যে নাটকের আখ্যান নির্মিত হয় পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে, তাকেই মূলত পৌরাণিক নাটকরূপে চিহ্নিত করা হয়। এই পৌরাণিক নাটক দিয়েই বাংলা নাটকের জয়যাত্রা শুরু। এই ধরনের নাটকেই আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য যাত্রাপালার সঙ্গে পার্থক্যও বিদ্যমান। পুরাণ মানেই ভক্তিমূলক বিষয়, বাঙালি এসব কিছু পেলে আবেগে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। গিরিশচন্দ্র সঠিক কথা বলেছেন, “হিন্দুস্থানের মর্মে মর্মে ধর্ম, মর্মাশ্রয় করিয়া নাটক শিখিতে হইলে ধর্মাশ্রম করিতে হইবে।” ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রথম বাংলা পূর্ণাঙ্গ মৌলিক নাটক তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুনকে’ পৌরাণিক নাটকরূপে আখ্যাত কর হয়। তবে কেউ কেউ যোগেশচন্দ্র গুপ্তের ‘কীর্তি বিলাসকে’ পৌরাণিক নাটক রূপে নির্দেশিত করেছেন যদিও তাকে পুরাণ কথা বলা হবে না রূপকথা বলা হবে, এই নিয়ে সংশয় রয়েছে, এর অব্যবহিত পরেই মধুসূদন দত্তের—’শর্মিষ্ঠা’, মনমোহন বসুর—‘রামাভিষেক’, রাম নারায়ণ তর্করত্নের—‘রুক্মিণীহরণ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য পৌরণিক নাটক। তবে বাংলা পৌরাণিক নাটকের শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসাবে গিরিশচন্দ্র ঘোষকে চিহ্নিত করাই শ্রেয়।
পুরাণ বলতে সাধারণভাবে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতকে বোঝালেও পৌরাণিক অভিধানের মতে পুরাণ,—“অতি প্রাচীনকালের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ও সমাজধর্ম ইত্যাদি অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা। পুরাণ দুইভাগে বিভক্ত—মহাপুরাণ ও উপ-পুরাণ। মহাপুরাণের সংখ্যা ১৮, যথা—ব্রহ্ম, পদ্ম, বিষ্ণু, শিব, ভাগবত, নারদ, মার্কন্ডেয়, অগ্নি, ভবিষ্য, ব্রহ্মার্বৈত, লিঙ্গ, বরাহ, সকন্দ, বামন, কূর্ম, মৎস্য, গরুড় ও ব্রহ্মাণ্ড।” নাটকের বিষয়বস্তু হিসাবে অবশ্য বিভিন্ন লৌকিক পুরাণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পুরাণ বলতে ব্যাপক বিষয়কে বোঝায়, এরমধ্যে একটাই সাদৃশ্য তা হল—ভক্তি প্রগাঢ় কাহিনি। পৌরাণিক নাটকের প্রথম লক্ষণ সেটাই—’ভক্তি বসগাঢ়তা। সংস্কৃত আলংকারিকরা যে নবরসের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে ভক্তির স্থান না থাকলেও বৈবতাত্ত্বিকগণ রতিভাবকে কৃষ্ণরতিতে রূপান্তরিত করে তার সিদ্ধিকে বলেছেন প্রেমরস বা ভক্তিরস। সেই ভাবেই ভক্তিরসকে বুঝে নেওয়া উচিত।
প্রচলিত ছক্ হিসাবে পৌরাণিক নাটকে কয়েকটি সাধারণ বিধর্ম লক্ষিত হয়—অদৃষ্টবাদ, অলৌকিকতা, নীতির প্রতিষ্ঠা, অবতারত্ব, ভক্তি ও বিশ্বাসের জয়। ভগবত উচ্ছ্বাস থাকা সত্ত্বেও আলংকারিকদের শান্তরসের প্রভাব, মৃত্যু ও বিচ্ছেদ দ্বারা সমাপ্তি না ঘটিয়ে পরলোকে মিলন ও প্রশান্তি দেখানো প্রভৃতি। আসলে সাধারণ মানুষের মনে অনেকরকম সংস্কারের মতো দৈবী সংস্কারও থাকে। দেবদেবী চরিত্রের মতোই পৌরাণিক নাটকে ভূত, প্রেত, ডাকিনী, যোগিনী যমদূত-দেবদূত ইত্যাদিরাও আবিভূর্ত হন। আধুনিক সাহিত্য যুক্তি লালিত, অথচ পৌরাণিক নাটকে যুক্তির প্রতিপাদ্য বিষয় ভক্তি। যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, ভক্তি তাকে অনায়াসে গ্রহণ করতে পারে। ভক্তি যেহেতু পৌরাণিক নাটকে প্রাণরস সঞ্চার করে, তাই তাকে আধুনিক সাহিত্যের পর্যায়ে ফেলা যায় না। সমালোচক বলেন—পৌরাণিক নাটক কথাটির মধ্যে এমন স্ববিরোধ আছে যে একে প্রায় অসম্ভব বলাই ভালো। নৈয়ায়িক শৃঙ্খলা ও বিশ্বাস যোগ্যতা নাটকের বৈশিষ্ট্য। নির্বিচার গ্রহণ বা ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ গোছের মানসিকতা কিন্তু পুরাণের আসলকথা।
যে দ্বন্দ্বময়তা নাটকের প্রাণ, পৌরাণিক নাটকে তা পরিস্ফুট করার অসুবিধা আছে দেবতার আধিপত্যে মধ্যযুগীয় সাহিত্যে মানুষের প্রতিরোধী সত্তা ফুটে উঠবার বিশেষ অবকাশ ছিল না। এখানে দেবতার মহিমা এবং অলৌকিক লীলা বেশি প্রকাশ পাওয়ায় দ্বন্দ্বময়তা প্রদর্শনের সুযোগ থাকে অল্প। এ সকল সমস্যা মেনে নিয়েও বলতে হয়, পৌরাণিক নাটক রচনায় যাঁরা সামর্থ্য দেখিয়েছেন তাঁরা ভক্তি ও যুক্তির মধ্যে একটা সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা করেছেন। যে দ্বন্দ্ব নাটকের প্রাণ সেই দ্বন্দ্বও পৌরাণিক নাটকে পরবর্তীকালে উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে— কখনও দেবতার সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম, কখনও আস্তিকতার সঙ্গে নাস্তিকতার, কখনও বা বিভিন্ন স্তরের ধর্মের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ দেখা দিয়েছে। এইভাবে পৌরাণিক নাটকের মধ্যে দ্বন্দ্বময়তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
একটি বাংলা পৌরাণিক নাটক :
গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটকটিকে সার্থক পৌরাণিক নাটকের দৃষ্টান্ত স্বরূপ নেওয়া যেতে পারে। এ নাটকের কাহিনি বস্তু হল— একটি সাধারণ মানুষের বেশ্যাসক্ত থেকে ভগবৎ প্রেমে উত্তরণ হওয়ার কাহিনি। অবশ্য মানুষটিকে সাধারণ মনে হলেও বিল্বমঙ্গল যে চিন্তামণি নামক এক গণিকার কাছে দেহের প্রলোভনেই যেত না, তার মনে যে প্রকৃত প্রেম প্রচ্ছন্ন ছিল তা চিন্তামণির কথা থেকেই জানা যায়—“কাছ থেকে নড়তে দেবে না, সমস্ত রাত ভ্যান ভ্যান মাথামুণ্ড নেই—খালি ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।” প্রেমের এই প্রমত্ত আবেগ মনে লালন না করলে পিতৃশ্রাদ্ধের দিন সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে চিন্তামণির কাছে আসার মতো অসাধ্যসাধন সে করতে পারতো না। এরপর যখন চিন্তার কাছে সে শুনেছেঃ “এই মন, আমি বেশ্যা, যদি আমায় না দিয়ে হরিপাদ পদ্মে দিতে তোমার কাজ হতো।” তখনই বিল্বমঙ্গলের মনে কথাটি একেবারে আমূল প্রবেশ করেছে, প্রেমের সার্থকতা খুঁজতে চেয়েছে সে তার পরমার্থ ঈশ্বর প্রেমের মধ্যে, বলেছে—
“কোথায় সে প্রেমের পাথার-
মন প্রেমের প্রবাহে মিশে যাহে হবে লয়।”
এর পরেই তার কঠোর কঠিন, যন্ত্রণা বিক্ষত ভগবৎ আরাধনা শেষ পর্যন্ত সার্থক হয়ে উঠেছে।
যে-কোনো শ্রেণির নাটক বিচারেই প্রধান বিচার্য হওয়া উচিত—তা নাটক হয়েছে কিনা এবং তার ওপর নির্ভর করে বলা যায় বিল্বমঙ্গল উচ্চস্তরের নাটক। কারণ এখানে একেবারে আধুনিক দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষিত হয়–ব্যক্তির নিজের সঙ্গেই নিজের বিরোধ, তার প্রেমিক সত্তার সঙ্গে অধ্যাত্ম সত্তার বিরোধ এবং তার বিচিত্র এক সমীকরণ। সেখানে উপনীত হলে বিল্বমঙ্গল চিন্তামণিকে বলতে পারে তার ‘প্রেমশিক্ষাদাতা। তবে পৌরাণিক নাটকে অনেক অবাস্তব ও অপার্থিব লীলা দেখাতে হয়, যাতে ভক্তি-প্রাণ দর্শক তা উপভোগ করতে পারেন। দর্শক সম্বন্ধে অতি অভিজ্ঞ গিরিশচন্দ্র তা স্মরণ রেখেছেন এবং শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক মহিমা এই নাটকে অনেক প্রদর্শন করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকে রাখাল বেশে দেখিয়ে তাঁর পরিতৃপ্তি হয়নি, শেষ দৃশ্যে দোলমঞে তিনি রাধাকৃষ্ণের যুগললীলা দেখিয়েছেন। তবে এই অলৌকিক বা অপ্রাকৃত লীলাকে কুশলী নাট্যকারের মতো তিনি জনরুচির স্বার্থে গ্রহণ করেন কিন্তু শিল্পের স্বার্থে তাকে রেখেছেন বহিরঙ্গ উপকরণরূপে। এ নাটকেও অলৌকিক লীলা কয়েকবার প্রদর্শিত হয়েছে—তার মধ্যে প্রধান—অন্ধ বিল্বমঙ্গলের পুনর্বার দৃষ্টি ফিরে পাওয়া। কিন্তু একে যদি রূপক হিসাবে প্রতিপন্ন করা যায়—ছদ্মবেশী শ্রীকৃষ্ণ জীবনে আবির্ভূত হবার পর তার চোখে এলো নতুনদৃষ্টি বা নতুন করে দেখবার ক্ষমতা—তাহলে বোধ হয় এইরকম জোরালো অলৌকিক ঘটনাকেও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হতে পারে।
নাট্যকার আরও একটি কৌশল এ নাটকে প্রণয়ন করেছেন, তা মূলত সচেতন দর্শককে বোঝাবার জন্য বা মানবিক নাটকের মধ্যে অলৌকিক পরিবেশ তৈরি করবার জন্য। তাহল নাটকে তিনি সাধারণভাবে ব্যবহার করেছেন গদ্য সংলাপ এবং সে গদ্য একেবারেই মুখচলতি ভাষার। অথচ যে মুহূর্তে নাটকে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির প্রয়োজন ঘটেছে অথবা অলৌকিকের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, নাট্যকার প্রয়োগ করেছেন তাঁর বিশিষ্ট ‘গৈরিশছন্দ’ অত্যন্ত সাধারণ ভাষার সংলাপই নাট্যকার ব্যবহার করেছেন বিল্বমঙ্গলের মুখে। অথচ যে মুহূর্তে তাকে আন্দোলিত করার মতো কথা সে শোনে চিন্তার মুখে, সেই মুহূর্তে তার মুখের সংলাপের পরিবর্তন ঘটে—
“এই পরিণাম,
এই নরদেহ –
জলে ভেসে যায়,
ছিঁড়ে খায় কুক্কুরে শৃগালে,
কিংবা চিতা ভস্ম পবন উড়ায়
তবে হায়! প্রাণ দিছি কারে ?
কাজেই অলৌকিক লীলাকে বহুল পরিমাণে ব্যবহার করা সত্ত্বেও তাকে নাটকের বহিরঙ্গ উপাদানে পরিণত করে, দর্শকের রুচিকে মান্য করেও শিল্পীর দাবি অক্ষুণ্ণ রেখে এবং মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রখরতায় একে আধুনিক দর্শকের উপভোগ্য করে গিরিশচন্দ্র যে এই নাটকে সার্থক পৌরাণিক নাটকের সংবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছেন তা পাঠককে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করে।
Leave a comment