চৈতন্যদেবের পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য কি কাব্যে কি শিল্পে স্বরূপে, কি আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও দর্শনে ভারতীয় সমসাময়িক মধ্য যুগীয় সাহিত্যকে অতিক্রম করে গেছে। চৈতন্যদেব যে যুগ ও সমাজে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁর তিরোধানের প্রাক মুহূর্তে সেই যুগ এবং সমাজের প্রায় আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। মানুষের মূল্যায়ন সমাজে ও সাহিত্যে নতুন করে আলোচিত হওয়ার সুযোগ পেল। একটি ব্যক্তিত্ব ও একটি মনীষার অমোঘ প্রভাব কতখানি সুদূর প্রসারী হতে পার তার অপরূপ দৃষ্টাস্তবলী প্রায় পাঁচশ বৎসর ব্যাপী বাংলা সাহিত্যে পর্যালোচনা করলে উপলব্ধ হবে। ভক্তি বাদ অহৈতুকী-বাদ চৈতন্যোত্তর পদাবলী সাহিত্যের একটি বিশেষ লক্ষণ। ভক্তি, কবিত্ব ও শিল্প মহিমার এমন অপরূপ সামঞ্জস্য এই যুগ ছাড়া অন্য কোনও যুগে সম্ভব হয়নি। পঞ্চরসের সমস্ত ধারার তাত্ত্বিক রসরূপের সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে এই যুগে। যে অভিনব পদাবলী সাহিত্য শাখা চৈতন্যের ও রাধাকৃষ্ণ স্বরূপকে সামনে রেখে লীলায়িত হয়েছিল তা তিনজন শ্রেষ্ঠ পদকর্তা বলরামদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাসের মধ্যে সার্থকতা অর্জন করেছে।
বলরামদাস :
বাৎসল্য রসের পদ রচনায় সমগ্র বৈষ্ণুব সাহিত্যে বলরাম দাসের তুল্য কবি আর কেউ নেই। বাৎসল্য রসের তিনি শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কবিপ্রতিভার কয়েকটি লক্ষণ হল বাৎসল্য প্রীতি, আত্ম সচেতনতা ও বর্ণনা ক্ষমতা। আমরা জানি বাৎসল্য রস বৈব পঞ্চরস অন্তর্গত অর্থাৎ সাধ্য বস্তু। বলরামের পদে মাতৃহৃদয়ের আনন্দ বেদনা উদ্বেগ প্রথম উৎসারিত হওয়ার সুযোগ পেল। ঐশ্বর্য ভাব সম্পূর্ণ ভাবে বর্জন করে শিশু কৃষ্ণের মধ্যে সাধারণ মানব শিশুর কৌতূহল ও চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছি। সহানুভূতি ও মানবীয় আবেগে তাঁর স্থান অত্যন্ত উচ্চে। হয়তো তাঁর মধ্যে কল্পনার উৎসার একটু কম কিন্তু তাঁর বাস্তব প্রীতি, মাতা ও সন্তানের নিখুঁত চিত্রে পরিস্ফুটনের ক্ষমতা অসাধারণ।
“হিয়ার ভিতর হরিতে কে কইল বাহির
তেই বলরামের পহুঁর চিত নহে স্থির।”
—এই ছত্র দুটি রবীন্দ্রনাথের মনেও একটি অপূর্ব রস জাগিয়ে তুলেছিল। এর মধ্যে একটা অসাধারণ বেদনা বিধুর রূপ ফুটে উঠেছে।
বাৎসল্যের উপকরণ :
স্নেহ মমতাপূর্ণ একটি ব্যাকুল ভাব তাঁর মধ্যে এমন একটি রসব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে যা আধুনিক পাঠককেও বিস্মিত করে। কালীয় দমনের ঘটনায় যশোদার ব্যাকুলতা একটি জননীর আতঙ্কিত হৃদয়ের নিবিড় ছবিকে তুলে ধরেছে। কালিন্দীর কূলে দাঁড়িয়ে যশোদা বার বার বুক চাপড়ে জলে ঝাঁপ দিতে যান। জননীর এই ভয়-ব্যাকুল মূর্তিটি বলরাম অতি দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্তিকা ভক্ষণ, ননী চুরি, চাঁদ ধরা, গোচারণ, এসকল বিষয়েই বলরাম অন্যান্য কবিদের থেকে অগ্রণী। তাঁর—‘নীতে মোহন দুলাল’ কিংবা
“মায়ে দেখি মাটি খেলে
নাখাই নাখাই বলে
আধো আধো বদন ধূলায়।”
বা, ‘চাঁদ মোর চাঁদের লাগিয়া কান্দে’ প্রভৃতি পদে একটি মধুর সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।
বলরামের কবিকীর্তি :
বলরাম দাসের পদাবলীকে মূলত দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। ‘গৌর চন্দ্রিকা’ এবং ‘রাধা কৃষ্ণলীলা’। নৃত্যোন্মত্ত আবেশ মুগ্ধ গৌরাঙ্গের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলরামের বিবরণ প্রত্যক্ষ দর্শীর মতো বাস্তব ধর্মী হয়ে উঠেছে।
“নাচিতে নাচিতে গোরা যেনা দিগে যায়
লাখে লাখে দীপ জ্বলে কেহ হরি গায়।”
–তাঁর শব্দ ঝংকার ও শব্দ কৌশলে মাঝে মাঝে গোবিন্দ দাসের অনুকরণ আছে। তাঁর কাব্যে শিল্প গুণ বলতে যা বুঝি তা কিছুটা কম। তাঁর পদের প্রধান গুণ আন্তরিকতা। যার মধ্যে অনাবৃত অন্তরের আনন্দ ও বেদনার স্পর্শ আছে।
জ্ঞানদাসের কবিকৃতি :
বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জ্ঞানদাস। তিনি তাঁর পদগুলিকে রোমান্টিক চেতনার রসানুভূতির দ্বারা এক অপূর্ব রসলোকে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি একাধারে ভাবুক এবং শিল্পী তিনি সমকালের গন্ডীকে অতিক্রম করে আধুনিকতার কূলে পৌঁছে গেছেন। একালের পাঠক, পাঠিকারা জ্ঞানদাসের পদ পাঠ করে আনন্দ পান। তিনি চন্ডীদাসের ভাব শিষ্য হয়েও স্বতন্ত্র মহিমায় অধিষ্ঠিত।
জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই পদ লিখেছেন, তবে বাংলা পদে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি তাঁর ব্রজবুলির পদগুলিতে অতি সচেতন কাব্যকলার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
জ্ঞানদাসের রসোেগারের কয়েকটি উৎকৃষ্ট পদ পরম উপভোগ্য। এই জাতীয় রসাবেশে আদিরসের অনিবার্য আগমন ঘটবেই। রাধার প্রতি কৃষ্ণের স্নিগ্ধ সজল মমতা বড় করুণ হয়ে উঠেছে।
“নিজের আলসে যদি পাশমোড়া দিয়ে
কি ভোলা কি ভোলা বলি চমকি উঠয়ে।”
বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় রসোদগার পর্যায়ের একটি পদ হল—
“শিশু কাল হইতে বধুর সহিতে
পরানে পরানে নেহা
অথবা-
“রূপলাগি আঁখি ঝুবে গুণে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরান পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।”
ভাব ও ভাষার সর্বোপরি একটি সরস মর্ত চেতনার পরিচিত স্পর্শ পদগুলিকে আধুনিক মনোভাবের অনুকূল করে তুলেছে।
জ্ঞানদাসের আক্ষেপানুরাগের পদ চন্ডীদাসের ভাবানুশ্রায়ী হলেও মৌলিকত্ব অর্জন করেছে। যেমন–
“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল
আমিয়া সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।”
রাধার ভাগ্যদোষে বাস্তব পরিস্থিতির এমন বিপরীত রূপায়ণের সার্থক কাব্য-ভঙ্গী চন্ডীদাস ছাড়া আর কারোর মধ্যে দেখা যায় না। জ্ঞানদাসের এই পদে রাধাকে কোনও সান্ত্বনা দেবার কথা শোনান হয়নি, কেননা কানুর প্রেম আনন্দের নয় ব্যাথার– “কানুর পিরীতি মরণ অধিক শেল।”
রূপানুরাগের পদ রচনায়’ জ্ঞানদাস অতুলনীয়।
“রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।”
এর মধ্যে কোনও মধ্য যুগীয় ভাষ৷ রীতি নেই। এযেন এযুগের কোনও মহাকবির হৃদয়- অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা। যৌবনের বনে হারিয়ে যাওয়ার রূপ কল্পটি একেবারে আধুনিক কালের।
গোবিন্দদাসের কবিকৃতি
গোবিন্দ দাস বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। এমন সচেতন শিল্পী ও রূপদক্ষ কবি মধ্য যুগীয় বাংলা সাহিত্যে আর জন্মান নি। কবির লেখনি একই সঙ্গে ভাস্কর্যধর্মী ও চিত্রধর্মী : আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাটকীয়তা ও আলংকারিতা। রূপ রস দর্শন ও তত্ত্ব হাত ধরা ধরি করে চলেছে। কেউ কাউকে গৌণ করেনি। লৌকিক ও অলৌকিক রূপের সমন্বয় তাঁর পদে একান্ত নিবিড় হয়ে উঠেছে। একটি গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ—
“নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞনে
পুলক মুকুল অবলম্ব
স্বেদ মকরন্দ বিন্দু বিন্দু চূয়ত
বিকশিত ভাব কদম্ব।”
–চোখের সামনে যেন একটি রূপ স্পষ্ট দেখছেন এক ভক্ত শিল্পী তাঁর ভাবাকুল হৃদয় দিয়ে। টান টান তুলিতে রূপের উল্লাস আশ্চর্য সংযমে ধরা পড়েছে। অভিসারের তিনি শ্রেষ্ঠ কবি তাঁর—
“কণ্টক গাড়ি কমল সম পদতল
মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি
গাগরি বারি ঢারি করি পিছল
চল তাহি অঙ্গুলি চাপি।”
এর মধ্যে আছে এক অনিবার্য প্রাণাবেগ, দুর্জয় আত্ম বিশ্বাস, অতন্দ্র সাধন দীপ্তি। অপরিসীম উৎকণ্ঠার যন্ত্রণাময় আকৃতি। অনস্তের জন্য অন্তহীন পদক্ষেপ যেন অভিসারের রূপ ধরেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“অপূর্ণ চলেছে পূর্ণের দিকে।”
অনুশীলনের পর অভিসারিকা রাধার সামনে গোবিন্দ দাস বিশ্ব প্রকৃতির যে চিত্র এঁকেছেন তা শব্দ, যন্ত্র, ধ্বনি, গুণ ও ভাব গৌরবে মিলে মিশে অনিবচনীয়ের স্তরে পৌঁছে গেছে।
মন্দির বাহির কঠিন কপাট
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।
তঁহি অতি দূরতর বাদর দোল
বারি কি বারই নীল নিচোল।”
বিশ্ব লোক আর শিল্প লোকের এমন অভাবনীয় সমন্বয় গোবিন্দ দাস ছাড়া আর কোনও কবির পদে পাওয়া যায় না।
উপসংহার : চৈতন্য দেবের প্রভাবে বৈষ্ণব পদাবলীর যে বিরূপ বৈচিত্র্য সাধিত হয়েছে উক্ত তিন কবির লেখনীতে সহজেই প্রতীয়মান। প্রেমভক্তির শিল্প সমুৎকর্ষ ও কল্পনার অবাধ লীলায় বাংলার বৈষ্ণব পদাবলী যে বিশ্বের লিরিক কবিতার ইতিহাসে একটি যুগ সৃষ্টি করেছে তার উৎস ও প্রেরণা হচ্ছে শ্রীচৈতন্য দেবের অলোক সামান্য প্রভাব, তাঁর প্রেম ও ভক্তির দৃষ্টান্তই পদকার দিগকে উদ্বুদ্ধ করেছে, উন্মত্ত করেছে, এর পরবর্তী কবি শ্রীনিবাস আচার্য ও নরোত্তমের প্রভাবে বৈষ্ণব পদাবলী সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে আবার নতুন দিকে বিকাশ লাভ করেছিল। কালের অমোঘ স্রোতে এই বৈপরিবর্তন নিয়মমাফিক।
Leave a comment