শাক্তপদাবলিতে রামপ্রসাদের সমশ্রেণিভুক্ত না হলেও রামপ্রসাদের পরেই যাঁর স্থান দেওয়া উচিৎ তিনিই হলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন যুগপৎ কবি ও সাধক। কমলাকান্ত মূলত সঙ্গীতকার। তিনি কবিপ্রতিভার শিখরদেশ আরোহণ করেছেন আগমনী বিজয়ার পদগুলির মধ্য দিয়ে। সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে আগমনী বিজয়াকে বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করে কোনো গীতিকাব্যের ধারা বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল না। রামপ্রসাদই প্রথম এবং প্রায় সমসাময়িক কমলাকান্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাঙালি পারিবারিক উৎসবের এই মধুর পরিবেশটি পৌরাণিক স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে লৌকিক জীবনের আনন্দ-বেদনায় স্থাপন করলেন। অতএব একথা অকপটে স্বীকার করা চলে, কমলাকান্ত শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের অধিকারী তার আগমনী বিজয়া পদগুলির রচনা করে। বস্তুত এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদগুলি কমলাকান্তের রচিত। মাতা, কন্যা ও স্বামীর মনস্তত্ত্ব উদ্‌ঘাটনে তাঁর নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কমলাকান্তের আগমনী গান ভরা-ভদরের নদীর মতো বেগবতী-উচ্ছ্বাস, আর বিজয়া সঙ্গীত বিজয়ার সানাই-এর মতো করুণ ও মর্মস্পর্শী।

কমলাকান্ত ছিলেন রাজসভার কবি। কিন্তু ভারতচন্দ্র কিংবা রামপ্রসাদের মতো তিনি রাজসভার বিলাস, আড়ম্বর, জৌলুসের দ্বারা প্রভাবিত হননি। তাঁর রচনায় অশ্লীলতা এবং গ্রাম্যতাদোষ নেই, বুচির বিকারও নেই। কমলাকান্ত ছিলেন সচেতন শিল্পী। ছন্দের মাধুরী এবং শ্রুতিমধুর শব্দালংকারের প্রতি তাঁর ছিল সজাগ দৃষ্টি-

“শুকনো তরু মুঞ্জরে না, ভয় লাগে মা ভাঙ্গে পাছে। 

তরু পবন বলে সদাই দোলে, প্রাণ কাঁপে মা থাকতে গাছে।।”

তাই তাঁর পক্ষে এ পদরচনা করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া কমলাকাত্তের ‘আমি কি হেরিলাম’ পদটিতে গৌরীর মানবিক এবং ঈশ্বরী রূপের মধুর সমন্বয় ঘটেছে—

“আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপ্নে।

গিরিরাজ! অচেতন কত না ঘুমাও হে।

এই এখুনি শিয়রে ছিল গৌরী আমার কোথা গেল হে।”

কমলাকান্ত রামপ্রসাদের মতোই সমন্বয় সাধক কবি ছিলেন তাঁর প্রকাশ মেলে আরও একটি পদে—

কালী কেবল মেয়ে নয়

মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ

কখন কখন পুরুষ হয়।

ঊমা-মহেশ্বর যে এক ও অভিন্ন এ কথা পিতা গিরিরাজ বুঝলেও মাতৃহৃদয় বুঝল না, তাইতো অনিচ্ছাকৃত চরণে হিমালয় কৈলাসের দিকে অগ্রসর হলেন। দেবাদিদেব শংকরকে দেখার আনন্দটুকুও হিমালয়ের মনে পুলক সঞ্চার করেছে। সংশয়াবৃত পিতৃহৃদয়ের দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবটি দক্ষ শিল্পীর তুলিকায় কমলাকাস্ত ফুটিয়ে তুলেছেন—

“গিরিরাজ গমন করিল হরপুরে।

হরিষে বিষাদ প্রমোদ প্রমাণে ক্ষণে ক্ষণে দ্রুত চলে ধীরে।

ক্ষণে মনে মনে অনুভব হেরিব শংকর শিব।”

পিতার নিকট মাতৃহৃদয়ের ব্যাকুলতার কথা শুনে গৌরীশংকরের কাছে পিতৃগৃহে যাবার জন্য অনুমতি চাইল –

গঙ্গাধর, হে শিব শঙ্কর করো অনুমতি হর

যাইতে জনক ভবনে।

গৌরী কেন পিতৃগৃহে যাবেন করুণস্বরে তিনি জানালেন, স্বপ্নে মাকে দেখেছেন –

“মায়ের ছলছল দুটি আঁখি আমারে কোলেতে রাখি

কত না চুম্বন বদনে।”

জগজ্জননী মা এই যে কন্যারূপে আকুলী বিকুলী খাচ্ছে, তাতে সাধক কবি কমলাকাস্তের সাধনতন্ত্র অপেক্ষা প্রতিবাৎসল্যের রূপ পরিস্ফুট।

সাধক যখন হন মানসপূজারী, আপন উপাস্য দেবতাকে প্রিয় করে ভগবানের সাথে নিভৃতে প্রেমলীলায় মগ্ন তখন জগতের সুখের প্রতি তার আর কোনো আকর্ষণ থাকে না।

“আদর করে হূদে রাখ আদরিণী শ্যামা মাকে। 

তুমি দ্যাখ আমি দেখি আর যেন ভাই কেউ না দেখে।”

সাধক কবির তখন সুখে-দুঃখে সমানুভূতি, আচার ও লৌকিক বন্ধন থেকে তিনি মুক্ত–

“চরণ কালো ভ্রমর কালো, কালোয় কালো মিশে গেল।

দেখ, সুখ-দুঃখ সমান হল আনন্দসাগর উথলে।।”

পরিশেষে একথা বলা চলে – কমলাকান্ত শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ সুনির্বাচিত শব্দের প্রতি অনুরাগ এবং শব্দালংকার ও অর্থালংকারের বিচিত্র কারুকার্যে তিনি পদাবলিকে গীতিকবিতার সৌন্দর্য ও মাধুর্যে পূর্ণ করে তুলেছেন। এখানেই শাক্ত কবি কমলাকান্ত বৈষ্ণুব মহাজন গোবিন্দ দাস কবিরাজের সহধর্মী এবং শাক্তপদাবলিতে ভক্ত হিসাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।