“দেশ সাহিত্যিক আর কবি Conscious হয় ঠিক কবি বা লেখকের মৃত্যুর পর। মৃত্যু একটা rude shock দিয়ে লোককে সচেতন করিয়ে দেয়—একটু অনুতাপ—একটু ভাব এর উপর বুঝি-বা অবিচার করা হয়েছে। মৃত্যুর অব্যবহিত পরই রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়– নরসিংহদাস প্রাইজ পেয়েছেন মোহিতলাল—ভারত সরকারের Academy Prize পেয়েছেন জীবনানন্দ দাস” (‘ব্যক্তিগত দিনলিপি’) – বিগত লেখকদের সম্পর্কে সতীনাথ ভাদুড়ীর এই ব্যঙ্গতীক্ষ্ণ সত্যভাষণের দুর্ঘটনা সৌভাগ্যক্রমে তার জীবনে দেখা দেয়নি। বরং প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’ প্রকাশ মাত্রই রবীন্দ্র-পুরস্কারে সম্মানিত হয়। তবু নামের মোহ, যশের আশা, প্রশংসা বা সম্বৰ্দ্ধনা উপহার সম্পর্কে তিনি একেবারেই নিরাসক্ত ছিলেন। এই প্রবাসী বাঙালী লেখক সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলীর মন্তব্য: “তিনি লেখকের লেখক”। কথাটি বাঙলা সাহিত্যে তাঁর অনন্য ভূমিকা রচনা করে। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির কাল স্বল্প (১৯৪৮-১৯৬৫ খ্রীঃ), গল্প উপন্যাসের সংখ্যা নামমাত্র। অথচ বিষয় সম্পর্কে তার বিদগ্ধ মানসিকতা, সমাজপ্রদর্শন প্রসঙ্গে গভীরতর চিন্তা-ভাবনা, আঙ্গিক নিয়ে নিত্যনব পরীক্ষা প্রমাণ করে সতীনাথ স্বল্পতম সৃষ্টি করেও বিরলতম শিল্পী।

সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্ম-শিক্ষা-রাজনৈতিক জীবন:

সতীনাথ ভাদুড়ী মুখ্যত প্রবাসী লেখক। অবশ্য তার পরিবারের আদি নিবাস ছিল নদীয়ার কৃষ্ণনগর। কিন্তু তাঁর পিতা ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী আইনব্যবসার সূত্রে আগমন করেন বিহারের এক সুদূর অঞ্চল পূর্ণিয়ায় ১৮৯৬ সালে। এই পূর্ণিয়ার ভট্টাবাজারে ১৯০৬ খ্রীস্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর সতীনাথের জন্ম হয়। ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে মা রাজবালা এবং দিদি করুণাময়ীর সাতদিনের আগে-পরে মৃত্যু ঘটে। পিতা ইন্দুভূষণের অভিজাত গম্ভীর ব্যবহারে সতীনাথ প্রথম থেকেই ছিলেন নিঃসঙ্গ এবং অন্তর্মুখিন।

তার বাল্যশিক্ষা, আইনকর্ম, রাজনীতিতে যোগদান ও ত্যাগ, সাহিত্য-সাধনা, এমনকি মৃত্যুও পূর্ণিয়া জেলাতেই নিবদ্ধ থাকে। ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে ডিভিশনার স্কলারশিপ নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ, ১৯২৬-এ পাটনা সায়েন্স কলেজ থেকে আই. এস. সি., ১৯২৮-এ অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বি. এ. ১৯৩০-এ অর্থনীতিতে এম. এ. এবং ১৯৩১-এ পাটনা ল কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে ওকালতিতে যোগদান করেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত আইনব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন।

সতীনাথ ভাদুড়ীর রাজনৈতিক জীবন:

সতীনাথের পূর্ণিয়ার পরিবেশ ও জনজীবন সম্পর্কে কৌতূহল, গ্রামীণ জীবন ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা তার রাজনৈতিক সচেতনতা সূত্রে প্রাপ্ত হয়। ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে গান্ধীজী পূর্ণিয়ার নওরত মাঠে ভাষণ দিতে আসেন। এখান থেকে সতীনাথের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। প্রথমে সঙ্গীদের নিয়ে ভট্টাবাজারে মদের দোকানে পিকেটিং, পুলিশের সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদ, নিজের পুরনো জেলা স্কুলে ইংরেজি শিক্ষা বন্ধের জন্য পিকেটিং, গ্রন্থাগার স্থাপন, সমাজসেবা ইত্যাদি কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তারপর ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর সর্বজনশ্রদ্ধেয় সর্বোদয় নেতা বিদ্যানাথ চৌধুরীর টিকাপট্টির আশ্রমে যোগ দেন। সংকল্পে, সাধনায় জীবনাচরণে কংগ্রেসী আদর্শের পূর্ণ পরিচয় দিয়ে পূর্ণিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত তিনি ‘ভাদুড়ীজী’ নামে খ্যাত হন। কারাবাস করেন তিনবার–১৯৪০-এর জানুয়ারীতে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ করে হাজারীবাগে জেলে, ১৯৪১-এ ছয় মাসের জন্য, তারপর কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির হয়ে গোপন সংগঠন, অস্ত্র সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজের অভিযোগে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে জীবন অতিবাহিত করেন। পূর্ণিয়ার জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক হয়ে ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। তবে কংগ্রেসী হয়েও তিনি সোস্যালিস্ট কার্যকলাপে ছিলেন অধিকতর আস্থাবান। তাঁর বন্ধু ড. বীরেন ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণায় জানা যায় : “তিনি মনে প্রাণে সোস্যালিস্টদের পক্ষপাতী। কম্যুনিস্টদের সংগঠন ক্ষমতার তিনি প্রশংসা করতেন,” (দ্রষ্টব্যঃ “সকল কাজের সেবা’’, ‘সতীনাথ স্মরণে’, সুবল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ৬২)। এই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণ, গঙ্গাশরণ সিং ও বিহারের অন্যান্য সোসালিস্ট কর্মীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। প্রকৃতপক্ষে ‘৪২-এর আন্দোলনের সময় থেকেই তার যুক্তিবাদী মন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের সংকীর্ণতা, দলাদলি, ক্ষমতা অর্জনের জন্য লোভ ও আদর্শগত গোঁড়ামি দেখে সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবু কোনরকম কারণ না দেখিয়ে ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দে কংগ্রেসী পদে ইস্তফা দেন। পরে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টিতে আসেন। কিন্তু সেখানেও এই তীক্ষ্ণধী, সত্যপ্রিয় মানুষটি কিষান-মজদুর সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করায় পার্টির ধনী সদস্যরা আতঙ্কিত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সতীনাথ পার্টি ত্যাগ করেন, জীবনধর্মী সাহিত্য রচনায় মন দেন। অনুগত সহকর্মী ফণীশ্বর নাথ রেণুর স্মৃতিচারণায় জানা যায় : “ভাদুড়ীজীর পার্টি ত্যাগের জন্য জমিদার পুত্ররা আনন্দিত হয়েছিলেন”।

সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখক-জীবন:

সতীনাথের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয় ভাষাচর্চা ও নানাবিধ গ্রন্থপাঠ। মনোজগৎ সমৃদ্ধ হয় বাংলা ছাড়া হিন্দী-উর্দু-সংস্কৃত এবং ইংরেজ ফরাসী-জার্মান-রাশিয়ান ভাষা শিক্ষায় এবং মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ধর্মনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ের অনুসন্ধানে। পড়েন স্পিনোজা, লুকাচ, ঈশপ সিমোন দ্য বোভেয়া, অ্যাশলি মন্টেণ্ড, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, তুলসীদাস, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, মানিক, সার্ত্রে, কাম্যু, জন ওয়েল, কিংসলি, অ্যামিস ফকনার, ব্যালজাক, মার্সেল প্রুস্ত, শেকসপিয়ার, মার্কস, আইনস্টাইন, নীলস বোর প্রমুখ মনীষীদের রচনা। প্রথম দিকে যোগ দেন পূর্ণিয়ায় সাহিত্যিকদের ‘দাদামশায়’ কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের আসরে। লেখেন ‘নবশক্তি’, ‘বিচিত্রা’ প্রভৃতি পত্রিকায় কিছু Satire জাতীয় লেখা। তবে প্রকৃত লেখকরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘জাগরী’ থেকে। ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলে বসে লেখা হয় এই আশ্চর্য রচনাটি, লেখকের ভাষায় ‘একসপেরিমেন্ট’। এর পর লেখা হয় তাঁর অন্যান্য গল্প-উপন্যাস। ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে জার্মানী, অস্ট্রিয়া এবং ফরাসী দেশে যান। ফরাসী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর নিজের ইচ্ছামত পড়াশুনা করেন। ফ্রান্সে থাকাকালীন ‘জাগরী’র রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ পান। তবে রাশিয়ায় গিয়ে সমাজজীবন ও অর্থনৈতিক উন্নতি দর্শনের আকাঙ্ক্ষা ঐ দেশের সরকারের অনুমতির অভাবে অপূর্ণ থেকে যায়। ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের জুন মাসে ভারতে ফিরে আসেন। তারপর পূর্ণিয়ার বিরাট বাড়ীতে ফুল ফুটিয়ে, ঋতুতে ঋতুতে পাখিদের আসা যাওয়া লক্ষ্য করে আর সাহিত্যচর্চা করে কেটে যায় তার বাকী জীবন। ১৯৫১ থেকে ১৯৬৫-র মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর অন্যান্য উপন্যাস এবং গল্প সঙ্কলন। ১৯৬৫ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে মার্চ এই ‘মিতবাক’ সত্যনিষ্ঠ অকৃতদার লেখকের জীবনাবসান হয়।

সতীনাথ ভাদুড়ীর রচনাসমূহ:

(ক) সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস : ‘জাগরী’ (১৯৪৫), ‘ঢেঁাড়াই চরিতমানস’ (প্রথম চরণ ১৯৪৯, দ্বিতীয় চরণ ১৯৫১), ‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’ (১৯৪৯), ‘সত্যি ভ্রমণকাহিনী’ (১৯৫১), ‘অচিনরাগিণী’ (১৯৫৪), ‘সংকট’ (১৯৫৭), ‘দিকভ্রান্ত’ (১৯৬৬)।

(খ) সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প সংকলন : ‘গণনায়ক’ (১৯৪৮), ‘অপরিচিতা’ (১৯৫৪), ‘চকাচকি’ (১৯৫৬), ‘পত্রলেখার বাবা’ (১৯৬০), ‘জলভ্রমি’ (১৯৬২), ‘আলোকদৃষ্টি’ (১৯৬২), ‘সতীনাথ-বিচিত্রা’ (মৃত্যুর পর প্রকাশিত)।

সতীনাথের রাজনীতি-সচেতন জীবনভাবনার প্রথম প্রকাশ ‘জাগরী’। এটি প্রথম রবীন্দ্র-পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস। UNESCO থেকে লীলা রায়-কৃত এর ইংরেজি অনুবাদ ‘The Vigil’ (1865) নামে প্রকাশিত হয়। ‘জাগরী’ শব্দের অভিধানিক অর্থ, বিনিদ্র। ফাসীর দণ্ডে অভিযুক্ত এক রাজবন্দী আসামীর সঙ্গে তার বাবা-মা এবং ছোট ভাই নীলুর সারা রাতের স্মৃতিচারণায় কাহিনী-কথন। এক ‘রাষ্ট্রীয় পরিবারে’র ঘটনা এর মূল অবলম্বন। উৎস—হাজারীবাগ জেলে থাকার সময় সতীনাথ পুরুলিয়ার ‘ঋষি’ নিবারণচন্দ্র দাসগুপ্ত এবং তার ছেলে বিভূতি দাসগুপ্ত, অতুল ঘোষ ও তার সহধর্মিণীর সঙ্গে পরিচয় মারফৎ শোনেন সত্যাগ্রহী এক পরিবারের ঘটনা। উপন্যাসের কাহিনীতে দেখা যায়, ‘ফাসী সেলে’ আসামী বিলু, ‘আপার ডিভিশন সেলে’ বাবা, ‘আওরৎ কিতা’য় মা এবং জেল গেটের বাইরে নীলু জীবন-বিশ্লেষণে রত। ‘৪২-এর আন্দোলনে উত্তাল পূর্ণিয়া জেলা ও জনজীবন এর রাজনৈতিক পটভূমি। কংগ্রেস, কংগ্রেস সোস্যালিস্ট এবং কমিউনিস্ট—এই তিনটি দলের রাজনৈতিক মতাদর্শ যথাক্রমে বাবা, বিলু এবং নীলুর মাধ্যমে উপস্থাপিত। কিন্তু কোথাও চরিত্রগুলি রাজনৈতিক মতাদর্শের পুতুলে পরিণত হয়নি, লেখকের ব্যক্তিগত পক্ষপাত কখনও অন্যমতকে আচ্ছন্ন করেনি। শ্রেণীগত বিচারে এই উপন্যাস যেমন রাজনৈতিক, তেমনি আঞ্চলিকও বটে। সমালোচকের ভাষায় :- “রাজনীতির ভিতরের যে রাজনীতি অর্থাৎ ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখলের কূটনীতি যা চিরদিনই রাজনীতির পরিবেশ ক্লিন্ন করে তোলে, যা বিহারের রাজনীতিতে আবহমান কালের দুষ্ট ক্ষত, সতীনাথ সেদিকেও থাকেন সতর্ক, তাই দেখা যায় সদাশিউ বনাম বৈজনাথের কদর্য-কলুষ মূর্তি দুটি, রকমারি আধিদৈবিক বিশ্বাস আর অজ্ঞানতা নিয়ে পূর্ণিয়ার যে সংস্কারগ্রস্ত লোকজীবন তার আর্ত অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করে সে দিকেও সতীনাথ পূর্ণমাত্রায় সচেতন” (দ্রষ্টব্য : “সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প উপন্যাস”, “বাংলা কথা সাহিত্যে বিহারের লোকজীবন’, বারিদবরণ চক্রবর্তী, জুলাই ১৯১১, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, পৃষ্ঠা ৩১৭ ৩১৮)। এই উপন্যাসের শিল্পরীতির অনন্য বৈশিষ্ট্য— চেতনাপ্রবাহ রীতির সার্থক প্রয়োগ। সমালোচকের বিচারে“বস্তুতঃ চেতনাপ্রবাহরীতির যে সার্থক প্রয়োগ ‘জাগরী’তে দেখা গেছে তা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে বাংলা উপন্যাসে বিরল দর্শন। লেখক অশেষ নৈপুণ্যে একটি অখণ্ড রসলোক নির্মাণ করেছেন, অসংখ্য প্রসঙ্গ ও অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে চেতনাপ্রবাহকে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে পরিণত করেছেন।”

সতীনাথ ভাদুড়ীর আঞ্চলিক জীবন ও রাজনীতি ভাবনা:

‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসে আঞ্চলিক জীবন ও রাজনীতি ভাবনার সর্বোত্তম প্রকাশ এই অঞ্চল বিহারের মফস্বল শহর জিরানিয়া, তার থেকে মাইল চারেক দূরে তাত্মাটুলির চিত্র। এই তাত্মাটুলির বাসিন্দা বুধনীর ছেলে ঢোঁড়াই। শৈশবেই পিতৃহারা পরে জননী পরিত্যক্ত। গ্রামের পূজারী বৌকা বাওয়ার দ্বারা পালিত হয়। এই ঢেঁাড়াই একদিন বড় হয়, বিদেশিয়া মেয়ে রামাইয়াকে বিয়ে করে, রামাইয়া তাকে ছেড়ে চলে যায়। বৌকা বাওয়াও গ্রাম ত্যাগ করে। ঢেঁাড়াই তাত্মাটুলি ছেড়ে নতুন পরিবেশ-মানুষ-বৃত্তির সংস্পর্শে এসে নবজন্ম লাভ করে। এখানে তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে দেশচেতনা। মহাত্মাজীর চেলা কংগ্রেসকর্মী চেঁাড়াই দেশের জনমনের সঙ্গ পেয়ে রূপান্তরিত এক নতুন মানুষ হয়ে ওঠে। গ্রামীণ কিশোর টোড়াইয়ের চরিত্রে এই পরিবর্তন দৃশ্যই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া “বিহারের গ্রামাঞ্চল তার সমস্ত লৌকিক ও অলৌকিক বিশ্বাস ও সংস্কার নিয়ে এ উপন্যাসে দেখা দিয়েছে। তুলসীদাসজীর রামচরিতমানসের শ্লোক আবৃত্তিতে মুখরিত হয়েছে পরিবেশ। বৌকা বাওয়া, রেবণ গুণী, ধনুয়া মাহাতো, রতিয়া ছড়িদার, বাবুলাল চাপরাসী, আর জোয়ান ছোকরার দল (ঢেঁাড়াই, শনিচরা, বিরসা, শুক্রা, এতোয়ারী), রামিয়া, ফুলঝরিয়া ঢোড়াই-দুখিয়ার মা, মাহাতো গিন্নী, গুদরমাই প্রমুখ পুরুষ ও নারীচরিত্র, চাষবাস, হাটবাজার, জমিদার মহাজন, পুলিশের অত্যাচারের নানা ঘটনা, ভীরু লোভী নির্বোধ অসহায় মানুষগুলির ভুলভ্রান্তি দুর্বলতার নানা ছবি—সবটা মিলিয়ে এক আশ্চর্য জগৎ আমাদের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে, যা ভৌগোলিক সীমা-সংহতিতে আবদ্ধ, যেখানে মানবমনের উপর প্রকৃতি ও অলৌকিক ধারণা সংস্কারের অখণ্ড প্রতাপ, যেখানে জীবনস্বাদের অনন্যতার মধ্য দিয়ে এক সার্বভৌম সত্যের ইশারা”।

সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাসে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের চিত্র:

‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’ উপন্যাসটি বলীরামপুর জুট মিলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ঘটনা অবলম্বনে রচিত। উপন্যাসটি প্রথমে ১৩৫৫ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে মাতৃভূমি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ‘মাসিক বসুমতী’তে ‘মীনাকুমারী’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে উপরোক্ত নামটি বজায় থাকে। উপন্যাসটির কাহিনীকাল স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় থেকে গান্ধীজীর মৃত্যুর পরদিন পর্যন্ত বিস্তৃত। বিহারের কাটিহার জুটমিলে শ্রমিক শোষণের (এই জুটমিলকে কেন্দ্র করে ফণীশ্বর নাথ রেণু লেখেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পরতি-পরকথা’) মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাই লেখকের উপন্যাস রচনার প্রেরণা।

জুটমিল এবং শ্রমিক জীবনের বিবরণ এই উপন্যাসের মুখ্য বিষয়। কারণে অকারণে মিছিল, হরতালের হিড়িক, মজুরদের ড্রিলের ক্লাস, তাড়ির দোকানের কোলাহল, মজুর ব্যারাকের কীর্তন, রক্ত গরম করা গানের সমারোহ, থানা-পুলিশ ইত্যাদি চাঞ্চল্যকর বিবরণে উপন্যাসটি পূর্ণ। ‘কেসরপাক’ তৈরী উপলক্ষ্যে শ্রমিকদের ইউনিয়ন নেতাদের চঁাদা আদায়ের নামে লুঠেরা মনোভাবের তীব্র সমালোচনা এখানে উপস্থিত‘মজুরদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা পয়সা ভাওতা মেরে লুঠে নেওয়ার জন্য এসেছে এই ইউনিয়নওয়ালারা” (দ্রষ্টব্যঃ “চিত্রগুপ্তের ফাইল”, সতীনাথ গ্রন্থাবলী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২)। এই রাজনৈতিক বাতাবরণে অভিমন্যু-শিউসরণের সখ্যতা ও মনাস্তর এবং অভিমন্যু ও মিনাকুমারীর মধ্যে রোমান্সের বিষাদান্ত পরিণতি দেখা যায়। উপন্যাসের সমাপ্তি অংশে সাহিত্য সমালোচকের শ্লেষাত্মক পরিচয় উদঘাটিত : “চিত্রগুপ্ত তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম। তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহিত্য সমালোচক। সাহিত্য সমালোচনায় পয়সা নাই। সেই জন্য লেটারহেড ছাপিয়ে একটা নূতন ব্যবসা খুলে বসেছেন—ডাকযোগে গল্প লেখা শেখানো। আজকাল মিলন, বিরহ, স্বাভাবিক, মৃত্যু, আত্মহত্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, আকস্মিক দুর্ঘটনা ইত্যাদি পনেরটি পাঠে তিনি পনেরটি প্লটের সংকেত দিয়ে দেন। ঐ সংকেতের ধারে গল্প লিখে এসে সেগুলির সম্বন্ধে নিজের মন্তব্য আবার লিখে পাঠান লেখককে।”

সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাসে ব্যক্তিমানুষের স্বরূপ:

‘অচিনরাগিণী’, ‘সঙ্কট’, ‘দিকভ্রান্ত’ উপন্যাস তিনটির কোনটাই রাজনীতিধর্মী নয়, গোষ্ঠীবদ্ধ কোন সামাজিক আখ্যানও নয়, মূলতঃ নিঃসঙ্গ ছন্নছাড়া ব্যক্তি মানুষের স্বরূপ ব্যাখ্যান। এর মধ্যে প্রথমটির ব্যাখ্যা ঔপন্যাসিকের কলমে “পিলে নতুন-দিদিমা তুলসী, তিনজনকে নিয়ে এই ‘টান ভালবাসা’র গল্প। শোনা পিলের মুখে।” বস্তুত, এই গল্প কোন একটানা অনর্গল বলে যাওয়া কাহিনী নয়। খণ্ড-অধ্যায়-পরিচ্ছেদেও বিভক্ত নয়। স্মৃতিমূলক অনুষঙ্গ আর চেতনাপ্রবাহের আপাত শিথিল গ্রন্থনার মধ্য দিয়ে গল্পের উপস্থাপনা।

‘সংকট’ উপন্যাসের নায়ক যুক্তিনাথ বিশ্বাস এককালের প্রিয় রাজনীতি, বাইরের জগতের প্রতি নিঃস্পৃহ। তিনি এখন আত্মানুসন্ধানে রত। তার মতে, “প্রত্যেকেরই এমন এক-একটা মুহূর্তের অভিজ্ঞতা হয়, যে-সময় সে জানা—নিজের বাইরে চলে যায়; অজানতে অন্যরকম হয়ে যায়; কী হয়ে গিয়েছিল পরে মনে থাকে না! পরে মনে থাকবার কথাও না—নিজের অজ্ঞাতে হয়েছিল। যে। সে সব সময় কী হয়? মন কি অন্য কোথাও চলে যায়? আর এক জগতের পরশ নয়ত!” সমালোচকের উপলব্ধিতে, “মনে হয় বিশ্বাসজীর মারফৎ লেখক আত্মানুসন্ধানে বেরিয়েছেন। ঘটনাপ্রধান উপন্যাস থেকে চরিত্রপ্রধান উপন্যাস, আবার তা থেকে লেখক ব্যক্তিত্ব প্রধান উপন্যাস। এই ক্রমিক অগ্রগতির শেষ ধাপের নিদর্শন সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস” (“কালের প্রতিমা’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৩)। কিন্তু কেবল ব্যক্তিমানুষের আত্মানুসন্ধান নয়, গতিশীল জীবনে, রাজনৈতিক অভিঘাত, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দারিদ্র্য ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত হয়ে সামাজিক বিধি-নিয়ম সংস্কারগুলি কিভাবে বন্ধন হয়ে ওঠে তার পরিচয় আছে মুনিয়া, মুনিয়ার মা, রামধনী, রঘুয়া, অঘোরীবাবা, তালেবর, গুজরাতির মা ইত্যাদি চরিত্রের মধ্যে।

‘দিকভ্রান্ত’ উপন্যাসে একালের মানুষের বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা সুবোধ ডাক্তারের পরিবারকে (স্ত্রী অতসীবালা, কন্যা মণি ও পুত্র সুশীল) আশ্রয় করে প্রকাশিত। তেইশটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই উপন্যাসের কাহিনী। ধর্মের নামে মোহগ্রস্ততা, ছোটখাট নানা ঘটনার চাপে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ কিভাবে দিকভ্রান্ত হয় তার নির্মম নিপুণ বিশ্লেষণ আছে এই উপন্যাসে। সতীনাথ এই উপন্যাসে সঙ্কটের প্রকৃতি ও স্বরূপ দেখিয়ে প্রতিটি চরিত্রের অন্তহীন আত্মান্বেষণের মধ্য দিয়ে সঙ্কট মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। যেমন—বাড়ির কাছে যজ্ঞডুমুরের গাছে ঝুলে হরিদাসের আত্মহত্যার কথা ভেবে, “একই অজানা ভয় চারজনের হৃদয়ে রাহুমুক্তির মুহূর্ত। নিজেকে ভুলেছে এখন প্রত্যেকে। চারটি হৃদয়ের মধ্যে দুরতিক্রম্য প্রাচীর ধসে পড়েছে মুহূর্তে নড়বড়ে পরিবারের কাঠামোটা তার পুরনো ভারসাম্য ফিরে পাবে। যজ্ঞডুমুরের গাছটার ছায়া ক্রমে ছোট হয়ে আসবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।”

সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্প সঙ্কলন:

ঔপন্যাসিক সতীনাথ বেশ কিছু সার্থক ছোটগল্পেরও স্রষ্টা। তাঁর গল্প সংখ্যা ৬২। দেশ, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, যুগান্তর, পরিচয়, বিচিত্রা, চতুরঙ্গ, পূর্বাশা, দৈনিক কৃষক, স্বাধীনতা, বিশ্বভারতী ইত্যাদি খ্যাতনামা পত্রিকায় তার গল্পগুলি প্রকাশিত হয়। তাঁর গল্পের উৎস বাস্তব অভিজ্ঞতা। বৈশিষ্ট্য :

  • (ক) মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী,
  • (খ) ব্যঙ্গপ্রবণতা,
  • (গ) মননশীলতা,
  • (ঘ) নিরাসক্তি।

তাঁর গল্পের পটভূমি পূর্ণিয়ার মাটি ও মানুষজন। সেই অর্থে হয়ত তিনি কিছুটা আঞ্চলিক। “কিন্তু যেখানে তাঁর সৃষ্টি এই মানসিকতা ছাড়িয়ে নির্বিশেষ হয়ে উঠতে পেরেছে তার সতর্কতা, আত্মসমালোচনা, মার্জিত এবং পর্যবেক্ষণের নিপুণতায়, সেখানে তিনি কালোত্তীর্ণ রচনার স্রষ্টা” (দ্রষ্টব্য : সতীনাথ ভাদুড়ীর নির্বাচিত রচনা’, ‘প্রাক্-কথন’, বারিদ বরণ ঘোষ, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৫, পৃষ্ঠা ১৩)। এই পর্যায়ে কয়েকটি গল্পের নাম উল্লেখযোগ্য : ‘গণনায়ক’, ‘বন্যা’, ‘আন্টা বাংলা’, ‘চকাচকী’, ‘বৈয়াকরণ’, ‘চরণদাস এম, এ’, ‘মুনাফা ঠাকরুণ’, ‘পত্রলেখার বাবা’, ‘ডাকাতের মা’ ইত্যাদি। অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে সতীনাথের স্বাতন্ত্র্য একটি ক্ষেত্রে দেখা যায় এই যে, তিনি কখনই একই গল্পের প্লট নিয়ে বক্তব্যের পুনরুক্তি করেন নি।

সতীনাথের সাহিত্যচর্চার সূচনা হয় গল্প লিখে। তরুণ বয়সে লেখা প্রথম গল্প ‘জামাইবাবু’, ‘বিচিত্রা’ (১৩৩৮ অগ্রহায়ণ, ১৯৩২ খ্রীঃ) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর বিষয় মূল্য অকিঞ্চিৎকর।

পরবর্তী ‘গণনায়ক’ গল্প সংকলন থেকেই তাঁর যথার্থ আত্মপ্রকাশ। দেশ বিভাগের সমকালে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে কিভাবে পয়সা করেছিল মুনীমজীর মতো ভণ্ড দেশভক্তেরা, ‘গণনায়ক’ গল্পে আছে তার পরিচয়। ‘কমিশনে’র রায় বেরোবার আগেই সে ভারত-পাকিস্তানের পতাকা বিক্রী করে। তারপর অঞ্চল অনুযায়ী দেশভাগ হলে দুই সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পতাকা ফিরিয়ে নিয়ে আবার অন্যত্র বেচবার ফন্দী করে।

‘বন্যা’ গল্পে দেখা যায় নৈসর্গিক বিপদ কিভাবে সামাজিক মর্যাদা জাতপাতের ক্ষুদ্র স্বার্থের ভেদরেখা মুছে দিয়েছিল। নৌখে ঝা আর সুমৃৎ তিয়রের পরিবার দুটিকে তথা ব্রাহ্মণ ও তিয়র জাতিকে একত্র করেছিল। কিন্তু কুশী নদীর বন্যার জল শুকিয়ে যাওয়ার পরে আবার সেই পুরানো কলহ জেগে উঠেছে। ‘আন্টা বাংলা’ গল্পে পূর্ণিয়ার নীলকর বংশধরদের পাশবিক অত্যাচার এবং খ্রীস্টান ওঁরাওদের দাসজীবনের যন্ত্রণার ঐতিহাসিক চিত্র বর্ণিত।

জনপ্রতিনিধিদের চরিত্রহীনতা ও তোষণনীতির তীব্র সমালোচনা ‘এক চক্ষু’ গল্প। হরিতকী থানার সিরিটোল গ্রামের পটভূমিতে বিশম্ভুরবাবু ও সূচিত মণ্ডল চরিত্র দুটির মধ্য দিয়ে লেখকের ভোটের রাজনীতি সম্পর্কে সতর্ক সঙ্কেত অনুভব করা যায়।

তাঁর ‘করদাতা সংঘ জিন্দাবাদ’ এবং ‘পরকীয়া সন্‌-ইন ল’ গল্পের মধ্যেও দলীয় রাজনীতির সরস সমালোচনা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

‘ভূত’ গল্পে আছে সুরজকুমারীর বিবাহকে কেন্দ্র করে বিহারের গ্রাম বনাম শহরের কায়স্থ সমাজের দ্বন্দ্বময় চিত্র। তবে শেষপর্যন্ত এই গল্পের মূল দ্বন্দ্ব হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে ইঙ্গিতে নির্দেশিত।

‘বৈয়াকরণ’ গল্পে মৌলবী এবং সংস্কৃত পণ্ডিত তুরস্তলাল মিশ্রের পারস্পরিক তুলনার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়াসক্তির প্রকাশরূপ বিশ্লেষিত। পার্থক্য কেবল ইন্দ্রিয়াসক্ত মৌলবী সাহেবের ক্ষেত্রে এর বিকাশ স্থূল ভাবে, আর পণ্ডিতজীর ক্ষেত্রে মনোবিকার চোরাপথে ব্যক্ত হয়েছে।

আবার প্রবাসী বাঙালীর পরিচয় দিতে নয়, বৈজ্ঞানিক নৈর্ব্যক্তিকতায় সতীনাথ মধ্যবিত্ত বাঙালীর যুদ্ধকালীন স্বার্থান্ধতার নির্মম চিত্র এঁকেছেন ‘পরিচিতা’, ‘দাম্পত্য সীমান্তে’, ‘সরমা’, প্রভৃতি গল্পে। প্রথমটিতে একশ আটাশ টাকা মাইনের কেরানীর বউ শৈল দেশভাগে আগত উদ্বাস্তুদের দেশে দেখে উৎফুল্ল, কারণ কম টাকায় তাহলে “চাপা টাপাদের মতো ঝি” পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় গল্পের নায়ক পোস্টাফিসের কর্মচারী নিবারণ পার্শেল ব্যাগের চোরা-কারবারে স্ত্রীর সাক্ষ্যে ধরা পড়ে গিয়ে পুলিশ অফিসারকে বলে “কী পরিমাণ বদ দেখছেন তো হুজুর মেয়েমানুষটা। নাগরকে বাঁচিয়ে স্বামীকে জেলে পুরতে চায়”।

আর ‘সরমা’ গল্পে যখন ডোমেরা জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিলে মুক্তহস্তে দান করে, তখন চরম নির্লিপ্ত কুকুর-বিলাসী হরেনবাবু স্থানীয় অঞ্চলে এয়ার বেস হলে কিভাবে কত পরিমাণে প্যারাশুটের রেশমী দড়ি পাওয়া যাবে, ভাবতে থাকেন। কারণ সেই দড়িতে এত ভাল কুকুরের গলার বেল্ট হবে, “অ্যালসেশিয়ান, গ্রেটডেন, ম্যাস্টিক, ব্লাডহাউন্ড কারও দম নেই সেই দড়ি ছেঁড়ে।” আসলে “সতীনাথের গল্পগুলির মৌলিকত্ব এখানেই,—তাঁর গল্পগুলিতে একটি বিশিষ্ট ভৌগোলিক পটভূমিকা থাকে, স্থানে স্থানে গল্পবিশেষে জনপদজীবনের পরিচায়কও বটে। কিন্তু সেখানেই তা থেমে যায় না, ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে সার্বজনীন প্রতীতি ভূমিতে। গল্প শুরুর প্রথমে সযত্নে রচিত হতে থাকে যে ভৌগোলিক পরিমণ্ডলটি, সমাপ্তিতে সেটিই অনিবার্যভাবে ভেঙে যায়,–আত্মপ্রকাশ করে মনস্তাত্ত্বিক ও ঘটনাগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিরদিনের মানবসত্তা”।

আধুনিক বাংলা কথা সাহিত্যের জগতে এই সদাজাগ্রত, মননদীপ্ত শিল্পীকে না স্মরণ করলে তাই কিছুতেই মনের অন্ধকার কেটে সকাল হয় না।