মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি ধারা হল অনুবাদের ধারা। রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি সাহিত্যের অনুবাদ হতে থাকে। মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন শীরাম দাস। অনুরূপভাবে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। তবে কৃত্তিবাসী সাহিত্যকে বাঙালিরা শ্রীরাম ‘পাঁচালী’ বলে থাকে। একথা ঠিক বাল্মীকির রামায়ণ যে অর্থে ভারতী শ্রোতার চিত্তকে কাব্যের হিরন্ময় আবরণের আড়ালে গভীরতম অভিজ্ঞতার সন্ধান দেয় সেই অর্থে কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি মানসের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
রামায়ণের আবির্ভাব কাল :
কবি তাঁর আত্ম বিবরণীতে নিজেই বলে গেছেন—
“আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘমাস।
তথিমধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।”
বিভিন্ন জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ জ্যোতিষ গণনা করে উক্ত ছত্র দুটি সম্পর্কে সঠিক কাল নির্ণয়ে আগ্রহী হলেও তাঁদের অধিকাংশের মধ্যে মতানৈক্য স্পষ্টত অনুধাবন করা যায়। তবে মোটামুটি ভাবে বলা যায় ১৩৯৮ খ্রীঃ মাঘমাসে রবিবার শ্রীপঞ্চমী তিথিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিশ বছর পরে ১৪১৮ খ্রীঃ গৌড়ের রাজা গণেশের রাজসভাতে তিনি যান। এই গৌড়রাজ গণেশ দনুজ মদনদের নাম ধারণ করেন এবং এখানেই কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালী রচিত হয়।
রামায়ণের পরিচয় :
অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে যতগুলি সাহিত্য রচিত হয়েছে সেগুলির মধ্যে কৃত্তিবাসের রামায়ণ অন্যতম। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও কৃত্তিবাস সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। প্রসিদ্ধ কুলাচার্য ধ্রুবানন্দ মিশ্র রচিত ‘মহাবংশ’ গ্রন্থে কৃত্তিবাস সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘কৃত্তিবাস কবিবীমান সৌমঃ শান্ত জনপ্রিয়। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে আছে—
রামায়ণ রচিল বাল্মীকি মহাকবি।
পাঁচালী করিল কৃত্তিবাস অনুভবি।।
এটুকু ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন আলোচনার মধ্য দিয়ে জানা যায়—কৃত্তিবাসের পূর্ব-পুরুষ পূর্ববঙ্গবাসী নর সিংহ ওঝা বেদানুজ রাজার মন্ত্রী ছিলেন। পূর্ববঙ্গের এই অঞ্চলে মুসলমান আক্রমণের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় ফুলিয়া গ্রামে নতুন বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধর মুরারি ওঝা, তাঁর পুত্র বনমালী। বনমালীর ছয় পুত্র এক কন্যা। জেষ্ঠপুত্র কৃত্তিবাস ওঝা।
রামায়ণের সাহিত্য মূল্য :
কৃত্তিবাসের পাঁচালী মূল কাব্যের অবিকল অনুসরণ নয়। এটি আক্ষরিক অনুবাদ নয় ভাবানুবাদ। কোথাও মূলকাহিনিকে কিছু পরিবর্তন করে নিয়েছেন আবার অনেক কাহিনি পরিত্যাগ করেছেন। যেমন কার্ত্তিকের জন্ম, বশিষ্ট বিশ্বামিত্রের বিরোধ, অম্বরীষ যজ্ঞ। কৃত্তিবাস বাল্মীকি কাহিনির অনেক রদ বদল করে নিয়েছেন। আবার অন্য কোথাও থেকে কাহিনি, সংগ্রহ করেছেন। যেমন—দস্যু রত্নাকরের মড়া মড়া উচ্চারণ অধ্যাত্ম রামায়ণ থেকে সংগ্রহ করেছেন। হরিশচন্দ্র উপাখ্যান দেবী ভাবগৎ থেকে ভগীরথের জন্মবৃত্তাত্ত পদ্মপুরাণ থেকে, কুম্ভকর্ণ হত্যা বিভিন্ন পুরাণ ও নানা গ্রন্থ থেকে। বাস্তবিক কৃত্তিবাসের ভক্তিবাদ বাল্মীকির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আবার নিজ কল্পনা থেকে তিনি যে কাহিনিগুলি নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে তিনি মৌলিকতার দাবি করতে পারেন। সেগুলি হল-দীলিপ-রঘুর কাহিনি, দশরথের রাজ্যে শনির দৃষ্টি, গণেশের জন্ম, কৈকেয়ীর বর লাভ, হনুমান কর্তৃক সূর্যকে কক্ষতলে ধারণ, বীরবাহুর যুদ্ধ, রামচন্দ্রের অকাল বোধন, লবকুশের যুদ্ধ ইত্যাদি।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রাচীন পুঁথিতে ভাষা ও ছন্দের ত্রুটি থাকলেও তাঁর বর্ণনা সহজ সরল। যেমন—
“রাম বলেন সীতা নাইরে লক্ষণ।
তোমার দোষ নাহি মোর দৈব ঘটন।”
ত্রিপদী ছন্দ, শ্বাসাঘাত ছন্দ প্রভৃতি সুন্দরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। রামায়ণের কারুণ্যের মধ্যে রঙ্গ কৌতুকও রয়েছে। যেমন—
“আত্মছিদ্র না জানিস পরকে দিস খোঁটা।
বারে বারে কহিস কথা মড়গে পাজি ব্যাটা।।”
রামায়ণের সমাজ জীবনের প্রভাব :
এই রামায়ণে বাস্তব জীবনের সুখ দুঃখ পরিস্ফুট হয়েছে, এখানে যুদ্ধ বিগ্রহ সত্ত্বেও জীবন রস ফুটে উঠেছে। কৃত্তিবাসের রামচন্দ্র প্রেমের দেবতা, ভক্তপ্রাণ, অশ্রুতে ব্যাকুল। বাঙালি মানুষও রামচন্দ্রের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সততায় উদ্ভাসিত হয়। লক্ষণ অপরিণামদর্শী উদ্ধত যুবক। দশরথ স্ত্রৈণ অসহায় ক্লীব, কৈকেয়ী মন্থরা নীচ স্বার্থ সন্ধানী। সীতা সর্বংসহা বাঙালি গৃহবধূর মতো কোমল মূর্তি। তাই কৃত্তিবাসের রামায়ণের চরিত্রগুলি উত্তর দক্ষিণ ভারত ত্যাগ করে বাঙালির কুটীর প্রাঙ্গণে অবতীর্ণ হয়েছে। বাঙালিরাও তাঁদের প্রেরণায় নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে চায়। তাই ঘরে ঘরে লক্ষ্মণের মতো কনিষ্ঠ ভ্রাতা, সীতার মতো মাতৃ স্বরূপা ভাতৃজায়া বর্তমান। এই কাব্যের মধ্যে মধ্যযুগীয় বাঙালির প্রতিচ্ছবি সম্পূর্ণরূপে ফুটে উঠেছে।
সর্বোপরি বলতে হয় বাল্মীকি মহাকাব্য রচনা করলেও কৃত্তিবাস ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে মহাকাব্য রচনা করার মতো দক্ষতা ছিল না। তাই তিনি মহাকাব্যের বদলে পাঁচালী রচনা করেছিলেন যা বাঙালির মনকে জয় করেছিল।
Leave a comment