“বাঙালি ঘরের কথাই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে শাক্তপদাবলিতে।”- তোমাদের পাঠ্যপদ অবলম্বনে মন্তব্যটির যথার্থ প্রতিষ্ঠিত করো।
আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতগুলিতে বাঙালি জীবনের পারিবারিক চেহারাটা কীভাবে ধরা পড়েছে, তা উদ্ধৃতি সহযোগে দেখাও।

মধ্যযুগের বাংলা কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— বৈষ্ণব কাব্য রাধাকে অবলম্বন করে গৃহের বাহিরে গেছে আর শাক্তগান উমাকে অবলম্বন করে গৃহের ভিতরে প্রবেশ করেছে। তাই বৈশ্বব পদাবলি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – “মাটির ওপর দাঁড়াইয়া আকাশের দিকে মুখ করিয়া গান।” আর শাক্তসঙ্গীত গৃহের মঙ্গলগীতি। শাক্তপদকর্তাগণ সংসার-সঙ্গীত রচনা করতে গিয়ে আমাদের বাঙালির গৃহস্থ জীবনের গান রচনা করেছেন হৃদয়ের গাঢ় অনুভূতি দিয়ে। আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতে আমাদের গৃহস্থ জীবনের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। ভক্ত-ভগবানের মিলন-সঞ্জাত যে প্রেম তার অভিব্যক্তি ভক্ত-ভগবানের মান অভিমানের মধুর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে শাক্তপদাবলিতে।

মানবীয় রসসিঞ্ছিত লোকায়ত জীবনকাহিনি বিভিন্ন পদকর্তাগণ রচনা করেছেন অপরূপ রূপে—

“কই মেয়ে বলে আনতে গিয়েছিলে

তোমার পাষাণ প্রাণ আমার পিতাও পাষাণ

জেনে এলাম আপনা হতে গেলে নাকো নিতে

রব না যাব দুদিন গেলে।”

জীবন রঙ্গমঞ্চে মাতা-কন্যার এই অপূর্ব মান-অভিমানের পালাই বাংলার আগমনী সংগীত। পৌরাণিক পটভূমিকাতে শাক্ত পদাবলি রচিত হলেও সাহিত্যিক ঐতিহ্যসূত্রে শাক্ত গীতিকাররা আগমনী বিজয়া গানের বিষয়বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলেন। আগমনী বিজয়ার সমগ্র অংশে উমার পিতৃগৃহে গমন এবং বিদায় বর্ণিত হয়েছে। মেয়েকে পতিগৃহে পাঠিয়ে মায়ের হৃদয়ে যেমন আকুলতা বাঙালি মায়ের মধ্যে দৃশ্য হয় তেমনই লক্ষ্য করা গেছে মেনকার স্বপ্নে দেখা কন্যার রূপে—

“আর শুন অসম্ভব চারিদিকে শিবা রব হে। 

তার মাঝে আমার উমা একাকিনী শ্মশানে৷৷”

হরিশচন্দ্র মিত্রের একটি পদে

“বাছার আমার নাই সে বরণ নাই আভরণ

হেমাঙ্গি হইয়াছে কালির বরণ।”

প্রকৃতপক্ষে আগমনী বিজয়া সঙ্গীতগুলি পুরাণের পটভূমিকায় বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনেরই ছবি। কন্যাকে অযোগ্য পাত্রে সমর্পণ করা ; আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনা। এই নিয়ে মার্তার দুশ্চিন্তা অনুতাপ, জামাতা পরিবারের সাথে বিরোধ, বিবাহিতা কন্যার নিষ্ঠুর মর্মবেদনা, সর্বদাই ঘরে ঘরে উদ্ভূত হয়ে থাকে। গৌরীকে অনেকদিন পিতৃগৃহে আনা হয়নি বলে নারদের মারফত গৌরী অভিযোগ জানিয়েছেন –

“দেব দিগম্বরে সঁপিয়া আমারে মা, বুঝি নিতান্ত পাসরিছে।”

অতএব গিরি যেন অবিলম্বে গৌরীকে আনতে যান।

মেনকার গিরিরাজের প্রতি অনুরোধ শেষে ক্রন্দনে পরিণত হল। ‘আগমনী’ পর্যায়ের কয়েকটি পদে বাঙালি জননীর চিরকালীন বাসনার কথা ব্যক্ত হয়েছে। মেনকা উমাকে আর পতিগৃহে পাঠাতে চান না, তাতে সামাজিক নিন্দা বরণ করে নিতেও প্রস্তুত–

“গিরি এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না

বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।”

অবশেষে উমা মেনকার গৃহে উপনীত হয়। মাতা মেনকা প্রাণের উমাকে দর্শন করে কৃতার্থ হন। উমার মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করে, চুম্বন করে দিগম্বরের হাতে সম্প্রদানের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। সহচারীরা এসে উমার সঙ্গে আনন্দোৎসব করে। শুধু মাতা-কন্যার হৃদয় বেদনাই নয় প্রতিবেশীদের আনন্দও শাক্ত পদাবলির অনেক পদে প্রকাশিত হয়েছে বলে একে বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গীত বললে অত্যুক্তি হয় না।

পিতৃগৃহে আসার পর গিরিরাজের ভূমিকা গৌণ। এখানে কেবল মায়ে-ঝিয়ের বোঝাপড়া তিনদিন –সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী পিতৃগৃহে বাসের পর উমা যখন ফিরে যাবেন কৈলাসে তখন মেনকার মন হয় বেদনায় দীর্ণ। তাই নবমী রাত্রির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেছেন –

“যেয়োনা রজনী আজি লয়ে তারাদলে

গেলে তুমি দয়াময়ী, এ পরাণ যাবে। 

উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে 

নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে।

বাঙালি সমাজে কন্যার পতিগৃহে যাত্রাকালে মাতার যে ব্যাকুল রোদন দেখা যায় মেনকার মধ্যেও তা প্রকাশিত। সমগ্র কাহিনিতে দুটি পরিবারের পতি-প-ীর গৃহস্থালি, দম্পতির রহস্যালাপ, তাঁহাদের মান-অভিমান, সন্তানের জন্য মাতৃহৃদয়ের স্নেহের ব্যাকুলতা, তনয়া মিলনে আনন্দ, বিরহের বেদনা মুখর হইয়া উঠিয়াছে….. প্রতিবাসীর সমালোচনা, কলকোলাহলও বাদ যাই নাই। পারিবারিক জীবনের সূক্ষ্ম ও সুকুমার বৃত্তি, অতি সুকোমল অনুভূতি বিচিত্র রাগিনীতে ঝঙ্কারময় হইয়া উঠিয়াছে।”

অতএব বাঙালির পারিবারিক জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এই শাক্তপদগুলির সৃষ্টি। এই অভিজ্ঞতা থেকেই কবিরা মানব মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপায়ণ ও মনস্তত্ব বিশ্লেষণে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের আচার আচরণ, লোক-লৌকিকতা, পারস্পরিক সম্পর্কের বোঝাপড়া বিশেষত শ্বশুরুগৃহে জামাতার মর্যাদা এবং পিতৃগৃহে কন্যার একক আগমনে তার মানসিক অবস্থা প্রভৃতির পরিচয় আগমনী বিজয়ার পদগুলিতে যেভাবে ফুটে উঠেছে তাতে এই পদাবলিকে লোকজ্ঞানের ভাণ্ডার নামে অভিহিত করলেও অত্যুক্তি হয় না।