রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- “রাজসভাকবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো। যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।”

রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিটির তাৎপর্য দ্বিমুখী। নঞর্থক ও সদর্থক। নঞর্থকভাবে বোঝানো হয়েছে, ভারতচন্দ্রের কাব্যে নেই সেই সুদূরের মায়ায় ভরা সৌন্দর্যের রহস্যব্যাকুল ছবি ; যে সৌন্দর্য বুকে নিয়ে বৈব কবিদের পদাবলী হয়ে উঠেছে— “বসন্তকালীন অপর্যাপ্ত পুষ্প মঞ্জরীর মতো। যেমন তাহার ভাবের সৌরভ তেমনি তাহার গঠনের সৌন্দর্য্য।” অর্থাৎ রোমান্টিক সৌন্দর্য কিংবা প্রকৃতির পুষ্প মঞ্জুরীর সৌন্দর্য্যে আমাদের কল্পনা যেমন ক্ষণে ক্ষণে পরমের স্পর্শ অনুভব করে, অনন্ত বৈচিত্রের খেলায় উচ্ছলিত হয়, ভারতচন্দ্রের কাব্যের সৌন্দর্য্য পাঠককে তেমনভাবে রহস্য ব্যাকুল করে তোলে না। অন্নদামঙ্গল গানে নেই সেই শব্দাবলী যা অসীম সৌন্দর্য রহস্যের অন্তঃপুরে প্রবেশের চাবিকাঠি স্বরূপ। কবির কাব্যের সুরে নেই এমন কোন টান যা মনকে সৌন্দর্য্যের অকূলপাথারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর সদর্থক দিক হল—‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের সৌন্দর্য্য মূর্তি নিখুঁত রত্নশিল্পীর মত সুদক্ষ ও সুনিশ্চিত রেখার টানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উজ্জ্বল কারুকৃতিময় প্রকাশকলার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ করেছে পাঠক-মন।

ভারতচন্দ্রের কাব্যে শিব দারিদ্র জর্জর এক সংসারী মানুষের প্রতিরূপ। মানুষী মহিমা ও দুর্বলতা দুই তাঁর আছে। উপরভু কবি দেখিয়েছেন জগৎ সংসারে এমনি মিথ্যা মায়ার খেলা যে স্বয়ং জগৎপিতা শিবকেও এই জাগতিক মায়ায় পড়ে দিশাহারা হতে হয়। এইরূপ উদভ্রান্তিতে দেবীর সঙ্গে তাঁর কোন্দল বাঁধে। কবি তা সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন—

“বিধি মোরে লাগিল রে বাদে

বিধি যার বিবাদী কি সাধ তার সাধে।”

এভাবেই কবি কখনো অনুকূল ভাবমণ্ডল তৈরির উদ্দেশ্যে কখনো আবার ভাব বা আদর্শের সংঘাতকে রূপ দিয়েছেন—

বড় আনন্দ উদয়

বহুদিনে ভগবতী আইলা আলয়।

সঠিকভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, এইসব গানসংযোজনের দ্বারা মঙ্গলকাব্যের গতানুগতিক পাঁচালিতে গীতিকবিতার রস সঞ্চারিত করার কৃতিত্ব দেখালেও কবি বৈষ্ণুব কবিদের সেই অতলস্পর্শ ভাবগভীরতার পরিচয় দিতে পারেননি। কবির ভক্তিমূলক প্রার্থনার শব্দ সৌন্দর্য্য আমাদের মনকে বিমুগ্ধ করে বটে কিন্তু পাওয়া যায় না মধুর তীব্র আকুতির স্পর্শ। অন্যদিকে রঙ্গব্যঙ্গের অফুরন্ত বৈচিত্রে অন্নদামঙ্গলের ‘বিদ্যাসুন্দর’ যেভাবে উচ্ছলিত হয়েছে অন্নদামঙ্গলের প্রথম খণ্ডে তার অবকাশ ছিল কম। ঋষিশ্রেষ্ঠ ব্যাসদেবের উপহাসাম্পদ চরিত্র চিত্রণ তাঁর নির্ভুল উদাহরণ।

এসব সত্ত্বেও আমাদের মানতে হয়, অন্নদামঙ্গলের প্রথম খণ্ড ‘রাজকণ্ঠের মণিমালা’। যে শব্দসিদ্ধি, ছন্দের বৈচিত্র ও অলংকারের সৌন্দর্য মিলে ভারতচন্দ্রের কাব্যকে অনবদ্য শিল্প মহিমায় উজ্জ্বল করে তুলেছে তার সকল গুণবৈশিষ্ট্য অন্নদামঙ্গলের দেবখণ্ডে নিহিত। মৌখিক শব্দের অসাধারণ শক্তি একদিকে যেমন ‘শিবের বিবাহযাত্রা’ কিংবা ‘শিববিবাহ’ কিংবা ‘হরগৌরীর কোন্দল’ অংশে দেখা যায় তেমনি শুদ্ধ তৎসম শব্দ ব্যবহারের দ্বারা যখন তিনি দেবী অন্নপূর্ণার মহিমা বর্ণনা করেছেন তখনো তার উপযুক্ত গাম্ভীর্য পরিপূর্ণভাবে রক্ষিত হয়েছে—

“ভয় কিরে ওরে বাছা হরি।

আমি অন্নপূর্ণা মহেশ্বরী।”

এই সংগীতে যেমন দেবীর আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি অভিশপ্ত ব্যাসদেব যখন মর্মান্তিক বেদনায় দেবীর অনির্বচনীয় মহিমা জ্ঞাপন করেছেন—

“বাক্যাতীত গুণতব বাক্যে কত কব

শক্তিযোগে শিব সংজ্ঞা শক্তিলোপে শব।”

তখন উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত শব্দ ব্যবহারের কৃতিত্ব ভাস্বর হয়ে উঠেছে। পয়ার, ত্রিপদী, একাবলী প্রভৃতি ছন্দের সুনিপুণ ব্যবহারে কাহিনি বর্ণনায় বিচিত্র গতিসাধন এই দেবখণ্ডে পরিপূর্ণ সার্থকতা লাভ করেছে।

সংস্কৃত ভুজঙ্গ প্রয়াত ছন্দে মহেশ্বরের সেই ভয়ঙ্কর উদাত্ত ডাক, “সতী দে সতী দে……….” কিংবা দক্ষযজ্ঞনাশে তৃনক ছন্দের সুদক্ষ ব্যবহার ‘ভূতনাথ ভূত সাথে দক্ষযজ্ঞ নাশিছে।” অন্নদামঙ্গলের এইসব গৌরববর্ধক প্রয়োগ দেবখণ্ডেরই অন্তর্গত। সংস্কৃত তোটকছন্দের আধারে নারদের গান কিংবা সরাসরি তামরস ছন্দে সংস্কৃত গান সুনিশ্চিতভাবে কবির কারুকৌশলের অভ্রান্ত নিদর্শন। শিববিবাহযাত্রায় ভূতপ্রেতগণের শোভাযাত্রার যে বর্ণনা কবি দিয়েছেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আজও তা অতুলনীয়। এমন অদ্ভুত ও বীভৎস মিশ্রিতরস সৃষ্টির অধিকারে ভারতচন্দ্রের কাছাকাছি কেউ আসতে পারেননি। ধ্বন্যাত্মক শব্দের ধ্বনি এবং ছন্দের এমন পরিপূর্ণ ভাবসঙ্গতি তুলনাহীন। শব্দের দ্যোতনাশক্তির এমন স্পষ্ট উদাহরণ বাংলা কাব্যে আর নেই। শুধু গৌরবোজ্জ্বল ভাব ও চরিত্রের ছবিই তিনি আঁকেননি, নিতান্ত কর্কশ ও কুশ্রীতাকে ফুটিয়েছেন সুস্পষ্ট সুনিশ্চিত রেখার টানে। জরতী বেশিনী অন্নপূর্ণার বর্ণনা এক্ষেত্রে খুবই লক্ষণীয়—

ডানি করে ভাঙ্গা নাড়ি বামকক্ষে ঝুড়ি 

ঝাঁকড় মাকর চুল নাহি আঁটি সাঁটি

হাত দিলে ধূলা উড়ে যেন কেয়া কাঁদি।।

কিংবা-

কোটরে নয়নদুটি মিটিমিটি করে 

চিবুকে মিলিয়া নাসা ঢাকিল অধরে।

মহাজ্ঞানী ঋষির তীক্ষ্ণচোখও এই ছদ্মবেশ ভেদ করতে পারেনি। অথচ এই দেবী যখন দ্ব্যর্থব্যজ্ঞক ব্যাজস্তুতিতে ও শ্লেষে আত্মপরিচয় দিয়েছেন ঈশ্বরী পাটনীর কাছে তখন তাঁর অঘটনঘটন পটিয়সী মহিমার স্বরূপ বুঝতে কিছুমাত্র বিলম্ব হয় না।

সর্বোপরি আছে মানবিক সারল্যে হৃদয়বত্তায় এবং নির্লোভ নির্মোহ জীবনচর্যায় সেই অবিস্মরণীয় চরিত্র খেয়াঘাটের মাঝি ঈশ্বরী পাটনী। ক্ল্যাসিকাল রীতিতে সুস্পষ্ট উজ্জ্বল রেখায় অঙ্কিত এই চরিত্রটি যে শুধু একটি পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে তাই নয় এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সর্বাঙ্গীন সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ নিটোল রূপ লাভ করেছে বাঙালির চিরদিনের একটি আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন। সে স্বপ্ন কোনও অধরা সুদূর সৌন্দর্যের জন্য ব্যাকুল নয়। সে স্বপ্ন এমন শিল্পের স্বপ্ন যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকেই সযত্ন পরিচর্যার দ্বারা করে তোলে সৌন্দর্যে-স্নেহে-অপরূপ, মধুর এবং কাস্তিময়। অর্থাৎ কারুশিল্পী যেমন করে ফুটিয়ে তোলেন রত্ন মণিশরীর। ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কবিও তেমনি করেই ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পীত জীবনের রূপ। রাজকণ্ঠের মণিমালার মতই যা একই সঙ্গে স্মরণীয় ও বরণীয়; যার মধ্যে আছে কাব্যকলার বহিরঙ্গ বর্ণচ্ছটা এবং অন্তরঙ্গ ভাবদীপ্তি।