মঙ্গলকাব্য মূলত দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই রচিত। এই দেবমাহাত্ম্য প্রচারিত হয়েছে মৃত্তিকাচারী মানুষের দ্বারাই। সুতরাং মঙ্গলকাব্যে দেবতার প্রাধান্য থাকলেও মানব কথা অবহেলিত নয়। দেবদম্পতি মর্ত্যলোকে মানবরূপেই জন্মগ্রহণ করেন এবং মর্ত্যের মানুষের মতই জীবনাচরণ করেন। তাই তাঁরা সাধারণ সুখ দুঃখের অতীত নয়। মৃত্তিকা লগ্ন মানুষের ব্যথা বেদনা, হাসিকান্না, সুখ দুঃখ প্রভৃতি তাঁদের চরিত্রের মধ্যে রূপায়িত হয়েছে। অতএব প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের মধ্যেই মানবকথার একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। তবে অবিমিশ্র মানবকথা আধুনিক সাহিত্যের বিষয়বস্তু। মধ্যযুগে ধর্মপ্রায় বাঙালির নিকট সেটা সম্ভব ছিলো না, কেননা, যুক্তিবাদ, বুদ্ধিবাদ তখন অনেকটা অবহেলিত ছিল। তাই সে যুগের মানবকথা ছিল দেবনির্ভর। মঙ্গলকাব্যের দেবতা মর্ত্যের রং ও গন্ধ নিয়েই আবির্ভূত। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় তাই বলেছেন : “দেব দেবীগণের মাহাত্ম্য সেখানে তেমন ভালোভাবে ফুটিয়াও উঠে নাই, প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই, যতখানি ফুটিয়া উঠিয়াছে মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা ও অপমান।”
তৎকালীন রাজদরবারে ভোগ বিলাসের যে ঢেউ উঠেছিল, সাধারণ জীবনকে তা স্পর্শ করেছিল। এই অবস্থায় সার্বিক দৈবানুগত্য সম্ভব ছিলনা। ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল রচনা করেছেন নিজের অন্তরের ভক্তির তাগিদে নয়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে। ফলে, তিনি মঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন বটে, কিন্তু সেখানে দেবতার কথা অপেক্ষা মানবকথা প্রাধান্য লাভ করেছে। বস্তুত কবি তাঁর কৌতুকবশে স্থূল দৃষ্টি নিয়ে দেবতাদের আচার আচরণ লক্ষ করেছেন। তাই তাঁদের আচার আচরণে মানবিক দোষ ত্রুটিগুলি এত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিব অন্নপূর্ণা নারদ ব্যাসদেব গঙ্গা সকলকেই তিনি মানবিক গুণে ভূষিত করেছেন। শিবের বিবাহ যাত্রা, বৃদ্ধ বর দেখে মেনকার বিলাপ, নারদের প্রতি রোষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার, বিবাহ সভায় শিবের আচরণ, গঙ্গা ব্যাসদেবের ব্যক্তিগত কোন্দল প্রভৃতি মোটেই দেবসুলভ নয়। তারপর শিবের দাম্পত্য জীবনকথা পুরোপুরি মানবকথায় পরিণত। পুরাণোক্ত শিব দেবাদিদেব মহাদেব। তিনি ত্রিশূলধারী, যোগীশ্বর, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের অধিকর্তা। কিন্তু মঙ্গল কাব্যের কবিরা শিবকে লোকায়ত জীবনে নামিয়ে এনেছেন। তাঁকে অঙ্কন করেছেন দীন দরিদ্র মানুষের প্রতিনিধি রূপে।
শিব কৈলাসেশ্বর। তাঁর তো অভাব অনটন থাকার কথা নয়, তবু তিনি ভিখারী। মঙ্গলকাব্যে শিবের এই ভিখারী রূপটি শিব চরিত্রকে বিশেষভাবে মানবিক গুণসমৃদ্ধ করেছে। ভারতচন্দ্রের শিবও সর্বরিক্ত ভিখারী, প্রতিদিন বহু কষ্টে ভিক্ষা করে বাড়ি ফিরেও কোনদিন বসনা চরিতার্থ করতে পারেন না। কোনদিনই একটু ভালোভাবে উদর পূর্তি হয়না। বাঙালির মতো শিব ভোজন রসিক মানুষ। তাঁর সাধ যতটা আছে, সাধ্য ততটা নেই। তার ওপর স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া তো লেগেই আছে। সুখ শান্তির আলৌকিকাভা তাঁর জীবনে সঞ্চারিত হয়নি। তাই রাগ ওঠে স্ত্রীর ওপর। দুঃখে অভিমানে তিনি স্ত্রীর প্রতি অভিযোগ হেনে বলেন—
আর আর গৃহীর গৃহিণী আছে যারা।
কত মতে স্বামীর সেবন করে তারা।।
কিন্তু শিবের কপালে সেই সুখ নেই। অতএব শিব মহাশয়ের নিশ্চিত ধারণা গৌরী নিশ্চয়ই সুলক্ষণা মেয়ে নয়। কিন্তু গৌরী এর সঠিক জবাব দিতে ভোলে না—
অলক্ষণা সুলক্ষণা যে হই সে হই।
মোর আসিবার পূর্বকালি ধন কই।
গিয়াছিলে বুড়াটি যখন বর হয়ে।
গিয়াছিলে মোর তরে কত ধনলয়ে॥
স্বামীকে তিনি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন যে দোষ তাঁর নয়। উভয়ের কোন্দল যখন চরম পর্যায়ে ওঠে তখন রাগে ক্ষোভে শিব বলেন—
“ঘর উজাড়িয়া যাব ভিক্ষায় যা পাই খাব
অদ্যাবধি ছাড়িনু কৈলাস
নারী যার স্বতস্তরা সে জন জীয়ন্তে মরা
তাহার উচিত বনবাস।”
এই অবস্থায় মেয়েদের বাপের বাড়ী ভিন্ন উপায় থাকে না, গৌরীও যথারীতি দুই পুত্র নিয়ে বাপের বাড়ীতে চললেন। এইভাবে গৌরী ও হরের কাহিনি লোকায়ত জীবন চর্যার অম্লমধুর রসে অভিষিক্ত। এখানে দেবতার দেবত্বটুকু নিশ্চিহ্ন হয়ে মানবিক রূপটিই সুপরিস্ফুট হয়েছে। অর্থাৎ হরগৌরীর ঘরোয়া জীবনকথা বিশেষ বাস্তব সম্মতরূপে রূপায়িত। এখানে সাংসারিক যন্ত্রণা, দারিদ্র্যের মজ্বালা তীব্র তীক্ষ্ণ। মনে রাখা প্রয়োজন আধ্যাত্মিক আকাশকরণা সত্ত্বে বাঙালি চিরকালের গৃহমুখী। ধার্মিকতা ও বাস্তবতা অতীন্দ্রিয়তা ও ইন্দ্রিয়পরতা তার মনের একই পাত্রে অভিন্নভাবে বিদ্যমান।
ব্যাস কাহিনির মধ্যেও এই মানবিক আবেদনটি স্পষ্ট হয়ে আছে। ব্যাসদেব নিজে কাশী নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন পতিত পাবনী গঙ্গার সহায়তায়। কিন্তু তাঁর সেই সাধ পূর্ণ হল না। তখন ব্যাসদের ক্রোধে যেন ফেটে পড়লেন। একদিন যাকে তিনি প্রচার করেছিলেন, তাঁর কাছ থেকে এই অবজ্ঞা তিনি সহ্য করতে পারলেন না, তিনি সক্রোধে গঙ্গাকে বললেন—
“আমি যারে প্রকাশিনু আমি যারে বাড়াইনু
সেই মোরে তুচ্ছ করি কহে।
মাতঙ্গ পড়িলে দহে পতঙ্গ প্রহার করে
এ দুঃখ পরাণে নাহি সহে।।”
ক্রোধে ব্যাসদেব মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। স্থানকাল পাত্র, আত্মমর্যাদা সব ভুলে গিয়ে তিনি গঙ্গার সতীত্বের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। গঙ্গাকে বললেন—
স্বভাবতঃ নীচগতি সতত চঞ্চলমতি
কভু নাহি পতির নিয়ম।
যে ভালো ভজিতে পারে পতিভাব কর তারে
সিন্ধু সঙ্গে সম্প্রতি সঙ্গম ৷৷
এই ধরনের মন্তব্য শুনে গঙ্গাও স্থির থাকতে পারলেন না।—‘তুই তোকারী’ করে তিনিও ব্যাসদেবের জন্মের প্রতি কুৎসিত ইঙ্গিত করলেন। বললেন—
পরাশর ব্রষ্মঋষি তোর পিতা যেই।
ব্রাহ্মণের লক্ষণে ব্রাহ্মণে বটে সেই ৷৷
মৎস্যগন্ধা দাসকন্যা ব্রাহ্মণী ত নহে।
তার গর্ভে জন্ম তোর ব্রাহ্মণে কে কহে ৷৷
মোটের উপর বলা যায়, ভারতচন্দ্রের কাব্যের প্রধান গুণ ধর্মীয় আবেগ নয়, মানবিক আবেদনের ঐকান্তিকতা। ব্যাস কাহিনির পৌরাণিক ঐতিহ্য যাই থাক না কেন, এর মানবিক আবেদনের দিকটি মোটেই উপেক্ষণীয় নয় এবং বলা যায়, এই অংশের রসগত সিদ্ধি এই লৌকিক আবেদনেই।
Leave a comment