“এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ঘটনার স্রোত বয়ে চলেছে। যুদ্ধ, হত্যা, কত দ্রুত রাজনৈতিক পরিবর্তন। সব খবরের কাগজে পড়ে যাই বড় বড় ছাপার অক্ষরে, কিন্তু মনে কোন ছাপ পড়ে না। সে সব দূরবর্তী দেশের কথা, চোখের আড়ালে যেখানে, ঘটনা তরঙ্গায়িত হয়ে চলেছে তার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আমার চোখের সামনে, আমার চারপাশেও তো কত ছোট ছোট ঘটনার ঢেউ উঠেছে। সে সম্বন্ধেও তো কোন সচেতনতা নেই” (নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড, বিশেষ সংস্করণ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৬৩০) চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনার নানারূপে প্রকাশের এই অকপট শান্তশীল মনোভাবেই নরেন্দ্রনাথ মিত্র স্বাতন্ত্র্য-চিহ্নিত।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের জন্ম-বাল্য-শিক্ষা-কর্মজীবন:
১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারী, ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত সদরদি ভাঙা গ্রামে নরেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। পিতা, মহেন্দ্রনাথ, মা বিরাজবালা। নরেন্দ্রনাথ শৈশবেই হন মাতৃহারা।
তিনি বিমাতা জগমোহিনীর আশ্রয়েই মানুষ হন। শিশু নরেন্দ্রনাথের (ডাক নাম পন্টু) কাছে তিনিই আজন্ম মা-রূপে স্বীকৃত। পিতা বৈষয়িক কাজে দক্ষ ব্যক্তি, উকিলের সেরেস্তায় মুহুরী, কিন্তু গানে-অভিনয়ে-কাব্য উপন্যাস পাঠে এবং চিঠিপত্র লেখায় পারদর্শী ছিলেন। প্রথমে দারিদ্র্য তারপরে একান্নবর্তী পরিবারের দায়িত্বের বোঝা ইত্যাদির ফলে লেখাপড়া গান-বাজনার ইচ্ছা সত্ত্বেও সুযোগে বঞ্চিত হন। এই বাবা বাদে তার আর এক মামা চাকলাদার ঠাকুর্দা লেখকের শিশুমনে কিছুটা ছায়া ফেলেন। তবে খুড়তুতো ছোট ভাই কান্দুর তুলনায় নিজের অযোগ্যতা সম্পর্কে তিনি প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন : “শুধু বাবা নয়, আত্মীয়-স্বজন সবারই আচরণে আমি অনুভব করতাম আমি যেন কেমন কেমন। সবদিক থেকে আমি নিম্ন সাধারণ। সেই বোধ আমাকে পাঁচজনের সঙ্গ এড়াতে শেখাল। বুঝিয়ে দিল ঘরের কোণ আর নিজের মন ছাড়া তোমার কেউ নেই” (“স্মৃতি চিন্তা,” ‘বাবা’, নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০১)।
প্রথম লেখাপড়া গ্রামে অক্ষয় মাস্টারের কাছে, তারপর এম. ই. স্কুলে। পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষার অগ্রগতি থাকলেও ফলাফল সাধারণ মানের ১৩৫৩ সাল বা তার কিছুকাল আগে থেকে নরেন্দ্রনাথের পরিবারের নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবনের অবসান হয়। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সারা বাংলা তখন বিধ্বস্ত, রাজনীতির চক্রান্তে দ্বিখণ্ডিত। পূর্ববঙ্গবাসীরা বিশেষভাবে হিন্দুদের জীবন তখন বিশেষভাবে বিপন্ন তারা সকলেই প্রায় ছিন্নমূল। পিতার মৃত্যুর ফলে সংসার আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হয়।
নরেন্দ্রনাথের ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে কলকাতায় আগমন হয়। কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্কের জব্বলপুর শাখায় বদলি হন, পরে পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায়, হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় কলকাতা তখন বিধ্বস্ত। অনুজ ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে নরেন্দ্রনাথের ৭/১, ব্রজদুলাল স্ট্রীটে এক সঙ্কীর্ণ গৃহে আশ্রয়গ্রহণ। এই পরিবেশেই শুরু হল সাহিত্যসাধনা। প্রকাশিত হল প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ’ (নামান্তরে ‘দ্বীপপুঞ্জ’)। ব্যাঙ্কে চাকরি করার সময় নরেন্দ্রনাথ বিপদে পড়েন। এক অসাধু ডিপজিটরের জাল সইয়ের কারসাজি বুঝতে না পেরে সাত হাজার টাকা তছরুপের দায়ে ফৌজদারী মামলার আসামী হয়ে যান। চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হন। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারক মি. ব্ল্যাক জুরিদের সঙ্গে একমত হয়ে তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, ডাক্তার পশুপতি ভট্টাচার্য প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ তাঁকে এইসময় নানাভাবে সাহায্য করেন। পরে নরেন্দ্রনাথ ব্যাঙ্কের কাজে যোগ দিয়েই ইস্তাফা দেন। অস্থায়ী পদে চাকরী করেন ‘কৃষক’, ‘স্বরাজ’, ‘সত্যযুগ’, ‘মন্দিরা’ পত্রিকায়। শেষে ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকায় স্থায়ী পদে যোগদান করেন কর্মসূত্রে বন্ধু হন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সাহিত্যিক বিমল কর, সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ এবং শাস্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভিন্ন স্থানে চাকরির মত একাধিকবার বাড়ি বদলের দুর্ভোগও নরেন্দ্রনাথকে ভোগ করতে হয়। যেমন দ্বিতীয়বার সপরিবারে আশ্রয় নেন ১১৯বি, নারকেলডাঙ্গা মেন রোডের ব্রজদুলাল স্ট্রীটে একটি দেড়খানা ঘরে আটজন একত্রে, তারপর ৯৮, লিন্টন স্ট্রীটের এক বস্তি বাড়িতে, শেষে ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ২০/১/এ, রাজা মণীন্দ্র রোডের এক বড় বাড়িতে। তাঁর শেষ জীবন এখানেই অতিবাহিত হয়।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যজীবন:
নরেন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন অন্যান্য সাহিত্যিকদের তুলনায় ছিল কিছুটা স্বতন্ত্র। তিনি কোন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কলম ধরেন নি। উল্টোরথ’ পত্রিকার লেখক শ্রীকিরণকুমার রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এবং চিঠিতে জানান তাঁর লেখক হওয়ার ইতিহাসঃ “কি করে লেখক হলাম, কেন লেখক হলাম তা এক কথা তো ভালো, একশ কথাতেও বলা যায় কিনা সন্দেহ। আমরা সাধারণ লোক সাধারণ লেখক সবসময় সচেতনভাবে বিশেষ একটা পরিকল্পনা নিয়ে কিছু হয়ে উঠিনে, কি কিছু করে বসিনে। কিছু হওয়ার পরে সেই হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে বসি। সব লেখকই আদিতে পাঠক, আমিও তাই ছিলাম। ছেলেবেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসতাম। বই যে লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করতে হয় অল্প বয়সে আমার সে ধারণা ছিল না, বইয়ের জন্য পাড়ার সদ্য বিবাহিতা বউদিদের কাছে হাত পাততাম। পাঠক হিসেবে মেয়েদের সঙ্গে সেই যে আমার গোপন আত্মীয়তা হয়েছিল আজ লেখক হিসেবেও প্রায় তাই আছে। গভর্নমেন্ট অফ্ দি পিপল্, বাই দি পিপল, এ্যান্ড ফর দি পিপল-এর মত আমি মেয়েদের নিয়ে লিখি, মেয়েদের হয়ে লিখি, মেয়েদের জন্য লিখি। একথা বলতে আমার লজ্জা নেই। পুরুষ পাঠক যদি দু’ একজন মেলে তাকে ভাগ্য বলে মানি” (দ্রষ্টব্যঃ উদ্ধৃত, ‘তথ্যপঞ্জী ও গ্রন্থ পরিচয়’, নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, ২, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৬)।
এই পড়ার আগে শোনার শিক্ষা বাবার কাছে “আমার লেখক জীবন গঠনের মূলে একজন শক্তিবান ব্যক্তিত্ববান পুরুষ ছিলেন। তিনি আমার বাবা। তিনি আমাকে হাত ধরে লেখাননি কিন্তু মুখে মুখে পড়িয়েছেন। সেই যে ছন্দ দিয়ে ধ্বনি দিয়ে আরম্ভ সুর দিয়ে দিনের শুরু, জীবনের শুরু, তা কি ভুলতে পারি” (তথ্যপঞ্জী ও গ্রন্থপরিচয়’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৬ ৬৩৭)। এই বাবা বাদে তাঁর ছোট ভাই ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর লেখার প্রধান উৎসাহদাতা। লেখকের মতে, “তার সমালোচনা ও পরামর্শের প্রভাবে আমার বহু রচনাকে মার্জিত এবং নিয়ন্ত্রিত করেছে” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৭)।
এছাড়া “বহু বন্ধুর উৎসাহ আনুকূল্য লেখক হিসেবে” তার জীবনে উৎসাহ ও প্রেরণাদাতা রূপে স্মরণীয়। মেসজীবন, একাধিক বাসাবদল, যুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি ঘটনাসমূহের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয় নরেন্দ্রনাথের লেখকজীবন। স্বভাবতই সংখ্যাধিক্যে এবং বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয় তার সাহিত্যজগৎ।
নরেন্দ্রনাথের প্রথম আত্মপ্রকাশ কবি রূপে। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয় ‘মূক’ নামে প্রথম কবিতা। তারপর ১৯৩৬-১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ‘দেশ’-এ চারটি গল্প, ‘প্রবাসী-বিচিত্রা-বঙ্গশ্রী-পরিচয়’-এ চারটি গল্প প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ’ (১৯৪২) ‘দেশ’-এ মুদ্রিত, পরে ‘দ্বীপপুঞ্জ’ (১৯৪৬) নামে পরিবর্তিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘রূপমঞ্জরী’ (১৮৬০)।
নরেন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসগুলি খ্যাত-স্বল্পখ্যাত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যেমন দেশ প্রবাসী বিচিত্রা বঙ্গশ্রী-পরিচয়-জনসেবক-গণবার্তা ইদানীং চতুষ্কোণ চতুরঙ্গ মানসী ভারতবর্ষ, বসুধারা, বসুমতী, সত্যযুগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, বেতার জগৎ প্রভৃতি। সিনেমা, রেডিও এবং টি.ভি.-তে গৃহীত হয় তাঁর একাধিক গল্প উপন্যাস; যেমন ‘রস’ চলচিত্রে ‘সওদাগর’ নামে এবং ‘বিকল্প’, ‘অবতরণিকা’ ‘মহানগর’ নামে অভিনীত হয়।
সমালোচক ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর আলোচনায় (‘কালের প্রতিমা’, পৃষ্ঠা, ১৪০-১৪১) নরেন্দ্রনাথের উপন্যাস সমূহকে তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করেছেন : প্রথম পর্ব (১৯৪৬ ১৯৫১ খ্রীঃ), দ্বিতীয় পর্ব (১৯৫২-১৯৫৬ খ্রীঃ), তৃতীয় পর্ব (১৯৫৭-১৯৭১ খ্ৰীঃ)।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের রচনাসমূহ:
(ক) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের উপন্যাস : দ্বীপপুঞ্জ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘অক্ষরে অক্ষরে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘দেহমন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৭), ‘দূরভাষিণী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৯), ‘সঙ্গিনী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘চেনামহল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘গোধূলী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘অনুরাগিণী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘সহৃদয়া’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘শুক্লপক্ষ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘কন্যাকুমারী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), ‘অনামিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), ‘সুখ দুঃখের ঢেউ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), ‘কথা কও চোরাবালি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬, ১৩৬৭), ‘হেডমাস্টার’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘জলপ্রপাত’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘উত্তরপুরুষ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘একটি নায়িকার উপাখ্যান নায়িকা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), তিন দিন তিন রাত্রি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘রূপমঞ্জুরী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘হারানো মণি হারানো মন’ কিশোর উপন্যাস (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘উপনগর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘পরম্পরা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘মহানগর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭০), দ্বৈত সঙ্গীত’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘মুগ্ধ প্রহর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘পতনে উত্থানে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘তমস্বিনী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘সেতুবন্ধন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘সূর্যসাক্ষী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘দয়িতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘প্রতিধ্বনি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৭), ‘উপছায়া’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), ‘সুরের বাঁধনে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), ‘জল মাটির গন্ধ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮০)।
(খ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প সংকলন : ‘অসমতল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫২), ‘হলদে বাড়ি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘উল্টোরথ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘পতাকা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৪), ‘চড়াই উত্রাই’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘পাটরানী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৭), ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৯), ‘কাঠ গোলাপ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘অসবর্ণস্ব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬১), ‘ধূপকাঠি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬১), ‘মলাটের রঙ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬২), ‘রূপালী রেখা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘দীপান্বিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘ওপাশের দরজা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘একূল ওকূল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘বসন্ত পঞ্চম’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪), ‘মিশ্ররাগ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪), ‘উত্তরণ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), ‘পূর্বতনী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘অঙ্গীকার’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘দেবযানী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘রূপসজ্জা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘সভাপর্ব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘স্বরসন্ধি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘ময়ূরী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘বিদ্যুৎলতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘পত্রবিলাস’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘মিসেস গ্রীণ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘বিন্দু বিন্দু’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), একটি ফুলকে নিয়ে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘বিনি সুতার মালা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘যাত্রাপথ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘সুধা হালদার ও সম্প্রদায়’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘অনধিকারিণী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘রূপলাগি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭০), ‘চিলে কোঠা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘প্রজাপতির রঙ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), ‘অন্য নয়ন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), ‘বিবাহবাসর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩), ‘চন্দ্রমল্লিকা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৪), ‘সন্ধ্যারাগ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৫), ‘সেই পথটুকু’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘অনাগত’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), ‘পালঙ্ক’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), ‘উদ্যোগ পর্ব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), ‘বর্ণবহ্নি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮৪), বিকালের আলো’ (১৯৮৩), ‘নাগরিক প্রেমের উপাখ্যান’ (বঙ্গাব্দ ১৩৯০), ‘গল্পমালা-১’ (১৯৮৬), ‘কিশোর গল্পসমগ্র’ (বঙ্গাব্দ (১৩৯৫), ‘গল্পমালা-২’ (১৯৮৬), ‘স্রোতস্বতী’ (১৯৮৯), ‘সাধ সুখ স্বপ্ন’ (১৯৯০), ‘এইটুকু বাসা’ (১৯৯০), ‘গল্পমালা-৩’ (১৯৯২)।
(গ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের স্মৃতিমূলক রচনা : ‘আত্মকথা’ (১৯৭২), ‘গল্প লেখার গল্প’ (১৯৬৪), ‘আত্মচরিত’।
(ঘ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাব্য : ‘জোনাকি’, শ্রী বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সহ (বঙ্গাব্দ ১৩৪৫), ‘নিবিবিলি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩)।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্য রচনার সমকালে বাংলা উপন্যাস মানুষের বিচিত্র জটিল সম্পর্ক, মনোজগতের নানা রহস্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দাঙ্গা-দেশবিভাগ, খণ্ডিত স্বাধীনতা, নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রাণধারণ, দিনযাপনের গ্লানিকর সময় অতিবাহিত হয়। বলা বাহুল্য, এই সময়ের অধিবাসী হয়েই নরেন্দ্রনাথের মানিক-তারাশঙ্কর-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষ, সন্তোষ ঘোষ প্রমুখ পূর্বসূরী ও সমকালীন লেখকদের মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করেন। স্বভাবতই কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে তিনি চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য। সেই বৈশিষ্ট্যগুলিকে সূত্রাকারে সাজালে দেখা যায়—
(১) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যের বিষয় গ্রাম এবং নগরকেন্দ্রিক। গ্রামীণ বিষয় নিয়ে রচিত গল্প-উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রস’, ‘দ্বীপপুঞ্জ’, ‘সুখ দুঃখের ঢেউ’ প্রভৃতি। নগরকেন্দ্রিক গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা সেই তুলনায় অজস্র। ‘বিকল্প’, ‘চোর’, ‘দূরভাষিণী’, ‘চেনামহল’, ‘সূর্যসাক্ষী’ ইত্যাদি। আকারে কোনটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, কোনটি নভেলেট বা ছোট উপন্যাস। বিভিন্ন পত্রিকার পূজো সংখ্যায় তার অজস্র গল্প-উপন্যাস প্রকাশিত।
(২) কাহিনীর মধ্যে প্রায়শই নারীজীবনের প্রাধান্য; প্রণয়প্রবৃত্তি বিশেষতঃ নিষিদ্ধ প্রেমের চিত্রণ, এমন কি যৌন মনোবৃত্তির ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়।
(৩) নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবার জীবনের ভাঙন, মানুষের অন্তঃশায়ী লোভ ও আত্মসুখকেন্দ্রিক বাস্তব অবস্থান অনুভবের চেষ্টা দেখা যায়।
(৪) লেখায় একাকীত্ব ও বিষণ্ণতার প্রকাশ, লেখক-চরিত্রের ঘনিষ্ঠ উপস্থিতি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির আশ্রয়ে ঘটনাসত্যের উদ্ঘাটন হয়েছে।
(৫) অর্থনৈতিক অসাম্য এবং নিম্ন শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশা বিরোধ-বিদ্বেষ অনেক গল্পের উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এখানে বিদ্রোহ প্রধানত অভিমান কিংবা আত্মনিগ্রহের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। চরিত্রগুলির মধ্যে সংগ্রামের প্রত্যক্ষবোধ এবং বিরোধের সাহস বিশেষ চোখে পড়ে না।
(৬) তত্ত্ব বা দার্শনিকতায় ভারাক্রান্ত করে নয়, সরল প্রকাশরীতি ও প্রাত্যহিক জীবনের সহজ ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনায় বিশেষত্ব দেখা যায়।
নরেন্দ্রনাথের প্রথম পর্যায়ের উপন্যাসসমূহের মধ্যে ‘দ্বীপপুঞ্জ’ অন্যতম। উপন্যাসটির পটভূমি বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল। কীর্তন মুখরিত বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত পরিবেশে কাহিনীটি মূর্ত। উপন্যাসের ভূমিকায় লেখকের মন্তব্য: “আমার কোনো রচনাতেই অপরিচিতদের পরিচিত করবার উৎসাহ নেই। পরিচিতরাই সুপরিচিত হয়ে উঠেছে।” জোড় ভাঙা এক দাম্পত্য জীবনের অসুখ ও অ-স্বাচ্ছন্দ্যের সুতীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ এই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ।
বিবাহিত জীবনের এক নাটকীয় সন্ধিক্ষণ থেকে ‘সঙ্গিনী’ উপন্যাসের সূচনা। স্বামী অমিয়র অক্লান্ত শ্রমে অর্জিত টাকায় তার স্ত্রী জয়ার যক্ষ্মা হাসপাতাল থেকে প্রত্যাবর্তন ঘটে। কিন্তু ঘরে ফিরে আসার পর অশান্তি—জয়ার পায়ে Coldabses দেখে অমিয়র মনে ভয়, উদ্বেগ জাগে। তাদের সন্তান মঞ্জু দিদিমার আশ্রয়ে পালিত হয়। স্ত্রীরূপে স্বামীর সঙ্গ কামনায় বাধা পেয়ে “জয়ার মনে হতে লাগল অমিয় তাকে অপমান করছে।” এহেন সংশয়-কণ্টকিত মুহূর্তে অমিয়র আশ্রিত মনতোষ জয়ার জীবনে সুপ্ত বাসনার শিহরণ জাগায় : “ভারি আশ্চর্য কথা, ভারি অদ্ভুত কথা। জয়ার গায়ে ফুলের গন্ধ, জয়ার ভিতরে ফুলের মাধুর্য। তার দেহ আর রোগের বীজাণুর থলি নয়, ফুলের ডালি।”
অন্যদিকে অমিয়র সঙ্গে তার কমরেড সর্বাণীর সম্পর্ক অনুভব করে জয়া প্রেম ও বাসনার তীব্র পীড়নে মনতোষের সঙ্গে ঘর ছাড়ে। রেখে যায় সম্বোধন স্বাক্ষরবিহীন একটি চিঠি, যা পড়ে “একটা দুঃসহ যন্ত্রণাবোধে সমস্ত মন আচ্ছন্ন হল অমিয়র।” একসময় মনতোষের লালসালোল স্থূল অশিক্ষিত আকর্ষণ অসহ্য হয়। জয়া ফিরতে চায় স্বামীর ঘরে। শোনে অমিয় থাইসিসে আক্রান্ত। কদর্য গালাগালি দিয়ে মনতোষের হাতে মার খেয়ে জয়া ফিরে আসে অসুস্থ অমিয়র কাছে- “আমি তখন বলতুম, তোমার জন্যে আমি বেঁচে উঠব। আমার জন্যে তুমি বেঁচে ওঠো। আজ একথা বলবার মুখ আমার নেই। তুমি সকলের জন্যে বাঁচো, তুমি সকলের জন্য বেঁচে ওঠো অমিয়, কোনো কথা না বলে নিজের শীর্ণ হাতের মধ্যে জয়ার হাতখানা অমিয় তুলে নিল এবার।” শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্যে এটি উপন্যাস নয়, নভেলেট। কাহিনী উপকাহিনী বর্জিত। ঘটনা-বিস্তার বাহুল্যতা নেই, মতে, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ নৈপুণ্যে প্রেমের তীব্র জটিল দ্বন্দ্ব বিশ্লেষিত সমালোচকদের মতে “এটি রোমান্টিক উপন্যাস নয়। আবেগ অনুভূতি দিয়ে গাঁথা নয় এর প্রেম শতদল। এর রক্তরাগে এক কঠোর বাস্তব দেনাপাওনার টানাপোড়েন”।
নরেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে লেখা উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘দেহমন’, ‘দূরভাষিণী’, ‘চেনামহল’, ‘অনুরাগিণী’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘দেহমন’ উপন্যাসটির উৎস সম্পর্কে লেখকের অনুজ ধীরেন্দ্রনাথ মিত্র বলেছেন, লিন্টন স্ট্রীটের এক বস্তি বাড়িতে থাকার সময় ভাড়াটেদের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হত। এক ঘরে দুই বোন “বড়টি গ্রাজুয়েট। তার চালচলনে আমাদের আপত্তি ছিল। তিনিই বেশি শত্রুতা করতেন। ঝগড়া-ঝাটিতে দাদার লেখার ক্ষতি হত। দাদা বিরক্ত হত। কিন্তু চেঁচামেচির মধ্যে যেত না। কিছুদিন পরে দাদা একটা বই লিখল, ‘দেহমন’। আমরা দেখলাম যার সঙ্গে আমাদের এত শত্রুতা, যার সঙ্গে এত ঝগড়া, ‘দেহমন’-এর তিনিই নায়িকা”। কিন্তু ‘দেহমন’-এ এই অভিজ্ঞতা একেবারে রূপান্তরিত, এর ‘থীম’ বিষয়বস্তু যৌন মনস্তত্ত্ব। বলা বাহুল্য, উপন্যাসটি ফ্রয়েড-প্রভাবিত। বসো আলাপ করিয়ে দিই, ইনি শ্রীমতী রুবি রায়। আমাদের পাশের ঘরের প্রতিবেশিনী’–এই আলাপের সূত্রেই মার মারফৎ তার স্বামী বিভাসের সঙ্গে রুবির পরিচয়। প্রথমদিকে এই পরিচয় রুবির উগ্র সাজসজ্জায় এবং বিভাসের রক্ষণশীলতার বাধায় সহজ স্বাভাবিক হয়নি। বিভাস সম্পর্কে রুবির মূল্যায়ন ছিল প্রথমে বেশ অবজ্ঞাসূচক : “নিতান্তই সাধারণ কেরাণী গৃহস্থ। হাতে নীতিধর্মের গতানুগতিক ধ্বজা।” রুবি ঘরকন্নার বাঁধা সীমানায় বন্দী হতে নারাজ। এক অতৃপ্ত অস্থির তৃষ্ণায় সে সদা উন্মুখ। উমাকে সে ইঙ্গিতে বলেছে“তোর এক—আমার অনেক। তুই একেশ্বরবাদী—আমি ঘোরতর পৌত্তলিক, আমার তেত্রিশ কোটি দেবতা।” উমার কথায় “পুরুষ মানুষ ছাড়া ওর এক মূহূর্ত চলে না।” এই রুবি তার বান্ধবী উমার উস্কানী “তুই হেরে গেছিস ওর (অর্থাৎ বিভাস) কাছে” শুনে মোহময় জাল পাতে। বিভাস ধরা পড়ে। তার প্রবল নৈতিকতা, খাঁটি মধ্যবিত্ত বাঙালীর অবদমন আশ্রয়ী মানসিকতা, নরনারীর দেহমন সংক্রান্ত তত্ত্বভাবনার সাজ-সজ্জা ভেসে যায়। সমালোচকের ভাষায় : “বিভাস এক মারাত্মক ভুল করেছিল, তার আত্মসমীক্ষণ পর্যাপ্ত ছিল না। নারীর মোহময়ী ছলাকলার কাছে পুরুষের পরাজয়, দেবতারও যে ব্যাধি থাকতে পারে এই শাশ্বত বিষয়টি ‘দেহমন’ উপন্যাসের কেন্দ্রে থেকে তাকে সম্পূর্ণ সাদামাটা একটা গল্প হতে দেয় নি। তার বাইরের আপাত সরল অবয়ব আঙ্গিকের ভিতরে ভিতরে একটা সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন কাজ করছে” (দ্রষ্টব্য : মঞ্জুভাষ মিত্র, “নরেন্দ্রনাথ মিত্রের উপন্যাস দেহমন”, ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি’ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৫)। উপন্যাসের শেষে দেখা যায়, মধ্যরাতে রুবির ঘরের মৃদু আলোয় নিবিড় আলাপনরত স্বামীকে দেখে উমা ক্ষিপ্ত হয়। বাড়িওলা সারদাবাবুর সাহায্যে রুবিকে তাড়াতে চায়। বিভাস রুবিকে “ও আমার স্ত্রী” বলে সকলের সমক্ষে স্বীকার করে। কিন্তু প্রথমে বিচলিত হলেও শেষে রুবি মূৰ্চ্ছিতা উমার সেবা করে। বাবলুকে খাইয়ে বিভাসকে প্রত্যাখ্যান করে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ায়। উপন্যাসের এই পরিসমাপ্তি বাস্তবের সীমারেখা মেনেই মূর্ত হয়ে ওঠে।
পরবর্তী ‘দূরভাষিণী’ উপন্যাসটিও শরীর ও জীবন কেন্দ্রিক। গ্রন্থাবলীতে মুদ্রিত লেখকের ডায়েরীর অংশবিশেষ পড়ে জানা যায়, টেলিফোন গার্লদের নিয়ে গল্প লেখার কামনাতেই এই উপন্যাসের উদ্ভব। ১৯৪৮ সালের পকেট ডায়েরী থেকে ১৩/৩ বাঞ্ছারাম অক্রুর লেন খুঁজে বীণাঠাকুরতার বাড়িতে লেখকের উপস্থিত হওয়া থেকে কাহিনীর সূত্রপাত। এই বীণার পরিবার দেশবিভাগের পর থেকে কলকাতায় বসবাসী। সাংবাদিক মৃন্ময় লেখকের সহকর্মী এবং বীণার বন্ধু। সঙ্গতিহীন অসহায় গিরীণবাবু পিতার দায়িত্ববোধে মৃন্ময়ের কাছে বীণার বিয়ের প্রস্তাব তোলায় তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। লেখকের মৃন্ময় বীণাকে নিয়ে গল্প লেখার স্বপ্ন ভেঙে যায়। মৃন্ময় বীণাকে অপমান করে। তেজস্বিনী বীণা তার যক্ষ্মারোগ জীর্ণা বান্ধবী কমলাকে বাঁচাতে অর্থ দিয়ে সেবা করে সাহায্য করে। কমলা তার অন্যমনস্ক আধ-খ্যাপাটে শিল্পী দাদা বিমলকে সাহায্য করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়। সিঁথির সিঁদুর মুছে কুমারীর পরিচয়ে চাকরি পায়। তার স্বামী তাকে ‘Womanly woman’ হিসাবে পেতে চায়। একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বয়ং-নির্ভরতার জন্য মেয়েদের সংগ্রাম অন্যদিকে স্বামীর অহমিকায় দলিত হয়ে কমলা হাসপাতালে মৃত্যুর দিন গোনে। তার মৃত্যুর পর তারই অনুরোধে বীণা অপছন্দ সত্ত্বেও বিমলকে গ্রহণ করে “অনেক বিষের মধ্যে এক ফোঁটা অমৃত” ভেবে সান্ত্বনা পায়। নম্র স্নিগ্ধ মানবিকতায় এই দুঃখময় পরিণতিকে মেনে নেয়। কিন্তু তার পূর্বে পুরুষশাসিত সমাজের অত্যাচারে অবদমিত না হয়ে দৃপ্তকণ্ঠে পুরুষের মুখের উপর বলে যায়— “আপনারা নিজেরাই পুড়ে পুড়ে শুদ্ধ হন।”
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সব চাইতে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘চেনামহল’। এই উপন্যাসের ঘটনাস্থল কলকাতা। একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে, পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন আখ্যানের সমবায়ে উপন্যাসটি গঠিত। লেখকের স্মৃতিচারণায় “চেনামহলের বহু চরিত্রের সঙ্গে কলকাতায় আমার একটি বৃহৎ আত্মীয় পরিবারের অনেকের মিল দেখা যায়। সাদৃশ্য ছিল কিন্তু হুবহু এক ছিল না” (দ্রষ্টব্য : ‘তথ্যপঞ্জী ও গ্রন্থ-পরিচয়”, রচনাবলী ২, পৃষ্ঠা ৬৩৮)। অন্যদিকে ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের কথায় : “কলকাতায় আমাদের আত্মীয়স্বজন কম, মাঝে-মাঝে নিমন্ত্রণ যা একটু পেতাম দাদার শ্বশুরবাড়িতে। ওঁরা বাগবাজারে থাকতেন। নিবেদিতা লেনে দাদার মামাশ্বশুর মেসোশ্বশুরের বাসা ছিল। আমরা সে বাসায়ও যেতাম। দুই পরিবার একসঙ্গে; বাড়িতে অনেক লোকজন। দাদার ‘চেনামহলে’ তাঁদেরই আদল এসেছে” (ঐ পৃষ্ঠা ৬৩৯)। উপন্যাসের এই দুই পরিবার ভুবনময়ীর ছেলে বৈদ্যনাথ এবং মেয়ে বাসন্তীর কাহিনী। ভুবনময়ীর ছত্রছায়ায় কলকাতার সস্তা অঞ্চলে একটা দোতালা বাড়ি ভাড়া নিয়ে এদের বসবাস। ভাড়া পঁয়তাল্লিশ। বৈদ্যনাথের মাইনে ষাট। আর তার ভগ্নিপোত অবনীমোহনের আশি। মুদ্রাস্ফীতির চাপে সেই সময় মধ্যবিত্তের সংসারজীবন অচল প্রায়। যৌথ সংসার চার বছর একত্রে ছিল। তারপর আয় বাড়ল, পুত্র-কন্যার সংখ্যা বাড়ল, সেইসঙ্গে দুই পরিবারে নানা বিষয়ে দেখা দিল সন্দেহ ও কলহ। ছোটখাট বাদ-বিসংবাদকে কেন্দ্র করে কিভাবে দুটি পরিবার মানসিকভাবে পৃথক হয়ে গেল তার বাস্তব ও যুক্তিময় চিত্র নিরাসক্তভাবে বর্ণিত। এই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য কেন্দ্রীয় কাহিনী এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের অনুপস্থিতি। সমগ্র চরিত্র সংখ্যা একচল্লিশ, অন্তত ন-দশটি চরিত্র একেবারে অস্ফুট উনিশ। কুড়িটি চরিত্রের অল্প পরিসরে প্রাসঙ্গিক উপস্থিতি কোন বিশেষ আখ্যানকে সচল রেখেছে মাত্র। স্বভাবতই এই উপন্যাস নায়ক নায়িকাবিহীন, সুগঠিত সম্পূর্ণ আখ্যানহীন। প্রকৃতপক্ষে “চেনামহলের’ কাহিনী একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটা সময়ের কাহিনী। একটি পরিবারের ভাঙন, সমাজ বাস্তবতায় তার অবক্ষয়, তার পঙ্কিল অবস্থা। জীবনের সব মাধুর্য, সব স্বপ্নের অবলুপ্তি, এই সময় পরিবেশে সংঘটিত, অথচ এর মধ্য থেকেই জীবনের অন্য অবস্থান ভিন্ন মূল্যমান নরেন্দ্রনাথের লেখায় প্রকাশিত।
‘অনুরাগিণী’ উপন্যাসটির ১৩০২ সালের ‘জনসেবক’ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ। এই সময় বিবাহবিচ্ছেদ হয় আইনসিদ্ধ ব্যাপার। কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবন তখন সিনেমা-থিয়েটার-জলসা-নৃত্যানুষ্ঠানের তরঙ্গে মুখর। প্রচার বা বিজ্ঞাপনের আলোয় শিল্প ও শিল্পীকে আলোকিত করার প্রবণতা প্রাধান্য পায়। উপন্যাসের কাহিনীতে দেখা যায়, নায়ক প্রদোষ শিল্পী। তার স্ত্রী শিখা নর্তকী। এই নৃত্য তার জীবনের সঙ্গে যুক্ত। অনন্য দেহ সৌন্দর্যের অধিকারিণী এই নারী নৃত্যের প্রয়োজনে তার সংসার, এমন কি সন্তান বিচ্ছুকে পর্যন্ত তুচ্ছ করে। নৃত্যের নিখুঁত ভঙ্গিমা ও কেরিয়ার আয়ত্তের কামনায় শিখা তার গর্ভস্থ সন্তানকে যখন অবাঞ্ছিত ভাবে, তখনই স্বামী প্রদোষের সঙ্গে তার সংঘাতের সূচনা : “তুমি চাও আমি একপাল ছেলে-পুলের মা হয়ে তোমার ঘরে চুপচাপ বসে থাকি। তুমি চাও না আমার ক্যারিয়ার বলে কিছু থাকে। আমি একমাত্র আর্টিস্ট হতে চাই। আর কিছু চাই নে।” প্রদোষও শিল্পী, কিন্তু আজ তার মাত্রা গেছে বদলে, পরিপ্রেক্ষিত বাঁক নিয়েছে ভিন্ন পথে। আজ বৃষ্টি তার চোখে “বিষাক্ত রক্তের ধারা।” অথচ এককালে শিখাকে নিয়ে আঁকা অয়েল পেন্টিঙে নৃত্যশিল্পীর মধ্যে মূর্ত হয়েছেঃ “স্মিতমুখী এক গৃহলক্ষ্মীর প্রতিমূর্তি। তার সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে কাঁকন। মাথায় অল্প একটু আঁচল তোলা। আনত চোখ দুটিতে লজ্জা। মুখে স্নিগ্ধ লাবণ্য।” কিন্তু এখন শিখা অন্যরূপিণী। স্ত্রী স্বাধীনতার উদগ্র যুক্তি এখন তার চোখে মুখে। ঠিক সেই সময় শ্রীমন্ত মজুমদারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সর্বভারতীয় নৃত্যশিল্পী শ্রীধর রাওয়ের সহশিল্পী হয়ে শিখার বাঁচার সুযোগ এল। অন্যদিকে টালিগঞ্জের স্টুডিও চত্বরে একান্ত নির্জনতায় ছবি আঁকতে গিয়ে প্রদোষের হাতে ফুটে উঠল তার প্রথম প্রেমিকা রঙ্গনা বা আংটির মুখ। কিন্তু স্মৃতির আয়নায় সেই মুখ, সেই পূর্ব জীবন ফ্ল্যাশ ব্যাকে দেখা গেলেও প্রদোষ ধরা দিল না। অথচ শ্রীধর রাওয়ের দেওয়া মেক আপের অনুভবে শিখা চঞ্চল, তখনও সে প্রদোষকে মনে করে— “আমি তোমার মেক আপই নিচ্ছি। যে কোন শিল্পীর মধ্যে তুমি আছ। সব শিল্পীর মূলকথা এক। সব শিল্পীর মর্মকথা এক।” উপন্যাসের শেষাংশে আছে শিখা-শ্রীধর অভিনীত কৃষ্ণলীলার কাব্যময় বর্ণনা। আর শেষ মুহূর্তে নাটকীয় দুঃসংবাদ “হেমারেজ শুরু হয়েছে, রক্তবর্ণ হয়ে গেছে সবুজ রঙের শাড়ি।” প্রদোষের শূন্যতা ও বিহ্বলতার ইঙ্গিত দিয়ে কাহিনী সমাপ্ত হয় মর্মস্পর্শী কবিতার মত “শিখার দেহে সাদা চাদর ঢেকে দেওয়া হল। তার মুখ চোখ আর কিছু দেখা যায় না। কিন্তু ঘরের চারদিকের দেওয়ালে তার সর্বাঙ্গ আর সর্বাঙ্গের বিচিত্র ভঙ্গিমা দেখা যাচ্ছে। প্রদোষের নিজের হাতের নানা রঙের তুলিতে সে কেবলই নেচে চলেছে। নেচে চলেছে। সে নৃত্যের শেষ নেই।”
নরেন্দ্রনাথের তৃতীয় পর্বের উপন্যাসগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘সূর্যসাক্ষী’ এবং ‘তৃষ্ণা’। প্রথমটিতে লেখক উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজের রূপকার। এই সমাজের প্রতিভূ শশাঙ্ক মুখ্যত নারী শিকারী। তার চরিত্রটি জটিল, খণ্ডিত, নিঃসঙ্গ। সে স্বকেন্দ্রিক উপলব্ধির দুর্গে বন্দী। আত্মসচেতন হয়েও সে সংঘর্ষে পরাঙমুখ, মহৎ দুঃখ বা সুখলাভে অনিচ্ছুক। বিপরীতভাবে ‘তৃষ্ণা’ উপন্যাসে বিপত্নীক প্রৌঢ় লোকেশ্বরের জীবনে তরুণী দীপিকার আবির্ভাব ও শেষে তাকে পুত্রের প্রণয়িণী জেনে বাসনার অপরিতৃপ্তি, বিষাদক্লান্ত। মিতভাষী, মিষ্টভাষী, সদাচারী, লোকেশ্বর রায় বিকারগ্রস্ত নন। কিন্তু পনেরো বছর ধরে দীপার সঙ্গ ও সাহচর্য তাঁকে সমস্ত জনহিতকর কাজে প্রেরণা দিয়েছে। কারণ লেখকের ভাষায়ঃ “মেয়েই হোক আর পুরুষই হোক তার হৃদয়ের অবলম্বন চাই। নইলে এ পৃথিবী তার কাছে মরুভূমি।” লোকেশ্বরের ছেলে অলোক চাকরি সুত্রে ছিল বাইরে। সে বাড়ি আসে, ধীরে ধীরে দীপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। তারপর একদিন বাবাকে বলে: “যে বয়সে দীপা তোমাকে দেখে ভুলেছিল, প্রায় সেই বয়সে আমিও ওকে দেখে ভুললাম।” ভদ্র, মার্জিতরুচি লোকেশ্বর এই অসহ্য ইঙ্গিত শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরলে ছেলে ক্ষমা চায়। এখানে লোকেশ্বর দীপা এবং দীপা অলোকের সম্পর্কের কোন পরিণতি সিদ্ধান্ত ব্যক্ত নয়। এই উপন্যাসে লোকেশ্বরকে কেন্দ্র করেই খুব সম্ভবতঃ ‘তৃষ্ণা’ নামটি ব্যবহৃত“নইলে শুধু জ্ঞানের তৃষ্ণা নিয়ে পড়ে থাকতেন লোকেশ্বর। পাঠস্পৃহা ছাড়া তার আর কোন স্পৃহা থাকত না।” অথবা “সেই সোনার প্রদীপই তো জ্বালতে চেয়েছিলেন লোকেশ্বর। কিন্তু দেখতে দেখতে কী হল একটি পরম রমণীয় মৃৎপ্রদীপে বাসনার শিখা জ্বলে উঠল।” এই উপন্যাসে লেখকের চরিত্র রচনায় ও উপস্থাপনায় পরিমিতি বোধ দেখা যায়; যেমন দীপার পিতা শ্রীপতিবাবুর মাত্র একবার উপস্থিতি বা লোকেশ্বরের প্রধান বিরুদ্ধবাদী শ্যামলের অন্তরালে থাকা ইত্যাদি। অত্যাবশ্যক চরিত্র যথাসম্ভব বর্জিত, সংহত গঠনে উপন্যাসটি সমাপ্ত।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পসঙ্কলন:
কথাসাহিত্যের দ্বিতীয় ক্ষেত্র ছোটগল্প রচনায়ও নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কৃতিত্ব সুচিহ্নিত। তাঁর রচিত গল্পসংখ্যা প্রায় চার শতাধিক। প্রথম গল্প সংকলন ‘অসমতল’। এখানে সাধারণ এক ‘চোর’, সামান্য ‘এক পো দুধ’, পুরনো একটি ‘পালঙ্ক’, অসুস্থ স্বামীর সেবার্থে ‘সেতার’ শিক্ষা, মাইনর স্কুলের সাধারণ এক ‘হেডমাস্টার’, গ্রামবাংলার পটে এক খেজুর গুড় বিক্রেতার কাহিনী ‘রস’ ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নরেন্দ্রনাথের গল্পের উপজীব্য।
তাঁর ‘পুরাতনী’ গল্পের নায়কের কথা লেখকের মনের কথাকেই যেন প্রকাশ করে “একেকটি মানুষ আমার কাছে একেকটি দুনিয়া। সেই দুনিয়া দেখবার জন্য আমার দূর দেশে যাওয়ার কার হয় না। এমন কি অন্য গ্রাম অন্য নগরেও নয়। আমি তাদের ঘরে বসেই দেখতে পাই। বড়জোর দু’পা বাড়িয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেই হলো। সবচেয়ে দূর আর দুর্গম হলো বন্ধুজনের অন্তরদেশ। আমার দেশান্তরে যাওয়ার দরকার কী।”
ছোটগল্পকার হিসেবে নরেন্দ্রনাথের বিশেষ বৈশিষ্ট্য গল্পের বিষয়বস্তুর সাধারণময়তা। চেনাজানা জগতের অচেনা রহস্য উন্মোচনে তিনি প্রায় অদ্বিতীয়। তার সমকালীন লেখক ও সমালোচক অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “মানুষের সহিত মানুষের সম্পর্ক ঘাত-প্রতিঘাতে বাইরের পরিবেশ হয়তো বদলায় কিন্তু তার চাইতে বেশি বদলায় মানুষের মন—মনের এই রঙ ফেরতার কাহিনীই তিনি বিশেষভাবে ফুটিয়েছেন তার গল্পগুলিতে” (‘পূর্বাশা’ অগ্রহায়ণ, ১৩৫৩)। ‘এই মন বদলানোর পরিচয় আছে ‘রস’ গল্পে মোতালেফের মাজু খাতুনকে তালাক দিয়ে রূপবতী ফুলবানুকে নিকা করার পর গুড় বানাবার কাজে মাজু খাতুনের নৈপুণ্য অনুভবে ও অনুতাপে।
‘লালবানু’ গল্পে সৈনিক স্বামী কাদেরের ভালোবাসার চিঠিগুলি (কোন দ্বিতীয় জনকে দিয়ে লেখানো) পেয়ে লালবানুর মনে গড়ে ওঠা স্বপ্নের জগৎ ধূলিসাৎ হলে ছুটির পর কাদেরের গৃহে প্রত্যাবর্তনে। তার অশিক্ষিত অমার্জিত স্বভাবের পরিচয় পেয়ে লালবানু ভাবে : “কে যেন তাকে এক স্বপ্নময় রহস্যময় পৃথিবী থেকে আবার সেই পুরাতন প্যাকাটির বেড়া দেওয়া জীর্ণ ঘরের মধ্যে এনে ঢুকিয়েছে। কিন্তু সেখানে কি তাকে আর মানায়?”
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের অনেক গল্পে নারীর মধ্যে উন্নত চেতনা চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় লক্ষ্যগোচর যেমন ‘পুরাতনী’ গল্পের নায়িকা চিত্রা বাবার তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের প্রতি সুগভীর আস্থায় গৃহভৃত্য অভয়কে বিয়ে করে তাকে উপযুক্ত সঙ্গী করে তোলার চেষ্টা করে। ‘বিকল্পে’ সুধা বাবার ক্ষোভ ক্রোধ উপেক্ষা করে তার প্রেমিক ইন্দুভূষণের মৃত্যুর পর বৈধব্য অবলম্বন করে ভালোবাসার দৃঢ়তা প্রমাণ করে।
‘অবতরণিকা’য় বলিষ্ঠ মানসিকতার অধিকার গৃহবধূ আরতি সংসারের অভাব অনটনের জন্য চাকরি নেয়। অন্যের জালিয়াতির ফাদে পড়ে স্বামীর ব্যাঙ্কের চাকরি চলে যায়। অথচ এহেন জরুরী সঙ্কটময় মুহূর্তে অফিসে অন্য একটি অ্যাংলো মেয়ের অপমানকে নিজের অপমান ভেবে প্রতিবাদে চাকরি ছেড়ে দেয়। বলা বাহুল্য, এই মানসিকতা লেখকের নারীদের প্রতি আস্থার প্রকাশ।
সংসারের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা-নীচতা বাদে বহু তুচ্ছ বিষয় থেকে গল্পের ভাববস্তু নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে নরেন্দ্রনাথের দক্ষতা বিস্ময় জাগায়; যেমন দেশবিভাগের পটভূমিকায় নিজের জিনিষের প্রতি সংসারী বিষয়ী মানুষের মমতার নিখুঁত নিদর্শন ‘পালঙ্ক’ গল্প। ধলা কর্তার চরিত্রটি এই গল্পের আশ্রয়ে অনবদ্য ভঙ্গিমায় রূপমূর্ত। ‘‘টিকেট’ গল্পে টিকেটকে কেন্দ্র করে মানুষের নীতিহীনতা ও বিবেক যন্ত্রণার পরিচয় প্রকাশিত।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে আঙ্গিক সজ্জা ও ভাষা রীতি:
গল্পের আঙ্গিক আয়তন এবং ভাষারীতি সম্পর্কেও নরেন্দ্রনাথ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। গল্পের আয়তন এখানে কোথাও খুব ছোট, মাঝারি অথবা দীর্ঘায়ত, যেমন মাত্র তিন পাতার গল্প ‘টিকেট’, পাঁচ পাতার গল্প ‘মহেশ্বর’, সাত পাতার মধ্যে আবদ্ধ ‘এক পো দুধ’, নয় পাতায় পরিপূর্ণ ‘রস’। আবার ঊনচল্লিশ পাতা জুড়ে পল্লবিত হয়েও ছোটগল্প ‘মাধব-মঞ্জরী’। প্রায় সর্বক্ষেত্রে লেখকের ‘Unity of impression’ বা প্রতীতী-ঐক্যের দিকে লক্ষ্য সজাগ ছিল। তাঁর গল্প রচনার টেকনিকও বৈশিষ্ট্যময়—
(১) কোথাও আছে আগে পরে ঘটনাবিন্যাস; ন–রস, ‘অবতরণিকা’, ‘সেতার’, ‘পালঙ্ক’ প্রভৃতি।
(২) কোথাও আছে গল্পের মধ্যে গল্প বলার রীতি; যেমন— ‘রত্নাবাঈ, ‘চেক’, ‘পুরাতনী’ প্রভৃতি।
(৩) অতীত জীবনকে কোথাও দেখা গেছে গল্পের আকারে রূপায়িত করার চেষ্টা; যেমন—’আবীর চঁাদ-রূপচঁাদ’, ‘রত্নাবাঈ’ গল্প।
(৪) সংলাপ দিয়ে কোনও গল্পের সূত্রপাত; যেমন—‘যৌথ’, অথবা অনেক সময় রেডিও-র একটি বংশগত বা হেরিডিটি প্রসঙ্গে কোন বক্তৃতা দিয়ে গল্পের সূচনা যেমন ‘জৈব’।
(৫) একটি চিঠিকে গল্পের রূপ চেষ্টা দেখা যায় ‘ধূপকাঠি’ গল্পে। এখানে ‘মান্যবরেষু’ বলে শুরু, আর ‘বিনীতা মাধুরী সেনগুপ্ত’ বলে সমাপ্তি।
ছোটগল্পের ভাষায় ইঙ্গিতধর্মিতা ও বৈচিত্র্যময়তা কাম্য। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে তা অনায়াসলভ্য। নরেন্দ্রনাথের গল্পে আরবী-ফার্সী শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার দেখা যায়; যেমন— ‘রস’ গল্পে নিকা, খুবসুরৎ, বেসবুর, সরম প্রভৃতি। অথবা ‘চঁাদামিঞা’ বা ‘লালবানু’ গল্পে বাদী, কসুর ইত্যাদি।
‘দ্বিচারিণী’ বা ‘পালঙ্ক’ গল্পেও বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়। ব্যঞ্জনার প্রকাশ আছে ‘বিকল্প’ গল্পে ইন্দুভূষণের কথায় – “আমাকে দেহবাদী বলে ভুল করবেন না, আমি দেহাত্মবাদী, দেহ-ও আত্মা নয়, দেহ ও আত্মা।”
কবিত্বের প্রকাশ ‘রস’ গল্পে : “সকালবেলায় রোমশ বুকের মধ্যে ঘামের ফোঁটা চিচিক্ করে, পায়ের নিচে দুর্বার মধ্যে চিচিক্ করে রাত্রে জমা শিশির।” অনুরূপভাবে, এই কবিত্বময় ভাষারীতি উপন্যাসের মধ্যেও স্বপ্রকাশ; যেমন, ‘অনুরাগিণী’-তে শিখার মনে হয় : “প্রদোষের ভিতরের সেই স্বপ্নালু শিল্পী মরে গেছে, সে তুলির মুখে স্বপ্নের রঙ ছড়িয়ে দিতে ভুলে গেছে” কিংবা ‘দূরভাষিণী’তে : “কাচা বাঁশের মত চেহারা বীণার কিন্তু ভঙ্গিটা নমনীয় নয়”।
অথবা ‘সঙ্গিনী’ উপন্যাসে অমিয়র আবেগোক্তি : “তোমার কাছের রাত এই ফুলের কবিতায় ভরে দিলুম। আমার মনের কথা ভরে দিলুম ফুলের মধ্যে। বারবার তোমাকে তা আনমনা করুন।”
মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার, যুদ্ধোত্তর জীবনের সাক্ষী হয়েও হৃদয়বান, বিবেকবান ঔপন্যাসিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র। উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিষয়-চয়নে ও আঙ্গিক-বয়নে তাঁর নৈপুণ্য কালের স্বীকৃতিলাভের পক্ষে উপযুক্ত। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান অনিঃশেষ।
Leave a comment