বৈষ্ণব পদাবলীর ‘গোষ্ঠীলীলা’র পদগুলিতে সখ্যরসের প্রবাহ বয়ে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে গোচারণে কিংবা গৃহ প্রাঙ্গনে যখন খেলাধূলায় মত্ত থাকতেন, তখন তাঁদের আচার আচরণে এবং পারস্পরিক সম্পর্কে যে সৌহার্দ্যের ভাবটি প্রকাশ পেতো সেটিই সখ্যরস। এখানে শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যভাব অনুপস্থিত। বন্ধুরা তাঁকে সমদৃষ্টিতেই দেখতেন। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের প্রথম যৌবনে তাঁর জীবনে যখন শ্রীমতীর আবির্ভাব ঘটল, তখন থেকে সখাদের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেল এবং সখীগণ তৎস্থলবর্তিনী হয়ে দাঁড়ালেন। রাধাকৃষ্ণলীলায় এই সখীদের একটা প্রধান ভূমিকা রয়েছে। বৈষ্ণুব কবিরাও সখীদের মতোই মঞ্জরীভাবের উপাসনায়ই রত ছিলেন। রূপগোস্বামী সখ্যরসকেও ভক্তিরসের মর্যাদা দিয়েছেন এবং তাকে পঞ্চরসের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকৃতি দান করেছেন।

বিশ্বাসময় সমপ্রাণতাই সখ্যরসের মুখ্য ব্যাপার। ভগবানকে সখারূপে কল্পনা করে ভক্তের যে সঙ্গদান তার মধ্য দিয়েই নিষ্পন্ন হয় সখ্যরসে। শান্তের কৃষ্ণ নিষ্ঠা, দাস্যের সেবা’র সঙ্গে এই পর্বে আরও একটি ভাব যুক্ত হল তা সমপ্রাণতা। তবে এক্ষেত্রে ভক্তই শুধু সেবক নয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাঝে মধ্যে ভগবানও সেবক সাজেন। এই রসের স্থায়ী ভাব হল বিশ্রম্ভ নামক রতি। বৈষ্ণব পদাবলীতে এই গোত্রের বহু পদের সন্ধান মেলে। যেমন বিশ্বম্ভরের-

“সব সখা মিলি করিয়া মণ্ডলী ভোজন করয়ে সুখে।

ভাল ভাল কয়ে মুখ হতে লয়ে সভে দেয় কানু মুখে।”

কিংবা বলরাম দাসের—

“কানাই হারিল আজি বিনোদ খেলায়।”

ভাবে ও মননে পদগুলি উৎকর্ষতা প্রমাণ করে। এইভাবের মধ্যে ভগবানের ঐশ্বর্যভাবের একেবারে বিলুপ্তি ঘটে বলে চৈতন্যদেব একে ‘একোতম’ বলে বর্ণনা করেছেন।

শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা বা বাল্যলীলার পদগুলিতে মাতৃহৃদয়ের আবেগ,সস্তানের প্রতি স্নেহধারা স্বতস্ফূর্তভাবে জীবন্তরূপে চিত্রিত হয়েছে। গোপাল তার খেলার সঙ্গী শ্রীদাম, সুদাম ও ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে মিলিতভাবে গোষ্ঠে যেতে চাইলে মাতার উদ্বেগ, আকুলতা, নানা আশঙ্কা অত্যস্ত জীবস্ত তুলিকায় চিত্রিত করেছেন কবি। আমাদের ঘরের কথা যেন সমস্ত দেবত্বের মহিমাকে আচ্ছন্ন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে খেলার সঙ্গীদের সখ্যরসও সমানভাবে উজ্জ্বল হয়ে চিত্রিত হয়েছে।