উপাদান যেখান থেকেই আসুক না কেন যখন ঔপন্যাসিক লেখেন তখন তিনি ইতিহাস লেখেন না, উপন্যাসই লেখেন। আর আধুনিক শিল্প হিসাবে উপন্যাসে মানব অনুভূতির প্রকাশ থাকতেই হবে। ঔপন্যাসিকের লক্ষ্যই মানুষ ও তার জীবনের পূর্ণায়ত রূপ চিত্রণ। আর একথা না রাখলে ইতিহাসের পটভূমি থাকলেই যে কোন উপন্যাসকে ঐতিহাসিক উপন্যাস আখ্যা দেওয়া যাবে না। কারণ ইতিহাসকে মানব জীবন রসে ভরিয়ে তুলতে গেলে ঔপন্যাসিককে কল্পনার আশ্রয় নিতে হবেই। কিন্তু এই কাল্পনিকতা কতদূর বিস্তৃত হবে সেখানেই দেখা দেবে সমস্যা।
খুব একটা স্থূল অর্থে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে আমরা বুঝি এমন উপন্যাস যেখানে ইতিহাসের প্রসঙ্গে আছে। আর একটু গভীরে গেলে ভাবতে পারি উপন্যাসের মূল সমস্যা ইতিহাস থেকে গৃহীত কিনা, ঐতিহাসিক ঘটনা অবিকৃত আছে কিনা ইত্যাদি। সেদিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী কিংবা রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লুৎফাউন্নিসা’ ডিকেন্সের ‘এ টেল অফ টু সিরিজ’ ঐতিহাসিক উপন্যাসে। সমালোচকেরা ঐতিহাসিক উপন্যাসের আবার শ্রেণীবিভাগ করেন বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস এবং মিশ্র বা ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাসের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,— ‘ঐতিহাসিক রস’- সেই রসস্ফূর্তির দিকে যখন ঔপন্যাসিক সম্পূর্ণ সচেতন থাকে, তখন তাকে বলে বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস। এই ধরনের উপন্যাসের উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’ রমেশচন্দ্র দত্তে ‘‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’ প্রভৃতি। আর ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস বলতে সেই রচনাগুলিকে বোঝায় যেখানে ঔপন্যাসিক ইতিহাসকে গ্রহণ করছেন কিন্তু তাকে রসফূর্তি দেননি, হয় পটভূমি নয়তো ভিন্নতর কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন; যেখানে ইতিহাসের সভ্যতা অপেক্ষা অনেক বেশি রোমান্সকে প্রধান্য দিয়েছেন। বাংলা উপন্যাসকে এমন একটি ভিতের উপরই দাঁড় করিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এই জাতীয় ঐতিহাসিক উপন্যাসের দৃষ্টান্ত তাই ‘কপালকুন্ডলা’, ‘যুগালাঙ্গুরীয়’, ‘মৃণালিনী’, ‘চন্দ্রশেখর’, রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ ইত্যাদি।
ঐতিহাসিক সত্যকে অবিকৃত রেখে ঐতিহাসিক রস ও মানবরসে পূর্ণ সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই এই উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন -এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।” রবীন্দ্রনাথ সঙ্গত কারণে উপন্যাসটিকে দুটি অংশ ভেঙে নিয়ে রাজসিংহের আলোচনা করেন। অবশ্য উপন্যাসকে এভাবে ভেঙে নিয়ে আলোচনা করলে গঠনশৈলী নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মনে হতে পারে বঙ্কিমচন্দ্র এখানে এই দুই অংশকে মেলাতে পারেননি। তাই আলাদাভাবে নয় সমগ্র উপন্যাসের প্রেক্ষিতেই এই উপন্যাসের ঐতিহাসিকতা বিচার করা চলে।
উপন্যাসের মূলকাহিনী চঞ্চলকুমারীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, চঞ্চলকুমারী মোঘল বাদশা ঔরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজপুত বীর জয়সিংহের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এঘটনা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক উপন্যাসে যত যুদ্ধের আয়োজন হয়েছে সেগুলিতে ঔপন্যাসিক ইতিহাসিকের সত্যকে অবিকৃতভাবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু মূল কাহিনীর সঙ্গে আরো দুটি উপকাহিনী যুক্ত হয়েছে-দরিয়া-মোবারক জেবন্নিসা প্রেমকাহিনী এবং নির্মলকুমারী মাণিকলাল ও ঔরঙ্গজেবের কাহিনী। বঙ্কিমচন্দ্র ঐতিহাসিক কাহিনীর মধ্যে মানব অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন যথেষ্ঠ) চঞ্চলকুমারী যে রাজসিংহের কাছে শরণাপন্ন হয়েছিল তার মধ্যে কোন মানবিক প্রেম আত্মগোপন করেছিল কিনা, তার চমৎকার বিশ্লেষণ করা হয়েছে রাজসিংহ ও চঞ্চলকুমারীর সাক্ষাতে। চঞ্চলকুমারী শুধুমাত্র রাজ্যরক্ষার জন্য রাজসিংহ ও চঞ্চলকুমারীর সাক্ষাতে। চঞ্চলকুমারী শুধুমাত্র রাজ্যরক্ষার জন্য রাজসিংহকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কিনা, প্রবীণ রাজসিংহকে পতিত্বে বরণ করায় চঞ্চলকুমারীর কোন সংকোচ আছে কিনা এসম্পর্কে নিঃসংশয় হয়ে তবেই রাজসিংহ চঞ্চলকুমারীকে বরণ করেছিলেন।
আর উপকাহিনীর নায়িকা জেবন্নিসাকে নিয়ে প্রেমাকর্ষণের যে চিত্তাকর্ষক কাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে তাও ইতিহাসের বৃত্ত ছাড়া অসম্ভব ছিল। শাহাজাদী বলেই তার কাছে প্রেম ছিল শুধু ভোগের, মবারকে সে শুধু সেভাবেই ব্যবহার করবে, মবারককে কখনোই প্রেমিক হিসাবে স্বীকৃত দেবেন না। কিন্তু নানা ঘটনাচক্রে কখন যে হৃদয়ে সেই প্রেম জাগ্রত হয় তা নবাবজাদীরও অজানা ছিল। রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ আলোচনায় বলেছেন-“বিলাসিনী জেবউন্নিসাও মনে করিয়াছিল সম্রাট দুহিতার পক্ষে প্রেমের আবশ্যক নাই, সুখই একমাত্র শরণ্য।………. তাহার পর আর সুখ পাইল না। কিন্তু আপন সচেতন অন্তরাত্মাকে ফিরিয়া পাইল।……এখন হইতে সে অন্তত জগৎবাসিনী রমণী।”
দ্বিতীয় উপকাহিনীতে বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ কৃতিত্ব তিনি ইতিহাসের সম্রাট ঔরঙ্গ জেবের মধ্যে নির্মলকুমারীর প্রতি প্রেমাকর্ষণকে জাগিয়ে তুলেছেন।
‘রাজসিংহে’ কোন কানানৌচিত্ত দোষ নেই। অথচ ইতিহাসরস ও মানবরসের আশ্চর্য সমন্বয়। বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস সন্দেহ নেই।
Leave a comment