ভূমিকা : ‘কাব্যদ্বারা যে অর্থসমূহ প্রকাশিত হয়, তাহাদের সম্মেলনে আত্মস্বরূপ যে আনন্দ সমুদ্ভুত বা সমুদিত হয়, তাহাই স্বাদ অর্থাৎ রস। বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের মতো কবি প্রতিভা কিংবা পঞ্চদশ শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বৈষ্ণুব কবিতায় যে কুল প্লাবিত জোয়ার দেখা দিয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে তাতে ভাঁটা পড়ে। সেইক্ষণে শ্যামাসঙ্গীতের যুগন্ধর কবি রামপ্রসাদের আবির্ভাব। শ্যামাসঙ্গীতের দ্যুতিময় ঐশ্বর্য নিয়ে তিনি ও তাঁর অনুবর্তীরা পাঠকের দরবারে এসে হাজির হলেন। মূলত শাক্ত পদাবলির দুটি ধারা একটি মেনকা ও মেনকা দুহিতা উমার মিলন-বিরহের কথাই প্রধান উপজীব্য দ্বিতীয়টি কালী বা শ্যামাসাধনা– পর্যায়টি বিস্তারিত আলোচিত। তাই রসের বিচারে আগমনী বিজয়ার পদগুলি বাৎসল্যরসের পদ বলা যেতে পারে। আদ্যাশক্তি মহামায়াকে শাক্তকবিগণ কন্যা ও জননীরূপে কল্পনা করে যে বাৎসল্য ও প্রতিবাৎসল্য রসের কাব্য রচনা করেছেন সমগ্র শাক্তপদাবলিতে তাঁকে মূলরস ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে।
শাক্তে বাৎসল্য রসই প্রধান : শাক্ত কবিগণ কোনো প্রতীক হিসাবে বাৎসল্য রসকে স্থাপন করেননি। কেবল আমি আর মা-ই শ্রেষ্ঠ। মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি আসলে কোনো প্রতীক নয়। শাক্ত কবিরাই বলেছেন–
“ওরে ত্রিভুবনে যে মায়ের মূর্তি।
জেনেও কি তাই জান না।।
কোন পানে তার মাটির মূর্তি।
গড়িয়ে করিস উপাসনা।।”
যে সত্য উদ্ঘাটিত তা হল – ‘তার আমার নিরাকার’ শাক্ত পদাবলিতে বাৎসল্যরসই প্রধান। তাই সমালোচক সুধীর কুমার দাসগুপ্ত মহাশয় বলেছেন – “শাক্ত সাহিত্যের প্রথম রস বাৎসল্য রস। উহা ত্রিবিধ বাৎসল্য, মিলন বাৎসল্য ও বিরহ বাৎসল্য। বাৎসল্যরস পরিস্ফুট মা মেনকা ও ছোটো মেয়ে উমার মধ্যে। মিলন বাৎসল্য প্রকাশ পাইয়াছে উমা হরের ঘরনী হইবার পর আগমনী গানে এবং বিরহ বাৎসল্য বিজয়া গানে।”
বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত : শাক্তকবিগণ কন্যারূপের সঙ্গে দেবীরূপের মিশ্রণ ঘটিয়ে দেবীকে ভালোবেসেছেন ও পূজা করেছেন। তাই উমা বলতেই মা মেনকার দু নয়নে অশ্রুবন্যা বয়ে যায়। অতএব শাক্তপদাবলিতে বাৎসল্যভাব কেবল আরাধনার নয় বাস্তবজগতেও ব্যাকুলতা, গভীরতা, নিবিড়তাই অপূর্ব। শাক্ত সাহিত্যে আগমনী পর্যায়ে মেনকার মধ্যে কন্যাকে কাছে পাওয়ার যে হাহাকার তা সত্যিই বাস্তব জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের ফল্গুধারা—
“আছে কন্যা সন্তান যার দেখতে হয় আনতে হয়।”
কন্যার সু কামনাই মূল বিষয় : শাক্তপদাবলিতে মধুর রূপের কোনো অস্তিত্ব নেই। সমগ্রটাই বাৎসল্যরস, লীলাময়ীরূপে উপাসনা করে পৃথিবীর ভক্তি সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন। কন্যা উমার জন্য মাতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রায় প্রতিটি আগমনী গানের বিষয়বস্তু। পতিগৃহে মেয়ে উমার দুঃখে মা শঙ্কিত—
“একে সতীনে জ্বালা না সহে অবলা
যাতনা প্রাণে কত না সহেছে।।”
এরপর তিনদিন পিতৃগৃহে কাটানোর পর বিদায়লগ্নে মা মেনকা বেদনাহত কণ্ঠে বলেন—
“বোঝাব মায়ের ব্যাথা গণেশকে তোর আটকে রেখে
মায়ের প্রাণে বাজে কেমন জানবি তখন আপনি থেকে ।।”
মায়ের বিরহকাতর প্রাণ : নবমী নিশিকে বিলম্বিত করার প্রয়াসে মাতৃহৃদয়ের স্বকরুণ আর্তি পাঠককে সত্যই বেদনাবিহ্বল করে তোলে—
“যেওনা রজনী আজি লয়ে তারা দলে।
গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।”
কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে অনিবার্যভাবে নবমী নিশি অতিক্রান্ত হল। ‘যেতে নাহি দিব তবু যেতে দিতে হয়। তাই বাস্তব সত্যকে মেনে নিয়ে চোখের জল গোপন করে মেনকা বলেছেন –
“এসো মা এসো মা উমা বলো না আর যাই
যাই মায়ের কাছে হৈমবতী ও কথা যে বলতে নাই।”
সর্বস্ব হারানোর যে হাহাকার এই ‘বাৎসল্যরস’-এর মধ্যে বাগ্ময় হয়ে উঠেছে।
অতএব পরিশেষে বলতে হয় শাক্ত পদাবলির আগমনী বিজয়া পর্যায়ে বাৎসল্যরসের স্নিগ্ধছোঁয়া থাকলেও তার পটভূমিকায় আছে নিষ্ঠুর সমাজের বিধি বিধান। যে বিধানে মাকে অষ্টমবর্ষীয়া কন্যার গৌরী দান করাতে হয়, কুলীন বৃদ্ধ স্বামীর হাতে আদরের কন্যাকে সম্প্রদান করতে হয় জাতনাশের ভয়ে। শাক্তপদকর্তাগণ পদরচনাকালে এই অবক্ষয়িত সমাজের নিষ্ঠুর বিধানকে ত্যাগ করতে পারেননি তাই শাক্ত পদাবলির আগমনী বিজয়ার পদগুলি মাতৃহূদয়ের রক্তক্ষরণের সঙ্গীত।
Leave a comment