স্বর্গলোকে দেবী পার্বতীর সঙ্গে মহাদেবের কলহ হলে পার্বতীকে পরামর্শ দেন সখী জয়,–মর্ত্যলোকে নিজের পূজা প্রচার করতে। এরপর দেবী মহাদেবের সহায়তায় ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে শাপ দিয়ে কালকেতু ব্যাধরূপে মর্ত্যে প্রেরণ করলেন। দেবীর উদ্দেশ্য, কালকেতুর মাধ্যমেই মর্ত্যে তিনি পূজিত হবেন। অতঃপর কালকেতু নাম নিয়ে ব্যাধের ঘরে জন্ম নিল নীলাম্বর। শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে সে। একদিন বনে গিয়ে কোনও শিকার না পেয়ে একটি স্বর্ণগোধিকাকে ধরে নিয়ে আসে। ওই গোধিকাই ছদ্মবেশিনী দেবী। পরে তিনি নিজরূপ ধারণ করে কালকেতু ও ফুল্লরারকে পরিচয় দিলেন। ফুল্লরা তো কোনমতেই দেবীকে বিশ্বাস করল না। দেবী কালকেতুকে একটি মানিক্যের অঙ্গুরী দিলেন যার দাম সাত কোটি টাকা, এবং তা দিয়ে গুজরাট নগর পত্তন করতে বলেন এবং চণ্ডিকার পূজা করতেও বললেন।

দেবী প্রদত্ত অঙ্গুরী নিয়ে কালকেতু বেনে মুরারি শীলের কাছে গেল। দেবী স্বপ্নে মুরারিকে সব জানিয়ে দিল এবং আদেশ দিল যথাযথ মূল্য কালকেতুকে দিতে। মুরারি দেবীর কথা বিশ্বাস করেনি। তাই কালকেতু যখন খুড়া খুড়া বলে ডাক দিল মুরারি ভেবেছিল কালকেতু আগের মাংসের যে দাম পায় তা নিতে এসেছে বুঝি, তাই সে আত্মগোপন করল এবং বেনেনীকে কালকেতুর সম্মুখে পাঠিয়ে দিল। কালকেতুর ডাক শুনে বেনেনী বলে, বেনে নেই—সকালে বের হয়েছে টাকা আদায় করতে। অতএব কালকেতু যেন পরদিন এসে মাংসের দাম নিয়ে যায় এবং সঙ্গে কিছু কাঠ ও মিষ্টি আনে। একসাথে সব দাম শোধ করবে। সব শুনে প্রত্যুত্তরে কালকেতু বলে সে একটা আংটি ভাঙ্গিয়ে টাকা নিতে এসেছিল। মাংসের দাম নিতে আসেনি কালকেতু অন্যথায় আংটি নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেই পা তোলে অমনি বেনেনী হাসিমুখে আংটিটা দেখতে চায়।

বেনে মুরারি আড়াল থেকে সবশুনে যেই টাকার গন্ধ পেয়েছে অমনি খিড়কি দিয়ে কাঁধে কড়ি থলি, হাতে হুড়পী (বাকস এবং তরাজু/দাঁড়ি পাল্লা) নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। বণিককে দেখে কালকেতু নমস্কার জানল। বেনে মুরারি কালকেতুকে দেখে অনুযোগের সুরে বলে—

বান্যা বলে ভাইপো   এবে নাহি দেখি তোএ 

এ তোমার কেমন ব্যবহার।

কালকেতু বেনে মুরারিকে আংটির কথা জানায় এবং বলে তাকে যেন উচিতমূল্য দেয়। বেনে মুরারি এতই চতুর যে হিসাব নিকাশ করে কালকেতুকে বলে, যে আংটি সে এনেছে সেটা সোনা বা রূপা নয়, পিতল, ঘষেমেজে এটিকে উজ্জ্বল করা হয়েছে। কাজেই এর দাম রতি প্রতি দশ গণ্ডা আর দুই ধানের দাম পাঁচ গণ্ডা, অতএব সবমিলিয়ে দাম হয় আট পন আড়াই বুড়ি (পয়সা)। এর সাথে মাংসের বাকি দেড় বুড়িও যুক্তকরে দাম দেবার কথা বললো। মুরারি আরও বললো—কিছু নগদ এবং কিছু চাউল খুদ দিয়ে শোধ দেবে। এই কথা শোনামাত্র কালকেতুই ভাবে এর দাম তো সাত ঘড়া ধন। তখন অন্যত্র যাওয়ার কল্পনা করে—

“কালকেতু বলে খুড়া মূল্যা নাহি পাই। 

যে জন দিয়াছে ইহা তার ঠাঁহ যাই।।”

আংটি বেহাত হয়ে যাচ্ছে দেখে মুরারি কালকেতুকে আটকানোর জন্য বলে এর দাম আর এক বটও বাড়ান যেতে পারে না। তার সঙ্গে ব্যবসা করলে কালকেতুর ঠকতে হবে না তারও অভয় দেয় সুচতুর মুরারি।

সহজ সরল সাধাসিধে কালকেতু উচিত মূল্য না পেয়ে আংটি নিয়ে নিলে বেনে মুরারি বলে—

“ধর্মকেতু ভায়া সনে কেলু লেনাদেনা। 

তাহা হৈতে ভাইপো হয়্যাছে সেয়ানা।”

সবুদ্ধি সম্পন্ন কালকেতু বলে যে খুড়ার সাথে ঝগড়া করতে সে আসেনি, আংটি নিয়ে সে অন্য বণিকের বাড়ি যাবে। আংটি হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে, মুরারি বলে আংটির দাম আড়াই বুড়ি বাড়িয়ে দেবে এবং চাউল খুদ নিতে হবে না। সবটাই নগদ দেবে। কালকেতুর কিন্তু সংশয় গেল না। আংটি নিজ হাতে রাখার বাসনাও মুরারির ছিল। দৈববাণীতে সে শুনতে পেল আংটির যথোচিত মূল্য কালকেতুকে দিয়ে দিতে। এই দৈববাণী বেনে ছাড়া তারে কেউ শুনতে পেল না। অতঃপর কালকেতুকে সে বলে এতক্ষণ সে তার সাথে ঠাট্টা করছিল। এবার সে থলি থেকে সাত কোটি টাকা লেখা জোখা করে কালকেতুকে দিয়ে আংটিটা নিল। কালকেতু বলদের পিঠে চাপিয়ে ধনগুলো নিয়ে কিছু ব্যয়ের জন্য রেখে বাকি ধন মাটির তলায় পুঁতে রাখল।

অতএব সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুকুন্দরাম বেনে মুরারি ও বেনেপত্নীর যে ছবি অঙ্কন করেছেন তা বেনে স্বভাবেরই অনুগামী। বেনেরা যে পশ্বেতর তার জ্বল জ্যান্ত উদাহরণ—’কালকেতুর অঙ্গুরী বিক্রয় অংশ’। মুরারি হল কবির নিজস্ব সৃষ্টি। মৌলিকতায় কবিকঙ্কন যে শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের দাবিদার তা এই অংশে প্রদর্শিত হয়েছে। যেমন উপস্থিত বুদ্ধি তেমনি ছলাকলায় ভুলিয়ে দেবার মতো ব্যবহার কবি উক্তচরিত্রে দেখিয়ে নিজের অসাধারণ লোক-অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন।