গোবিন্দ দাস কবিরাজ অভিসার পর্যায়ের পদে রাজাধিরাজ—সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করলে বেরিয়ে আসবে বৈক্ষ্ণব পদাবলীর রূপ ও রসের আবেদন। তিনি ভক্তকবি। কিন্তু তাই বলে তাঁর পদ শুধুমাত্র ভক্ত হৃদয়ের নৈবেদ্যতে পরিণত হয়নি, হয়েছে রসোত্তীর্ণ কাব্যে। ভক্তি-আকুলতাকে রচনারীতির সৌকর্যের সঙ্গে দ্বিধাহীন সম্বন্ধে আবদ্ধ না করলে কাব্যের রসাবেদনের রূপের যে বৃদ্ধি ঘটে না—এ বোধ কবির ছিল। এ বোধ থেকেই জন্ম নিয়েছে রূপ রচনার সচেতন প্রবণতা, অলংকরণের স্বতন্ত্র নিষ্ঠা। এরসঙ্গে মিশেছে রূপ সিদ্ধ কবি-হৃদয়ের কাব্যিক সৌন্দর্যবোধ। ফলে তত্ত্বকথার গণ্ডি ছাড়িয়ে কাব্য শিল্প সৌধের কান নির্মিত কক্ষের চূড়ান্ত চূড়া স্পর্শ করেছে।

অভিসার পদ রচনায় গোবিন্দ দাস দুটি দিকের উল্লেখ করেছেন (১) রসলোকের নির্মাণগত দিক, (২) রূপলোকের নির্মাণগত দিক। এখন এ দুটি দিক সম্বন্ধে পৃথক আলোচনা করা যাক—

(১) রসলোক: অভিসার পর্যায়ের পদগুলির চমৎকারিত্ব সৃষ্টির মর্মমূলে রয়েছে রসসার, কবির স্বীয় প্রতিভাধর্ম, ভাব-গম্ভীর ভক্তিপ্রাণতা, কবি মানসের সহিষ্ণুতা, চিত্ররস -রসিকতা এবং চৈতন্য জীবনের পরোক্ষ অভিজ্ঞতা-রস। অভিসারের মধ্যে আছে অনিবার্য প্রাণাবেগ, সুদুর্জয় আত্মবিশ্বাস, অতন্ত্র সাধন দীপ্তি। কুঞ্জবনে কৃষ্ণ পৌঁছে গেছেন রাধা তাই আর ঘরে স্থির থাকতে পারেন না। পথ হয় তো দুর্গম হবে। তাই রাধা বিচিত্র অভ্যাসে রতা—

“কণ্টকগাড়ি    কমলসম পদতল

মঞ্জির চিরহী ঝাঁপি।”

গাগরি বারি ঢারি    করি পিছল

চলতাই অঙ্গুলি চাপি।”

রাধার অলংকারের প্রতি ও সাপের প্রতি সাধারণ ভীতি। অলংকারের মূল্যে তাই ভীতি নিবারণের চেষ্টা—

“করকঙ্কণ পণ ফণী মুখ বন্ধন।

শিখনু ভুজগ গুরু পাশে।।”

অভিসার যাত্রার সমস্ত পর্ব শেষ। এবার পথে নামা। কিন্তু সমাজের সাথে বিশ্ব প্রকৃতিও বাধা হয়ে দাঁড়ায়—

“মন্দির বাহির কঠিন কপাট।

চলিতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট

তঁহি অতি দূরতর বাদর দোল।

বারি কি বারই নীল নীচোল।”

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের ঘনঘটায় রাধিকার মনপ্রাণ আজ উতলা। একসময় অতিক্রান্ত হয় সমস্যাসঙ্কুল পথ। সমস্ত বাধা বিপত্তি কেটে গিয়ে আসে প্রিয়-মিলনের মধুর-তম ক্ষণ

“আদরে আগুসরি    রাই হৃদয়ে ধরি

জানু উপর পুন রাখি

নিজকর কমলে    চরণ-যুগ মোছই 

হের ইতে চির থির আঁখি।।”

রাধার অভিসারের প্রস্তুতি থেকে মিলন পর্যন্ত একটা ধারাবাহিক রসলোক নির্মিত হয়েছে।

(২) রূপলোক : রসলোক নির্মাণে যেমন গোবিন্দ দাস অনবদ্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তেমনি মানসিক রূপ-লোক নির্মিতিতেও অভিসারের পদে তাঁর কৃতিত্ব হীরক দ্যূতিময়। তাঁর আন্তরিকতার মূলে রয়েছে তাঁর আভিজাত্য ও ঐশ্বর্যবোধ। এটা ভক্তিরই আর একটি দিক। কিন্তু ভক্তির সঙ্গে মিশে আছে রূপ সচেতন, সংযম-বুদ্ধি। গোবিন্দ দাসের পদে রূপলোক দাঁড়িয়ে আছে বিচিত্র শক্ত ভিতের উপর। ভক্তির আবেগ আকুলতা চিত্ররূপে সমাহিত হয়েছে। সংগীত যেমন তাঁর চিত্রের বাহন তেমনি নাট্যরস ও চিত্র সৌন্দর্যের সহায়ক হিসাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এই চিত্রকল্প বস্তূলোকের–চিত্তলোকের নয়।

এছাড়া বিদ্যাপতির বিরহে কাতর রাধার হৃদয়টি যথার্থরূপে প্রস্ফুটিত হয়েছে। চিত্রকলা নির্মাণের নিপুণতায় এই পদে আকুলিত-চিত্ত রাধা-হৃদয়ের চিত্রটি আমাদের চোখের সামনে যেন তুলে ধরে জলরঙা ছবির প্রেক্ষাপটে—

“কুলিশ শত শত    পাত মোদিত

ময়ূর নাচত মাতিয়া।

মত্ত দাদুরী     ডাকে ডাহুকী 

ফাটি যাওত ছাতিয়া।”

বিদ্যাপতির এই পদটির শ্রেষ্ঠত্ব লুকিয়ে আছে পদটির অনন্য ব্যঞ্জনার মধ্যে। কৃষ্ণ বিরহিণী রাধিকা যখন বলে—“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর”—তখন রাধা হৃদয়ের ভেঙে পড়া করুণ বিরহ দশাটি সমগ্র চেতনাজুড়ে বিস্তৃত হয়। দুঃখ ছাড়া অন্যকিছু এখানে আমাদের বোধে জায়গা পায় না।