রূপক ও সাংকেতিক মূলত দুটি ভিন্ন মাত্রার নাটক। কারণ, সাংকেতিকের ইংরাজি প্রতিশব্দ হল Symbolism. আর রূপকের Allegory। রূপকে কোনো নীতিগর্ভ কাহিনি থাকে, সেই কাহিনিকে যথেষ্ট সরলতার সঙ্গে বলা হয়। কাহিনির ওপর অংশে একটা অর্থ থাকে, কিন্তু সেই কাহিনির ভেতরে অর্থাৎ মর্মাংশে আর একটি অর্থ সমাস্তরাল রেখায় বিধৃত থাকে। রূপকে তাই ওপরের অর্থটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আভ্যন্তরিক অর্থ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়। এরমধ্যে একটি নীতি প্রচারের বিষয়ও থাকে।

কিন্তু সাংকেতিক রচনায় কোনো নীতি প্রচারের বালাই থাকে না, যে সত্য অশরীরী এবং ইন্দ্রিয়াতীত, যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, যা শুধু ব্যঞ্জনায় আভাসিত, অপার্থিব কিন্তু অনুভবগম্য, সে সত্যকে বোঝাবার চেষ্টা করে থাকেন সাংকেতিক শিল্পী। যাকে রূপে ধরা যাচ্ছে না সেই অরূপকে শিল্পী মূর্ত করার চেষ্টা করেন সংকেতের সাহায্যে। এখানে বাচ্যার্থ প্রধান নয়, ব্যাঙ্গ্যার্থই প্রধান। স্রষ্টার মনে যে ভাবজগতের উদয় হয়—পরিচিত রূপের মাধ্যমে অনেক সময় তার বর্ণনা করা চলে না, অথচ মনের তীব্র আকুলতাকে কখনও অস্বীকার করা যায় না—তাকে প্রকাশ করতেই হয়। সংকেতের সাহায্যেই তা ব্যক্ত হয়।

রূপক ও সাংকেতিক নাটকের পার্থক্য

১। রূপকের কাজ বক্তব্য বিষয়কে গোপন করে তার একটা প্রতিরূপ খাড়া করা। অর্থাৎ রূপকে কাহিনিতে দুটি ঘটনা সমান্তরালভাবে চলতে থাকে একটি আপাত কাহিনি, যার অন্তরালে লেখক আত্মগোপন করে দ্বিতীয় কাহিনিটি বলতে চান। বুদ্ধিমান পাঠক এই দ্বিতীয় কাহিনিকে সহজেই আবিষ্কার করেন। সংকেতে অবশ্য আপাত কাহিনিটির অন্তরালে অন্য কোনো কথা থাকে, কিন্তু কোনো সমাস্তরাল কাহিনি থাকে না। থাকে একটা অনুভূতি বা অব্যক্ত সংকেত, যাকে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব।

২। রূপক-কাহিনি স্পষ্ট বোঝা যায়, যেমন বোঝা যায় তার ওপরের কাহিনি তেমনি ভিতরের কাহিনিও। কিন্তু সাংকেতিক নাটকে এই স্পষ্টতা মোটেই থাকে না, তার নেপথ্যে যে অনুভূতি লেখক সঞ্চারিত করতে চান তা বোঝা বেশ শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।

৩। রূপকের আবেদন সম্পূর্ণত বুদ্ধির কাছে, কিন্তু সংকেতের আবেদন বোধের কাছে। এই কারণেই বুদ্ধিমান পাঠক রূপকের দ্বিতীয় কাহিনির অর্থ খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারেন, কিন্তু যথার্থ অনুভূতিশীল মানুষ ছাড়া সংকেতের রহস্য উদ্ধার করা অথবা লেখকের ব্যঞ্জনার কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব নয়।

৪। সমালোচকের পক্ষে রূপক নাটকের অর্থ বিশ্লেষণ করা বা তার ব্যাখ্যা করা মোটামুটি সহজ, কারণ বুদ্ধিপ্রধান নাটক মূলত সমালোচকের আয়ত্তাধীন।

কিন্তু সাংকেতিক নাটক অনুভূতিগ্রাহ্য হওয়ার জন্য সমালোচক নিজেই তার রহস্যে বিভ্রান্ত। ফলে রূপকের ব্যাখ্যা আমাদের তৃপ্ত করে, সাংকেতিক নাটকের ব্যাখ্যা আমাদের সেভাবে সম্ভোষ দান করতে পারে না।

৫। রূপক নাটক উদ্দেশ্যমূলক, তাই রূপকাৰ্থ স্পষ্ট হয়ে গেলেই দর্শক তৃপ্তিলাভ করে। কিন্তু সংকেতের ক্ষেত্রে তা হয় না। যে দর্শক গভীর অনুভূতির সাহয্যে নাটকের মূল ব্যঞ্জনার কাছাকাছি উপনীত হতে পারেন তিনি নাট্যকারের গভীর অনুভূতির সিংহদ্বারে পৌঁছে যান।

মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শ্রেণির নাটক রচনায় রাজাধিরাজ। তাঁর প্রায় অধিকাংশ নাটক এই অভিধায় ভূষিত।

একটি বাংলা সাংকেতিক নাটক :

রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ এই ধারার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এখানে রাজা হচ্ছেন ভগবান, আর সুদর্শনা মানবাত্মার প্রতীক। মানুষের প্রেমেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব, রানি সুদর্শনার ভালোবাসার মধ্যেই রাজার প্রেমিক সত্তার সার্থকতা, কিন্তু রানি সুদর্শনা এখানে প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। দীক্ষা লাভ ঘটেনি, তাই রাজাকে সে সম্পূর্ণরূপে বুঝে উঠতে পারেনি।

রানি থাকে অন্ধকার ঘরে। অন্ধকার ঘর হল মানুষের মনের গোপন স্থান, অধিচেতন স্তরও বলা যায় এখানে মানুষের চিন্তা ও চৈতন্য স্থৈর্য লাভ করে, ধ্যানের মাধ্যমে ভগবদ অনুভব ঘটে। আধ্যাত্মিক সাধনা কখনও প্রকাশ লোকের রূপের সাধনা হতে পারে না।

সুবর্ণ হচ্ছে সুন্দর দেখতে এক ধনী রাজা, তাই সুবর্ণ তার নাম। অধ্যাত্ম সাধনার দীক্ষা যার হয়নি, সেতো সৌন্দর্য ভোগের দিকেই মত্ত হবে, সুবর্ণকেই রাজা বলে ভুল করবে। রূপতৃষ্ণায় প্রমত্ত মানবাত্মা ঈশ্বরকে ভুলে থাকে, রানি ভোগবাসনার প্রাবল্যে রাজার প্রাসাদ ছেড়ে চলে যায়।

এই নাটকের অনেক সংলাপেই সাংকেতিকতার ব্যঞ্জনা আছে। যেমন—দ্বিতীয় দৃশ্যে একজন বিদেশি পথিক প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করছে—কোন্ পথ দিয়ে গেলে উৎসবের জায়গায় যাওয়া যাবে। প্রহরী জানায়— “এখানে সব রাস্তাই রাস্তা। যেদিক দিয়ে যাবে ঠিক পৌঁছবে। অর্থাৎ যে-কোনো মতের পথ ধরেই ঈশ্বরলোকে পৌঁছানো যায়, তাঁর আনন্দময় সান্নিধ্য লাভ ঘটে।

এ নাটকে যে শুধু ভগবানের স্বরূপ প্রতিষ্ঠার কথাই আছে, তা নয়; বিশ্বসংসার চলেছে কীভাবে—প্রতীক দ্যোতনার মাধ্যমে সেকথাও বলা হয়েছে। এই বিশ্বসংসার একটি রাজ্য, এখানকার বিশ্বরাজা অদৃশ্য, রূপের মাধ্যমে তাঁকে দেখা যায় না, চেনা যায় না। যার অন্তর্দৃষ্টি আছে—সেই কেবল তাঁকে দেখতে পায়। সুরঙ্গমা হচ্ছে মানুষের মনের ভক্তি। সুরঙ্গমা মনের ভক্তি দিয়েই ভগবানকে খুঁজেছে। আর ঠাকুর্দা হল জ্ঞানের প্রতীক। তিনি জ্ঞানের মাধ্যমেই ঈশ্বরের স্বরূপ বুঝতে পেরেছেন। কাঞ্জীরাজ হল মূর্ত নাস্তিক, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার প্রতি তার বিশ্বাস নেই। ঈশ্বরকে চোখে দেখা যায় না, সুতরাং তিনি নেই।

অদৃশ্য রাজার পতাকায় আছে পদ্মফুলের মাঝখানে বজ্র আঁকা। পদ্ম সৌন্দর্যের প্রতীক, বজ্র ভয়ংকর। অর্থাৎ ঈশ্বর যেমন কোমল, তেমনই কঠোর; তিনি যেমন সুন্দর, তেমনই ভয়ংকর। এখানে যে যুদ্ধ আছে—তা প্রতীক বুধ, জড়শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক শক্তির, নাস্তিকতার সঙ্গে আস্তিক্য বুদ্ধির যুদ্ধ।

‘রাজা’ নাটকের প্রতীকতায় মনে হয় বৈশ্বব ভাব কিছুটা ধরা পড়েছে। রাজা সেই পরমপুরুষ শ্যামসুন্দর, সুদর্শনা পত্নী ভাবে, ঠাকুর্দা সখা হিসেবে, সুরঙ্গমা দাসী হয়ে, কাঞ্চীরাজ শত্রু হয়ে রাজাকে ভজনা করেছে, তবে শত্রু ভাবে ভজনার কথা বৈশ্বব তত্ত্বে প্রাধান্য পায়নি। মধুর ভাবের সাধনাই বৈষ্ণুবী ভক্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।

একটি বাংলা রূপক নাটক :

রবীন্দ্রনাথের ‘কালের যাত্রা’ একটি উল্লেখযোগ্য রূপক নাটক। মহাকালের রথ চলছে না, এতদিন এই রথ ব্রাক্ষ্মণ। ক্ষত্রিয়, বৈশ্যদের নিয়ন্ত্রণে চলেছে, বর্তমানে এই রথের যাত্রা বন্ধ হয়েছে। অচলগতি রথকে চালালো এসে শোষিত শূদ্রেরা, সমাজের নিচুতলার মানুষেরা। এ নাটকের কাহিনি এইটুকুই মাত্র। এখন দেখা যাক এটি কীভাবে রূপকের আদর্শে উদ্বোধিত হয়েছে।

রথ হচ্ছে মানব সমাজের প্রতীক, এই সমাজ বহুদিন ধরে চলে আসছে। আদি যুগে পুরোহিতেরা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, পরে সেই সমাজ শাসিত হয়েছে ক্ষাত্র শক্তির দ্বারা। সৈন্যদের বাহুবলেই রাজ্যের শাসন চলে। ক্ষাত্র শক্তির পরিবর্তে পরে বৈশ্য শক্তির-আবির্ভাব ঘটেছে, নাটকে সেই সম্প্রদায়ের প্রতিভূ হিসেবে শেঠজি চরিত্রটি পাওয়া যায়। শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরাই রাষ্ট্র শক্তির নিয়স্তা। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শক্তিরও দিন শেষ হয়ে এসেছে। সমাজরথ শ্রমিকদের হাতের টানেই চলবে। শ্রমিকেরাই সমাজের অন্ন-বস্ত্রের জোগান দেয়, সমাজকে কাঁধের ওপর তুলে ধরে আছে। শূদ্রের টানে রথ চলল। কিন্তু এখানেই নাটকের শেষ নয়। নাট্যকারের একটি সমাধান বাণী আছে। শূদ্র শক্তি যদি মনে করে যে তারাই কর্তা, অন্য আর কেউ নেই, তখন—‘আসবে উলটো রথের পালা তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া। তখন মানব সমাজে ফের প্রীতির সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হবে। সমস্ত জাতি ও শ্রেণির মধ্যে প্রীতির ছন্দই প্রাধান্য পাবে—সে কাজের দায়িত্ব বর্তাবে তখন কবির ওপর।

মানব সমাজ হল রথ ; আর রথের রশি হল মানুষে মানুষে মানুষের সমাজে-সমাজে যে স্বাভাবিক ও সামগ্রিক সম্বন্ধ—তাই। মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে বাঁধন—তাকেই রথের রশি বলা হয়েছে। এই রশি যদি শিথিল হয়, গ্রন্থি যুক্ত হয়—তবে তা টানলেও রথ আর চলে না। অর্থাৎ মানুষে মানুষে প্রীতির সামঞ্জস্যে যদি টান পড়ে, তবে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে না।

রথের দেবতা বলতে মহাকাল বা ইতিহাস-বিধাতাকে বোঝানো হয়েছে। শেঠজি ধনপতি ও শিল্পপতির প্রতিভূ। বর্তমানে ব্যবসায়ীরাই সমাজের নিয়ন্তা। বৈশ্য বলতে তাদেরই বোঝানো হয়েছে।

নিচুতলার অবহেলিত, শোষিত, পীড়িত মানুষেরই জয় হল শেষে অর্থাৎ শূদ্রের হাতের টানেই রথ চলল। অহং বোধ, ক্ষমতার লোভ, অর্থলোলুপতা, পুরোহিত তন্ত্র, রাজতন্ত্র ও ধনিকতন্ত্রকে সরিয়েছে এই বোধে সমাজ শাসন করা যায় না, রথ চালনা সম্ভব হয় না, মানবিক কল্যাণ সাধিত হয় না।

শূদ্র সেবা করে, শ্রম করে। একদল পিছিয়ে পড়লে মিছিলের গতি ক্ষুণ্ণ হয়, শক্তির হানি ঘটে, একশ্রেণির মানুষ নীচে থাকলে সমাজের প্রগতি ব্যাহত হয়। তবে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যের মতো শূদ্র যেন শক্তি-দন্তে ধরাকে সরাজ্ঞান না করে, করলে তখন আসবে উলটো রথের পালা, রথী কেউ নেই, রথের সর্বময় কর্তা ওরাই—এই কথা যদি শূদ্রেরা ভাবে, ‘তখন আবার নতুন যুগে উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া’। জীবনের ছন্দকে যখন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করবে—সেইদিনই যথার্থ মুক্তি ঘটবে।