচন্দ্র ঘোষের ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ উপন্যাসে বর্ণিত প্রতাপ চরিত্রের অনুসরণেই প্রতাপাদিত্যের এই নির্মম রূপটি অঙ্কিত হয়। ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ অপেক্ষা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি অনেক পরিণত ও শিল্পগুণান্বিত রচনা। এই উপন্যাসের কাহিনীর উৎস, ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস উপন্যাসের পটভূমি ত্রিপুরা, উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজা গোবিন্দমাণিক্য ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে বলিদান বন্ধ করে দেওয়ায় রাজা ও পুরোহিত রঘুপতির মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে। রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায় রঘুনাথের পক্ষে যোগ দিলে দ্বন্দ্ব জটিল হয়ে ওঠে। শেষে রঘুপতির পালিত পুত্র জয়সিংহের আত্মদানে এই বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। এখানে প্রেম ও হিংসার মধ্যে দ্বন্দ্বের যে ভাবরূপটি মূর্ত হয়েছে, তা কবির স্বপ্নে দেখা একটি ঘটনা থেকে প্রাপ্ত। প্রথা ও সংস্কারের চেয়ে মানবিক আদর্শের স্নেহ প্রেম-ভালোবাসার প্রভাব যে কত গভীর তা জয়সিংহ হারা রঘুপতির হাহাকারের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসের উপাদান থেকে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ এবং ‘রাজর্ষি’ থেকে ‘বিসর্জন’ নাটক লেখা হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তুলনা:
ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সংযোগরেখা খুব স্পষ্ট নয়, বরং বৈপরীত্যই ছিল বেশি; যেমন—
(১) বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশীয়ানার সুগভীর আবেগ রবীন্দ্র-উপন্যাসে অনুপস্থিত। এখানে চরিত্রগুলি যতটা ইতিহাসনিষ্ঠ, তার তুলনায় অনেক পরিমাণে ভাব বা তত্ত্বের বাহন; যেমন রাজা গোবিন্দমাণিক্য বা জয়সিংহ প্রেমধর্মের তথা মানবিক আদর্শের প্রবক্তা, উদয়াদিত্যও প্রজা-নিপীড়নের পরিবর্তে সহৃদয় আচরণে বিশ্বাসী ইত্যাদি ভাববাদী আচরণ দেখা যায়।
(২) বঙ্কিম-উপন্যাসে কাহিনীর দৃঢ়পিনদ্ধ ভাব ও দুর্বার গতি রবীন্দ্র-উপন্যাসের প্রাথমিক পর্যায়ে বিরলদৃষ্ট। চরিত্র নিয়ন্ত্রণের কুশলতাও বঙ্কিম উপন্যাসে অধিক বলে -মনে হয়।
(৩) রোমান্সের মায়াবিস্তার ও কল্পনার ইন্দ্রধনুচ্ছটায় বঙ্কিম-উপন্যাসের কাহিনী জগৎ আলোকিত হয়। সেই রূপকথার রাজ্য ছেড়ে কিশোর রবি কিন্তু স্বেচ্ছায় যে জগতে নেমে এসেছেন তা কিন্তু ধূসর ইতিহাসমাত্র নয়। তা অনেক পরিমাণে বাস্তব এবং সহজ সাধারণ হয়ে উঠেছে।
(৪) নামকরণের দিক থেকে অধিকতর কবি-কল্পনা অনুভব করা যায় ‘বউ-ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে। ‘রাজর্ষি’ নামটি ইঙ্গিতমূলক ব’লে মনে হয়। স্পষ্টতই এই নামকরণ ভাবধর্মী।
(৫) হিন্দুয়ানীর উৎপাত থেকেও রবীন্দ্র-উপন্যাসের ইতিহাসময় জগৎ সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। এখানে উত্তরসূরী পূর্বসূরীকে যেন অতিক্রম করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামাজিক উপন্যাসে মনোবিকলনমূলক নবপদ্ধতি:
ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি-প্রতিভার বিশেষত্ব ‘চোখের বালি’ উপন্যাস থেকেই সাধারণভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। ক্ষয়িষ্ণু সামত্তসমাজ আর বিবর্ণ নব্য ধনবাদী সমাজকাঠামোর মধ্যে এর ‘থীম’ বা ভাব-রূপটি মূর্ত হয়েছে। তাই নিঃসঙ্গ বিনোদিনীর বহুভুজ মানসিক জটিলতা, আশার সীমিত ব্যক্তিত্বের জড়তা, মহেন্দ্রের অবিবেকী অধিকারবোধ, বিহারীর হৃদয় সংযম ও নির্মম সততায় সজ্জিত এই উপন্যাসের বিষয়-গৌরব পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলিকে অনায়াসে অতিক্রম করে গেল। রক্ষণশীল-প্রগতিশীল এদেশের মানুষের চোখের সামনে “জোড়া ভুরু ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, নিখুঁত মুখ ও নিটোল যৌবন” নিয়ে সেদিন হিন্দুঘরের তরুণী বিধবা বিনোদিনীর কামনার প্রকাশ যেন হঠাৎ এক দমকা বাতাসের মতো ধাক্কা দিয়েছিল। আর ঝড়ের ঝাপটে যে চোেখ কর কর করবে এটাই স্বাভাবিক। সেই স্বভাবের দাবী বোঝাতে গিয়ে লেখক তার প্রেমপ্রবৃত্তির দাহ ও দীপ্তিকে কুণ্ঠাবিহীনভাবে দেখিয়েছেন— “ক্ষুধিত হৃদয়া বিনোদিনীও নববধূর নবপ্রেমের ইতিহাস মাতালের জ্বালাময় মনের মতো কান পাতিয়া পান করিতে লাগিল। তাহার মস্তিষ্ক মাতিয়া শরীরের রক্ত জ্বলিয়া উঠিল।” বাংলা উপন্যাসে এই প্রথম দেখা গেল প্রবৃত্তি-নিরোধের নিয়মে নারী নিয়ন্ত্রিত হল না। আবার কেবল প্রবৃত্তি তৃপ্তির অন্বেষণ নয়, আশার সঙ্গে প্রতিতুলনায় আত্মমর্যাদা রক্ষার চিন্তায় তার অস্তিত্বের সঙ্কটও এখানে কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠল। কারণ উপন্যাসের ভূমিকাতেই লেখক বলেছেন : “সাহিত্যের নব পর্যায়ের পদ্ধতি হচ্ছে ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখানো।”
এই ‘আঁতের কথা’ বিনোদিনী-মহেন্দ্র-বিহারী-আশার পারম্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণের টানে গড়ে উঠেছে। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসেও রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন : “সময়ের দাবি বদলে গেছে। একালে গল্পের কৌতূহলটা হয়ে উঠেছে মনোবিকলন মূলক। ঘটনা-গ্রন্থন হয়ে পড়েছে গৌণ।”
এই নব-পদ্ধতিই বঙ্কিম-উপন্যাস থেকে রবীন্দ্র-উপন্যাসে পার্থক্যের প্রধান কারণ। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়— “এই গভীরতর বাস্তবতাই বঙ্কিমের সহিত রবীন্দ্রনাথের পার্থক্যের প্রধান হেতু ও উপন্যাস ক্ষেত্রে নবযুগ-প্রবর্তনের সুস্পষ্ট সূচনা।”
‘চোখের বালি’-র পরবর্তী উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’। নৌকাডুবির ফলে রমেশ নামে এক অপরিচিত যুবক এবং এক সদ্য বিবাহিতা নারী কমলা কোনক্রমে রক্ষা পায়। প্রকৃতপক্ষে রমেশ নয়, কমলার আসল স্বামী ছিল নলিনাক্ষ। রমেশও কমলা নয়, ছিল হেমনলিনীর প্রতি আসক্ত। কিন্তু উপযুক্ত সম্ভাবনা সত্ত্বেও দুই পুরুষকে কেন্দ্র করে এক নারী-মনে (কমলা) অথবা দুই নারীকে কেন্দ্র করে এক পুরুষ মনে (রমেশ) যে জটিল অন্তর্দ্বন্দ্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল এখানে তা দেখা যায়নি। বহু সমালোচকের মতে ‘নৌকাডুবি’ রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতম রচনা।
‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত (১৩৩৪-৩৫ বঙ্গাব্দ) প্রথমে “তিন পুরুষ’ নামে পরে “যোগাযোগ” নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়। হয়ত লেখকের ইচ্ছা ছিল তিনপুরুষের জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু এক পুরুষের কাহিনী রচিত হয়। উপন্যাসের মূল আকর্ষণ কুমুদিনী বা কুমু, যার চেহারা কবির ভাষায় : “যেন রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ড; চোখ বড়ো না হোক একেবারে নিবিড় কালো, আর নাকটি নিখুঁত রেখায় যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি। রঙ শাঁখের মতো চিকন গৌর; নিটোল দুখানি হাত; সে হাতের সেবা কমলার বরদান, কৃতজ্ঞ হয়ে গ্রহণ করতে হয়”।
বনেদী অভিজাত এবং সংস্কৃতি ও সুশিক্ষায় মার্জিত দাদা বিপ্রদাসের শিক্ষায় ও স্নেহচ্ছায়ায় কুমুদিনী লালিত হয়। এহেন সুকুমার মন ও দেহ সৌন্দর্যের অধিকারিণী কুমুর বিয়ে হল স্থূল রুচির বিত্তবান পুরুষ মধুসূদনের সঙ্গে। তার সর্বগ্রাসী প্রভুত্ব ও বিত্তের অহমিকায় বিরক্ত ক্লান্ত কুমু যখন স্বামী-স্ত্রীর যান্ত্রিক সম্পর্ক ছেদ করতে চাইছে, তখন জানল সে সন্তানসম্ভবা। সনাতন সমাজ ও পাঠকের উদ্দেশে ছুঁড়ে ছিল তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন।
উপন্যাসের প্রধান অংশ জুড়ে আছে এই কুমুর মানসিক সংগ্রামের তথা মনোবিশ্লেষণের বিবরণ। পটভূমির বিশালতা এবং শিল্পনৈপুণ্যের বিচারে ‘যোগাযোগ’ বাংলা উপন্যাসে এক নতুন সংযোজন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ চেতনামূলক উপন্যাস:
স্বদেশচেতনার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে ‘গোরা’ উপন্যাসে। উপন্যাসে কাহিনীর পটভূমি প্রথমত এবং প্রধানত কলকাতা মহানগরী। কারণ এই শহর ছিল তখন সারা দেশে স্বদেশী সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলনের ভরপুর মৌশুমে ভরা। এই শহরকে কেন্দ্র করেই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী-মানস হয় নানা মতভেদে, সংশয়ে আত্মবোধে পীড়িত। হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠা (১৮৬৭), স্বামী দয়ানন্দের আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (১৮৭৫), আয়ারর্ল্যান্ডে চন্দ্রোদয় আন্দোলনে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের বন্দীকরণ (১৮৮১), হেস্টি সাহেবের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুধর্ম সম্পর্কে ‘Statesman’ এ মসিযুদ্ধ (১৮৮২), শশধর তর্কচূড়ামণির প্রাচীন হিন্দুধর্মের গৌরবজ্ঞাপক নানারকম অভিনব ব্যাখ্যা (১৮৮৫), বোম্বাইতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন (১৮৮৫), বিবেকানন্দের শিকাগোতে যুগান্তকারী বক্তৃতা (১৮৯৩), বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় (১৯০৫-১৯১১) ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনায় এই সময় পূর্ণ। ‘গোরা’ এইসব ধর্মনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের আবহে রচিত হয়। যুগজীবনের এই বিশিষ্ট আবহে সমকালের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালীর ভাববিবর্তনকে কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে (গোরা-বিনয়-পানুবাবু-পরেশবাবু-অবিনাশ ইত্যাদি) ঔপন্যাসিক তুলে ধরতে চেয়েছেন। স্বদেশের প্রকৃত স্বরূপ জানবার জন্য গোরা ছিল আগ্রহী। প্রথমদিকে সে ছিল নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু, অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের হাতে জলপানে পর্যন্ত অনিচ্ছুক। কিন্তু একদিন ঘটনাক্রমে সে জানতে পারে, সে জাতে আইরিশ, মিউটিনির সময়ে তার জন্ম, কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর ঘরে সে পালিত পুত্র মাত্র। এই সংবাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় তার রক্ষণশীল ভাবনার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে। শুধু তাই নয়, গোরার মাধ্যমে তার স্রষ্টা দেখিয়েছেন তার দেশপ্রীতি কতটা খাঁটি। অথচ তা সম্ভাননেতাদের predatory patriotism নয়, য়ুরোপের গোঁড়া স্বার্থমগ্ন, মানুষের জাতীয়তাবাদের নামে ‘the cult of Devil Worship’ নয়, নয় তৎকালীন স্বদেশী নেতাদের ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে প্রীতিবাদের ছদ্মপ্রচার। আপন জন্মরহস্য জেনে গোরা পৌঁছেছে একদিকে Pantheism বা সর্বেশ্বরবাদে, অন্যদিকে জাতিভেদমুক্ত সমাজচেতনায়। পরেশবাবুকে সে যেকথা বলেছে তা এই গ্রন্থের কালজয়ী সমাপ্তি সিদ্ধান্ত— “আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু-মুসলমান খ্রীস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই—যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে, কোনোদিন অবরুদ্ধ না হয়—যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, ভারতবর্ষের দেবতা। …….আজি আমি এমন শুচি হয়ে উঠেছি যে চণ্ডালের ঘরেও আমার আর অপবিত্রতার ভয় রইল না।”
রবীন্দ্রনাথের এই স্বদেশ জিজ্ঞাসার ভিন্নতর রূপ মূর্ত হয়েছে ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়ে’। প্রথমটিতে আছে বয়কট-আন্দোলনের নামে জাতীয় উন্মাদনার মত্ততার চিত্ররূপ। মানুষের স্থির বিচারদৃষ্টিকে আবিল করে তার ধ্রুব কল্যাণবুদ্ধিকে ধ্বংস করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়কে সংঘাতের পথে প্ররোচিত করা এবং গৃহের শান্তি বিনষ্ট করার জ্বলন্ত ইঙ্গিত, দ্বিতীয়টিতে আছে স্বভাবধর্ম উপেক্ষা করে সন্ত্রাসবাদে আত্মদানের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী। ‘ঘরে-বাইরে’তে বিমলা এবং ‘চার অধ্যায়ে’ এলার জীবন বিপর্যয়ে মনুষ্যত্ব ও ন্যায়নীতি বিরোধী রাজনৈতিক প্রমত্ততার ভয়াবহ দিকটি নির্দেশিত হয়েছে। দুটি উপন্যাসই আবেগধর্মী বক্তব্যে পূর্ণ। কিন্তু এই বক্তব্য সর্বত্র নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে দেখা দেয়নি। সেইজন্য এই দুটি উপন্যাস প্রকাশের পর এক সময় যথেষ্ট সমালোচনা ও বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোমান্টিক উপন্যাস:
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত উপন্যাসই কবির কলমে লেখা, তা অল্পবিস্তর রোমান্টিক। তবু ‘চতুরঙ্গ’ এবং ‘শেষের কবিতা’ এ ব্যাপারে অনন্য। ‘চতুরঙ্গ’ অখণ্ড জীবনরূপের যেন চারটি অঙ্গের কাহিনী। এই চারটি অঙ্গের এক একটির নাম পরিচয় : জ্যাঠামশায়-শচীশ দামিনী-শ্রীবিলাস। এরা প্রত্যেকেই অন্তর্মগ্ন ভাষায় (চেতনাপ্রবাহ রীতি?) নিজের মনোবিশ্লেষণ করেছে। এইভাবে জ্যাঠামশায়ের ধর্ম, শচীশের প্রেম, দামিনীর উত্তাপ, শ্রীবিলাসের নিষ্ঠা এই উপন্যাসের কাহিনী-গ্রন্থনে সহায়তা করে পরস্পরের ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র রচনা করেছে। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে চরিত্রগুলির জীবনসত্য অন্বেষণের প্রচেষ্টা এক নতুন আঙ্গিকে দেখা দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যোপম উপন্যাস:
‘শেষের কবিতা’র নায়ক অমিত প্রাণপ্রাচুর্যে উচ্ছল, জীবনরসে উদ্দীপ্ত, বুদ্ধিবাদের উজ্জ্বলতায় অনন্য। সে যেন এক অনর্গল বেজে চলা জীবন-সঙ্গীত। সে প্রধী, সুধী, কবি, বাগীশ্ এবং রোমান্টিক। তার আলাপিতা এবং বন্ধুনীর সংখ্যাও ঈর্ষণীয়। কেটি-বিমি বোসের মত অনেক অভিজাত সম্প্রদায়ের মেয়েই তাকে পেতে চায়, কিন্তু অমিত “সোনার রঙের দিগন্ত রেখা ধরা দিয়েই আছে, তবু কিছুতেই ধরা দেবে না”। এহেন অমিত শিলং-এর নির্জন-স্নিগ্ধ বনভূমির পথে দেখা পেয়েছে লাবণ্যের। শুরু হয়েছে তারপর প্রেমের উচ্ছ্বাস। শেষপর্যন্ত কিন্তু লাবণ্য অমিতকে ভালবেসেও বিয়ে করেছে শোভনলালকে, অমিত লাবণ্যকে ভালবেসে তারপর কেতকীর কাছে ফিরে এসেছে এই বিষণ্ণ উপলব্ধি নিয়ে “কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দীঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে?” প্রেমতত্ত্ব এখানে দুটি ভিন্ন ধারায় পরিবেশিত। মূল প্রেমের একাংশ অমিত আর বাকি অর্দ্ধাংশ লাবণ্য আর কেতকীর হৃদয়বোধের যোগফল। লাবণ্য ও কেতকীর মধ্যে কোন্ প্রেম অংশ হয়েও সমগ্র কবি যেন তার ইঙ্গিত করেই নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হওয়ার কারণ—
- (ক) এর অনন্যসাধারণ কাব্যময় ভাষা, epigram ও wit-এর চমক, যার অজস্র দৃষ্টান্ত পাঠককে মুগ্ধ করে।
- (খ) রবীন্দ্রনাথের প্রেম সম্পর্কিত ধারণার অভিনব ও পূর্ণায়ত প্রকাশ।
- (গ) কল্লোল গোষ্ঠীর তরুণ কবিদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় প্রায় আশি বছর বয়সে আত্মসমালোচনায় কবির স্বকীয় উদ্যোগ গ্রহণ, অমিতের মুখে (রবি ঠাকুরের সঙ্গে নিবারণ চক্রবর্তীর তুলনা) এবং প্রেমমূলক উপন্যাস রচনায় তার অদ্বিতীয় ক্ষমতার প্রমাণ দেওয়া।
- (ঘ) উপন্যাসের প্রচলিত আঙ্গিক-কাঠামো ভেঙে নতুন রীতিতে কাহিনী-কথনের পরীক্ষাদান।
‘দুই বোন’ উপন্যাস জীবনের দুই প্রান্তের আদর্শ-পুত্তলি—শর্মিলা এবং ঊর্মিমালা। শশাঙ্কের জীবনকে কেন্দ্র করেই তাদের আত্মপ্রকাশ ও ছায়া-বিস্তার। একজন খর গ্রীষ্মে ক্লান্তি-হরণের স্নেহচ্ছায়া দেয়, অন্যজন গোধূলি লগ্নের রোমান্টিক আলো-আঁধারী ছড়ায়। একজনে আছে মমতা, অন্যের মধ্যে প্রেমমূর্তি। দুই বোন’ গল্পের আঙ্গিকে লেখা, এখানে উপন্যাসের জীবন-বিস্তার, চরিত্র সমারোহ ততটা নেই। এই বইয়ের সমস্যাকেই উল্টোভাবে দেখানো হয়েছে ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে। এখানে নায়ক আদিত্যকে কেন্দ্র করে নীরজা ও সরলার প্রণয়-দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কাহিনীর শেষে রুগ্না নীরজার বেদনাবিধুর চিত্র প্রেমের মালঞ্চে ট্র্যাজেডির দীর্ঘশ্বাসকে ঘনীভূত করেছে। এখানেও গল্পের আঙ্গিকে কাহিনী রূপ নিয়েছে। তবু সমালোচকের মতে, “এ উপন্যাসে বিষয় এবং বিষয়াধারের পরিপূর্ণ মিলন ঘটেছে; সমস্যা এবং আকৃতিতে রক্ষিত হয়েছে সামঞ্জস্য। মৃত্যু রক্ষার অসহায় সংগ্রাম, স্বামীর প্রতি তার অনুদার সন্দেহ, ফুলবাগানের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার করুণ আগ্রহ এবং তার ট্র্যাজিক পরিণতি-অঙ্কন এ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য কঠিন জীবনপ্রেমিক নীরজার ভালোবাসার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, পরাজয় এবং ট্র্যাজেডি ‘মালঞ্চে’র মর্মকথা”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসের ভাষাশৈলী:
রবীন্দ্র-উপন্যাসের ভাষাশৈলী বাংলা সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ। প্রথম দিকের ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের ভাষায় সাধু গদ্যের প্রকৃতি অনেক পরিমাণে বঙ্কিমী-গদ্যের চালে বিন্যস্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে কিন্তু তার বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তন শুরু হয় ‘ঘরে বাইরে’ থেকে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প:
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পধারার সর্বজনবেদ্য ভগীরথ। তাঁর আগেও গল্প লেখা হয়েছে। কিন্তু ১৮৯১ সালে সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’র সাহিত্যবিভাগে শিল্পসম্মত প্রকৃত ছোটগল্পের জন্ম ও বিকাশ শুরু হয়। সব দেশেই আছে ছোটগল্পের সঙ্গে সাময়িকপত্র বা সংবাদপত্রের আত্মীয়তার সম্পর্ক। ইউরোপে খবর নিলে দেখা যাবে সেখানেও মপাসাঁ লিখেছেন ‘গোলোয়া’ ও ‘জিলে ব্লা’র পাতায়, চেকভ ‘অলকি’ ও ‘বুদিলনকি’তে, অ্যালান পো লিখেছেন ‘স্যাটারডে ক্যুরিয়ার’ ও ‘স্যাটারডে ভিজিটার’-এ, রবীন্দ্রনাথও তেমনি ছোটগল্পের ঐশ্বর্য নিয়ে এসেছেন ‘হিতবাদী’, ‘সাধনা’, ‘ভারতী’, ‘সবুজপত্র’ প্রভৃতি সাময়িকপত্রের আধারে।
সংবাদপত্রের সঙ্গে ছোটগল্পের যোগাযোগের কারণ সমকালীনতা এবং সংক্ষিপ্ততার দাবী। কর্মব্যস্ততার গতিচ্ছন্দে শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ইউরোপীয় সমাজজীবন তার পূর্ববর্তী অলস-ধ্রুপদী রূপ হারিয়ে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গিয়েছিল। সেই কথাসাহিত্য ছোট্ট পরিসরে আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবী ক’রে বসলো। অর্থনীতিতে ভাঙচুর, সমাজজীবনে বিবর্তন, শ্রেণীবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটেছিল। এর পাশাপাশি ফরাসী বিপ্লব, চার্টিস্ট আন্দোলন, মে দিবসের সংগ্রাম, প্রাচীন অভিজাত শ্রেণীর বিপর্যয়, নতুন অভিজাত বুর্জোয়া শ্রেণীর মুখোমুখি উন্নতমস্তক শ্রমজীবী মানুষের নবীন চেহারা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল পরিবর্তনের দুর্বার স্রোতধারা। সেই কুলপ্লাবনে ভেসে গিয়েছিল অভিজাত-নির্ভর ইতিহাস ও রোমান্সের প্রাসাদ, জেগে উঠেছিল নতুন সমাজে নতুন বাস্তবতায় পরিপূর্ণ অজস্র দ্বীপপুঞ্জ। “Men and women are better than heroines”– উনিশ শতকের সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে এটাই হয়ে উঠল ধ্রুববাণী। আর সংবাদপত্রে বিবিধ ফিচার কল্পকাহিনীর মাধ্যমে সেই সমাজ ও সামাজিক মানুষের প্রাত্যহিক জীবন বা দিনযাপনের বিচিত্র ঘটনা পাঠকমনে সংবেদনা সৃষ্টি করল। ফলে কি এদেশে কি ওদেশে একসময় এই সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের আধারে জন্ম নিল ‘ছোটগল্প’ (short story)।
রবীন্দ্রনাথের তিরিশ বছর বয়সে ছোটগল্প লেখা শুরু হয়। ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতায় তাঁর চিত্ত তখন সংক্ষুব্ধ। সেই মুহূর্তে যৌবনের ‘সজন- নির্জনের নিত্য-সংগমে’ পদ্মার বুকে, প্রকৃতির মধ্যে শুরু হয় তাঁর আশ্রয় অন্বেষণ। এর ফলে একদিকে মুগ্ধ কবি-দৃষ্টি অকৃপণ প্রকৃতির সৌন্দর্যে পুষ্ট হয়, অন্যদিকে কৃপণ পৃথিবীতে মানুষের দুঃখ ও দৈন্য সম্পর্কে গল্পকারের রূপকারী বিবেকের চৈতন্যলাভ ঘটে।
বস্তুতঃপক্ষে, জমিদারী পরিদর্শনে এসে কবি পূর্ববাংলার গ্রামীণ পরিবেশের মুখোমুখি হন। এই প্রথম স্বতন্ত্র বাস্তবতায় তার জীবনবোধ হয় ভূমিলগ্ন, প্রসারিত এবং দ্বন্দ্বময়। বলা যায়, স্রষ্টার এই বিশিষ্ট মর্মপাতের ফলেই তিন পর্বের ‘গল্পগুচ্ছে’ নর নারীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় বৈচিত্র্য। এখানে আছে কখনও চরিত্রের স্বাভাবিকতার সঙ্গে উদার আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব, কখনও বা পরিবেশের মধ্যে বদ্ধ থেকে হয়ে পড়ার সঙ্গে হতে চাওয়ার দ্বন্দ্ব। এইভাবে গল্পগুচ্ছের মধ্যে আগাগোড়াই দেখা যাবে চরিত্রের ক্রম-উত্তরণের চিহ্ন—যেমন ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক থেকে ‘আপদ’ নীলকান্ত এবং সর্বশেষে ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদর মধ্যে দেখা যায় বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরজীবনে বদ্ধতা, বিদ্রোহ অথবা বিপথগামিতা। তবু শেষে মুক্তির ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার যেন অনুক্ত নির্দেশ আছে।
আবার ‘দেনাপাওনা’ মেটাতে হৈমর জীবন ধারণের সংকল্প, স্ত্রীর পত্রে’ মৃণালের প্রতিবাদমুখরতা থেকে ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণীর ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা বা পুরুষের সমান স্বপদে প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও মনে হয় যেন কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়, নারীমনের ধারাবাহিক চেতনার ক্রম-অগ্রসরণে সুচিহ্নিত হয়েছে। স্রষ্টার এই উপস্থাপনার কৌশলে বিস্মিত হয়ে কবি-সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর মতো এক্ষেত্রে আমরাও অনুভব করি— “রবীন্দ্রনাথ ধীরে এগিয়েছেন হঠাৎ কিছু বদল ঘটাতে যান নি”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের সময়বিন্যাস:
রবীন্দ্রনাথের গল্পের সময়ধারাকে বিভিন্ন সমালোচক বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত করেছেন। অবশ্য সেই বিন্যাসেও তেমন বড়ো রকমের কোনো মতভেদ নেই। বিবিধ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর গল্পগুলির কথা মনে রেখে মোটামুটিভাবে চারটি পর্যায়ে আমরা গল্পগুচ্ছ ও তদতিরিক্ত গল্পের সময়কাল চিহ্নিত করতে পারি—
প্রথম পর্যায়ে : ১৮৯১-১৮৯৫ খ্রীঃ
দ্বিতীয় পর্যায়ে : ১৮৯৮-১৯০৭ খ্রীঃ
তৃতীয় পর্যায়ে : ১৯১৪-১৯১৭ খ্রীঃ
চতুর্থ পর্যায়ে : ১৯৪০-১৯৪১ খ্রীঃ
আমরা জানি, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘হিতবাদী’তেই রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্যায়ের গল্প-রচনার সূচনা মুহূর্তে লিখেছিলেন গুটি ছয়েক গল্প। বিষয়গত আবেদনে দেখা যায় ‘দেনাপাওনা’ আর ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতায়’ আছে সমাজ-সমালোচনা, তারাপ্রসন্নের কীর্তিতে বাস্তবের সংঘাতে ভাববিলাসের ট্র্যাজেডি, গিন্নী’তে একটি শৈশব স্মৃতির পটভূমিকায় সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক রসসৃষ্টি আর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে জীবন এবং প্রকৃতির দ্বৈততান। অন্যদিকে ছোটগল্পের আঙ্গিক সম্বন্ধে গল্পকারের স্বচ্ছ ধারণা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন চোখে পড়ার মতো। কেননা, মাত্র বছর ছয়েক আগে লেখা (১৮৮৪-৮৫) ‘ঘাটের কথা’ ও ‘রাজপথের কথা’ গল্পদুটিতে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের দৈন্য দেখে এ চমক আরো বেশি করে জাগে। বোঝা যায়, এর অন্তরালে ছিল প্রস্তুতিপর্ব—বিলেতে বহুপাঠের অভিজ্ঞতা। ‘ছোটবেলা’য় রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ স্বীকারোক্তির স্মৃতিকথন এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য : “নানা দিক থেকে বিলেতের আবহাওয়ার কাজ চলতে লাগল মনের উপর। আমার উপর ভার পড়েছিল রোজ সন্ধ্যেবেলায় রাত এগারোটা পর্যন্ত, পালা করে কাব্য নাটক ইতিহাস পড়ে শোনানো। নিজের মধ্যে নিয়েছি পূর্ব-পশ্চিমের হাত মেলানো”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদেশী গল্পপাঠের অভিজ্ঞতা:
এই সময়ে বা অনতি-পরবর্তীকালে (১৮৯১ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে) মূল বা অনুবাদের সাহায্যে বিদেশী গল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হওয়া খুবই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক ছিল। কেননা ‘রবীন্দ্রজীবনী’ থেকে জানা যায়, ১৮৩৩-এ প্রিয়নাথ সেন কবিকে গ্যতিয়ের-এর ‘Medemoiselle de Mopin’ -এর অনুবাদ পড়ান; কবির প্রিয় অনুবাদক Lafcadio Hearn-এর ১৮৮১-১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ‘Democrat’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ফরাসী গল্পের অনুবাদ বা তাঁর ‘Le Crime de Sylvestre Bonnard (1890) গ্রন্থের সঙ্গেও তাঁর সম্ভবত পরিচয় ঘটেছিল—এইসব চিত্তাকর্ষক তথ্য জানিয়ে সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় এক রবীন্দ্রসমালোচক প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস এর ‘বীন্দ্রনাথের রহস্যগল্প’ (‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ : শ্রাবণ আশ্বিন, বর্ষ ১৭, সংখ্যা- ২, ১৩৮৮) প্রবন্ধে ও পরে স্বতন্ত্র গ্রন্থে বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ করেন রবীন্দ্রনাথের অনেক গল্পের প্লট তার মৌলিক কল্পনাপ্রসূত নয়, বরং এডগার অ্যালান পো-র একাধিক গল্পের কাহিনী থেকে সংগৃহীত। তিনি দেখিয়েছেন পো-র ‘Gold Bug’ অবলম্বনে ‘গুপ্তধন’, ‘The Cask of Amontillado’ এবং ‘The Tell-Tale Heart’ অবলম্বনে ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘Premature Burial’-এর অভিজ্ঞতায় ‘জীবিত ও মৃত’ ও ‘মহামায়া’, ‘Ligia’ অনুসরণে ‘নিশীথে’ কিংবা Thomas anstey Guthrie-র ‘Vice-versa’ দেখে লেখা ‘ইচ্ছাপূরণ’ প্রভৃতি গল্পগুলি সৃষ্টি করা হয়েছে বহু ছোটগল্পের প্লট একান্তভাবে বিদেশী গল্প-নির্ভর। কাহিনী বিন্যাসেও সাদৃশ্য আছে। তবে এর জন্য কবির উপর দোষারোপ করা অন্যায় মনে হয়। কারণ সাহিত্যে স্বয়ংসিদ্ধ কল্পনার ব্যাপারটি বারে বারে পরাশ্রয়িতার দৃষ্টাত্তে সমালোচকদের নিছক তথ্যাবিষ্ট করেই থাকে (যেমন—শেকসপিয়রের সাঁয়ত্রিশটি নাটকের মধ্যে মাত্র একটির কাহিনী অংশ মৌলিক, কালিদাসের ‘মেঘদূতম্’ চীনা কবির কবিতা-ভাবের প্রতিরূপ ইত্যাদি)। গবেষণার প্রয়োজনে তা হয়ত নিঃসন্দেহে মূল্যবান, কিন্তু রসাস্বাদনের পক্ষে তা অকিঞ্চিৎকর।
‘হিতবাদী’ থেকে গল্পকার রবীন্দ্রনাথ দেখা দিলেন সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাধনা’ পত্রিকায়। তাবপর “গল্প লিখি এক-একটি করে”। ১৮৯১ থেকে ১৯০১–এই এগারো বছরের মধ্যে শিলাইদহ সাজাদপুরের ভূ-প্রকৃতি, পদ্মার “কাপন লাগা ঝাউয়ের শিরে” কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে আমরা জানি না, কিন্তু দেখতে পাই এই প্রকৃতি ও প্রাণরসের বহুমিশ্র চিন্তার পঞ্চশস্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ‘গল্পগুচ্ছে’র গল্প ভাণ্ডার : ‘কঙ্কাল’, ‘নিশীথে’, ‘মানভঞ্জন’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দুরাশা’, ‘রাজটীকা’, এবং ‘নষ্টনীড়’ প্রভৃতি সেরা গল্পগুলি এই পর্যায়ে লেখা। বক্তব্য উপস্থাপনায় দেখা যায়, কোথাও আছে চরিত্রের উপর প্রকৃতি-প্রভাবের স্বরূপ-নির্ণয়, কোথাও দরিদ্র মানুষের এবং উপস্বত্বভোগী মধ্যবিত্তের জীবনচিত্র; কখনও সমাজের বিচার-ব্যবস্থার দিকে অঙ্গুলি-সঙ্কেত, রাজশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে একক মানুষের ক্রোধ, আবার কখনও বা দাম্পত্য সম্পর্কের অসতর্কতায় চৈতালী ঝড়ের মুখে ঝরা পাতার মত ছিন্নভিন্ন পরিবার ও অসহায় মানুষের জীবনচিত্র। এইসব গল্পগুলি পড়ে দেখা যায়, লেখক সামস্ততান্ত্রিক, ঔপনিবেশিক বিষয় জীবনের জীর্ণ দেহ থেকে শুধু কথাবস্তু আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি, এই গল্পগুলির চরিত্রেরা যেন এই জীবনকে অবলম্বন করে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার দোষগুলি দেখিয়ে দিয়েছে, এমন কি এই জীবন থেকেও তারা সময় বিশেষে মুক্তি চেয়েছে।
সমাজ-সচেতনতার পরিচয় আছে অনেক গল্পে : সামাজিক কুপ্রথা হিসাবে পণপ্রথার হৃদয়হীন চিত্র যেমন ‘দেনাপাওনা’র পর আবার ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, হৈমন্তী তে দেখা গেছে, তেমনি ‘ত্যাগ’ গল্পে ব্রাহ্মণ হেমন্তের কায়স্থ ও বাল্যবিধবা ‘কুসুম’কে বিয়ে করার সংবাদে পুরুষের সংস্কার মুক্তির পরিচয় ফুটে উঠেছে। সমাজে বিচারক স্বয়ং অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও বিচার করার নৈতিক অধিকার রক্ষার তীব্র ব্যঙ্গরূপ ‘বিচারক’ গল্প— অপরূপ গাম্ভীর্য অথচ ধারাল, শাণিত এবং সহজ। এই বিচারেরই আর এক রূপ পারিবারিক কলহের পটভূমিতে পদ্মার কূলবর্তী গ্রাম্যবধূ চন্দরার ফাসির দণ্ডে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হওয়ার এক নিটোল গল্পরূপ— ‘শাস্তি’।
এই পর্যায়ের পারিবারিক গল্পগুলির গ্রন্থনায় পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে অগ্রসরণ এবং বিবর্তনের চিহ্ন সব চাইতে স্পষ্টরেখ্। কেননা এই ধরনের গল্পে প্রেম হয়ে ওঠে মুখ্য বিষয় এবং তার ফলে তার নানা বিভঙ্গ ঈর্ষা, লোভ, দুর্বলতা বা উন্মত্ততা স্বাভাবিক ভাবেই গল্পে প্রকাশ পায়। আবার প্রেম যেখানে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রবলতম অনুষঙ্গ সেখানে তার গতিবেগ, দোলাচলতা, উন্মত্ততা, প্রজাপতিবৃত্তির ফলে বারে বারে আসবে জটিলতা দেখা দেবে চরিত্রে অন্তর্মুখিনতা কিংবা মানসিক বিপর্যয়। গল্পগুচ্ছের মধ্যেও দেখা যায়, কখনও গ্রাম্য মেয়ের সরলতা হরণের চিত্র—যেমন ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, ‘মাল্যদানের কুড়ানি; কখনো প্রেমের দ্বারা চরিত্র-নিয়ন্ত্রণের চিরাচরিত রীতি বাদ দিয়ে অহমিকাবোধ বা হৃদয় স্বাতন্ত্র্যের প্রাধান্যলাভ— যেমন ‘মহামায়া’, ‘শেষের রাত্রি’, ‘মানভঞ্জনে’র নায়িকারা। আবার কখনও বা যৌবন চঞ্চলতায় পুরুষচিত্তকে মত্ত করে শেষে দুঃখদানের চিত্র—যেমন ‘একরাত্রি’, ‘অধ্যাপক’, ‘প্রতিবেশিনী’র নায়কেরা। তিনি দেখিয়েছেন প্রেমিক পুরুষের দুই রূপ—একজন ভোগী, অন্যজন ত্যাগী; নারীর মধ্যেও আছে দ্বৈতরূপ—একজন ঊর্বশী, অন্যজন লক্ষ্মী। সেখানে কোথাও দেখা গেছে চরম আসক্তি ও নির্মম ঔদাসীন্য, কোথাও প্রকাশ পেয়েছে অনস্ত যৌবনের চাঞ্চল্য ও কল্যাণময়তার স্থিরদ্যুতি।
মসৃণ মিত্রাক্ষর পয়ারের মতো স্বামী-স্ত্রীর জীবনে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় যখন মূর্তিমান অনিয়ম রূপে দ্বিতীয়জন এসে জায়গা নেয়, তার ফলে বিপর্যয় যে কিভাবে অনিবার্য হয়ে ওঠে তার নিদর্শন ‘মধ্যবর্তিনী’ এবং ‘নষ্টনীড়’ গল্প। অবশ্য দুটি গল্পে চরিত্র-চিত্রণ থেকে ভাষা ব্যবহার পর্যন্ত বিবিধ ক্ষেত্রে আছে বিরাট পার্থক্য। কিন্তু সমাপ্তিপর্বে লক্ষ্য করা যাবে বক্তব্যের ঐক্য। তাই ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পে যেমন নিবারণ ও হরসুন্দরীর “ঠিক মাঝখানে একটি মৃত বালিকা শুইয়া রহিল, তাহাকে কেহ লঙ্ঘন করিতে পারিল না”, তেমনি ‘নষ্টনীড়’ গল্পে চারুর প্রতি অসীম সহানুভূতি সত্ত্বেও অমলের বিদায়ে বিষণ্ণ নিজের স্ত্রীকে দেখে ভূপতি ভেবেছে, “যাহার অন্তরের মধ্যে মৃতভার, তাহাকে বক্ষের কাছে ধরিয়া রাখা সে আমি কত দিন পারিব?” আবার অতিপ্রাকৃতের আবহে, ‘নিশীথে’র মতো গল্প লিখেছেন যখন লেখক, কিংবা ‘মণিহারা’র মতো গল্প, সেখানেও রীতিমাফিক দাম্পত্যবন্ধনের অতৃপ্তি মূর্ত হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের মতো তাঁর গল্পের চরিত্রেরা বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক ভাবনায় আলোড়িত হয়েছে। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে শশীভূষণ জাতীয় সম্মান রক্ষায় ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জেলে গেছে। শেষপর্যন্ত তার ক্রোধের রেশ অবশ্য গল্পে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু এই ভাবমগ্ন বুদ্ধিজীবীর একক সংগ্রাম গল্পকারের ঔপন্যাসিক চেতনায় প্রেরণা জুগিয়েছে গোরা-চরিত্র পরিকল্পনার। ‘রাজটীকা’ গল্পে ব্যঙ্গে-কৌতুকে ইংরেজস্তাবক খেতাব প্রত্যাশী নবেন্দুশেখরের মাধ্যমে সমকালীন মুৎসুদ্দী ধনিক শ্রেণীর স্বভাব উদ্ঘাটিত হয়েছে। বিপরীতভাবে দেশী আমলাতন্ত্রের হৃদয়হীনতা ও বীভৎস লোভের বিরুদ্ধাচারণে চোখ খুলেছে ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পের ডাক্তারনায়কের।
‘নষ্টনীড়’ থেকে রবীন্দ্রগল্পে নতুন ঋতু এসেছিল। কিন্তু সে ঋতু পদ্মার গাঙ্গেয় বাতাসে স্নিগ্ধ নয়, শহর কলকাতা বা তার পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের ঝোড়ো হাওয়ায় বারংবার বিদ্যুৎ-চকিত। আর সেই হাওয়ায় আন্দোলিত হয়েছিল শুধু একটি ‘সবুজপত্র’, যার পাতায় ধরা পড়েছিল সমাজ-সংসার ও নারী জীবনের নতুন ছবি। প্রকৃতপক্ষে নিরু-কুসুম-হৈমন্তীর মতো গৃহবধূর সংসারে ও সমাজে যন্ত্রণাভোগের পর প্রয়োজন ছিল প্রতিবাদের এবং গৃহত্যাগের। তাই দেখা গেল, ‘স্ত্রীর পত্রে’ মৃণাল, ‘পয়লা নম্বরে’ অনিলা, ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণী প্রভৃতি একাধিক দীপ্তিময়ী নারী। তবু মুখরতায়, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যে, মুক্তির অন্বেষণে সকলকে ছাড়িয়ে গেল “সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলির প্রাচীর তোলা বাড়ি”র মেজবৌ মৃণাল। তার ঘর ছাড়া কোন হঠাৎ গোপন ব্যাপার নয়, সপত্নী-জ্বালা বা স্বামীর দুশ্চরিত্র আচরণও নয় : “তোমার চরিত্রে এমন কোন দোষ নেই যাতে বিধাতাকে মন্দ বলতে পারি”, এমন কি দারিদ্র্যের জ্বালাও নয়, অথচ স্বামীর প্রতি লেখা চিঠির শেষে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার আকাঙ্ক্ষিক দূরত্ব : “তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন মৃণাল”। আসলে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে কেবল নিজেকে চিনতে ও জানতে। তার এই চেনা ও জানার মূলে আছে নারীজীবনকে দেখা। “ঘোরো আইন দিয়ে গড়া কাঁটার বেড়া”র মধ্যে সংসারে তার বড় জা-র মতো বদ্ধ ও বাধ্য নারীর অবস্থাকে নিবিড় বেদনায় উপলব্ধি করা। সেইসঙ্গে সকলের কাছে নগণ্য বিন্দুর মৃত্যু থেকে “জীবনের জয়পতাকা” ওড়ার দৃশ্য দর্শন। পুরীর মন্দিরে না গিয়েও আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জে ভরা নীল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে “জগৎ ও জগদীশ্বরের সঙ্গে” সম্বন্ধ অনুভব, আর শেষে পেয়েছে “মরতে যাবার নামে পুরনো ঠাট্টার চেয়ে লেগে থাকা বা বেঁচে থাকা”র এক আশ্চর্য সাধারণ জ্ঞান। এতটা বিস্তৃত সামাজিক ব্যঞ্জনায় ব্যাপ্ত না হলেও ‘পয়লা নম্বর’ গল্পে অনিলার গৃহত্যাগও তুচ্ছ ঘটনা নয়, সেখানেও আছে নারীর অপমানের জ্বালা। বিয়ের আসরে নারীকে প্রত্যাখ্যানের একচেটিয়া অধিকার বিপরীত আবর্তনে ঘুরে এসেছে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর বিয়ে না করার আচরণে। “বিবাহ ভাঙার পর” থেকে তার “মেয়েদের শিক্ষার ব্রত গ্রহণ” যেমন এক অর্থে পুরুষ-শাসিত সমাজে মেয়েদের প্রতি দুর্বিচার সম্পর্কে চেতন করে তোলার ইঙ্গিত, তেমনি অভিভাবকের ব্যক্তিত্বের কাছে নমনীত না হয়ে স্বাধীন জীবিকা অর্জনের অনুপম দৃষ্টান্ত। উদারতা ঔদাসীন্যের অপেক্ষা না করে নারী এখানে পৌঁছেছে এমন একটি পর্যায়ে যাতে বোঝা যায় “আজ এল এমন যুগ যখন মেয়েরা মানবত্বের পূর্ণ মূল্য দাবী করেছে। জননার্থং মহাভাগা বলে তাদের গণনা করা হবে না। সম্পূর্ণ ব্যক্তিবিশেষে বলেই তারা হবে গণ্য”।
কেবল নারীর হৃদয়ানুভূতির লাবণ্যেই ‘সবুজপত্র’ সুশোভিত হয় নি। ‘‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পে নায়ক বনোয়ারীলালের মধ্যে ভাবসত্তার শিল্পিত স্বভাবের সঙ্গে জাগতিক তুচ্ছগন্ধী সাংসারিক সত্তার বিরোধ সুনিপুণভাবে রূপায়িত। আটপৌরে ঘরোয়া জীবনের স্থূলতা থেকে বাঁচবার জন্য নিছক সৌন্দর্যতৃষ্ণা মেটাতে পুরুষের এই ঘরছাড়ার দৃষ্টান্ত অভিনব ব্যাপার। ‘পাত্র ও পাত্রী’ গল্পে সনৎকুমার বুঝেছে নারীকে তার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রেখেই স্বীকার করা উচিত। পুরুষের পুরুষাকার এযুগে কিসের উপর নির্ভর করে তা যেমন নায়কের মুখ দিয়েই গল্পশেষে উত্থাপিত হয়েছে “আমার মতো বাজে লোক যে নিরর্থক নয় আমার অর্থই সেটা শ্রীপতির কাছে প্রমাণ করে দিলে”, তেমনি তার নিস্ফলতার চাপা দীর্ঘশ্বাসও পাঠক-চিত্তকে ভারাক্রান্ত করে। এ পর্যায়ের গল্পগুলি আসলে পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত। সেই বৈশিষ্ট্যগুলি হল, সনাতনী ঐতিহ্যের বিশ্লেষণে সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে যুক্তিবাদী মনোভঙ্গী, নারীমনের নিষ্ঠুণ্ঠ, নির্ভীক বিদ্রোহ, মর্যাদা ও মুক্তির দাবী, অবক্ষয়ী সামত্তসমাজের বুকে উদ্ভিন্ন ধনবাদের বিপ্রতীপ টানাপোড়েনে মূল্যবোধ-বিধ্বস্ত মানুষের ছবি, বাচনে ও লেখনে তীক্ষ্ণ তির্যক ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা ইত্যাদি।
তৃতীয় পর্যায়ের গল্পধারার মধ্যে ‘প্রবাসী’তে ‘নামঞ্জুর গল্প’ এবং ‘সংস্কার’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথম গল্পে নামকরণেই লক্ষ্য করা যায় ব্যঙ্গের চমক। এখানে একজন প্রাক্তন আদর্শনিষ্ঠ বিপ্লবীর মাধ্যমে গল্পকার সমকালীন রাজনীতির সমালোচনা করেছেন। তার আক্রমণের কারণ একদিকে রাজনৈতিক মাতলামীর হুজুগে মানবিক স্নেহ-মমতার সত্যকে উপেক্ষা, অন্যদিকে ‘স্বদেশলক্ষ্মী’ অমিয়ার হীনজন্মের কাহিনী শুনে অনিলের মতো দেশসেবকের পালানোর কাপুরুষতার বিরুদ্ধে কষাঘাত। পরবর্তী ‘সংস্কার’ গল্পেও দেশসেবিকা কালিকা এবং তত্ত্ববিদ অধ্যাপক নয়নমোহনের মাধ্যমে দেশসেবার নামে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা তীব্র ব্যঙ্গে উদ্ঘাটিত। অবশ্য গল্পদুটির বক্তব্য সমকালে এবং পরবর্তীকালে আপত্তিকর ব’লে সমালোচিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ের গল্পরচনার ফলশ্রুতি তিন সঙ্গী’র তিনটি গল্প— ‘রবিবার’, ‘শেষকথা’, ‘ল্যাবরেটরি’। তিন সঙ্গী অবশ্য ‘গল্পগুচ্ছের’ তিন খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রথম গল্প ‘রবিবার’ একটি মনোরম প্রেমকাহিনী। দ্বিতীয়টি অচিরার অন্ধ আকর্ষণে নবীনমাধবের অনিচ্ছালব্ধ মুক্তির বৃত্তান্ত ‘শেষ কথা’। তৃতীয়টি সোহিনী নামে এক অসাধারণ রমণীর প্রলোভনের অগ্নিচক্র রচনা করে নন্দকিশোরের অসমাস্ত বিজ্ঞানযজ্ঞের ঋত্বিক-সন্ধানের বিফলতার বিচিত্র কাহিনী ‘ল্যাবরেটরি’। ১৩৪৭ সালের ‘শারদীয়া আনন্দবাজারে’ প্রকাশিত এই গল্পটিতে নায়িকা সোহিনীর মাধ্যমে সতীত্ব ধারণার প্রচলিত আদর্শটিকে যুগ-যুক্তির চূড়ান্ত আধুনিকতায় যাচাই করা হয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্যের সোনার তরীতে এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ সংযোজন করেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল কল্পনার ফসল।
Leave a comment