ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ উইলিয়াম কেরী ও তাঁর সহকারী পণ্ডিতগণ কোম্পানীর কর্মচারীদের ত্রদেশীয় ভাষায় শিক্ষাদানের জন্য যে পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন এতেই বাংলা গদ্যচর্চার সূত্রপাত। কিন্তু একান্তভাবে পাঠ্যপুস্তক বলে এই সকল গ্রন্থের প্রচার কলেজের বাহিরে তেমন ছিল না। ফলে বাংলা গদ্যের সংস্কারে এই সকল পাঠ্যপুস্তক বিশেষ সহায়তা করতে পারে নি।

এই সংস্কারের ভার নেয় সাময়িক পত্র। শিক্ষায়তনের পাঠসীমায় বাংলা গদ্যের যে প্রস্তুতির সূচনা হয়েছিল তা সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণতা অর্জন করিল।

বাংলা ভাষায় মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা ‘দিগ্‌দর্শন’ ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশনারীদের পরিচালনায় আত্মপ্রকাশ করে। জোশুয়া মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান ছিলেন এর সম্পাদক। দিগ্‌দর্শনের ভাষা ও বিষয়বস্তু বিদ্যালয়ে ব্যবহারের উপযোগী ছিল।

দিগ্‌দর্শনের প্রকাশের একমাস কালের মধ্যেই শ্রীরামপুর মিশন হতে ‘সমাচর দর্পণ’ নামে আর একখানি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। জে. সি. মার্শম্যান ছিলেন এর সম্পাদক। সমাচার দর্পণ একখানি উচ্চাঙ্গের সংবাদপত্র ছিল। সমকালীন বাংলা দেশের ভাষা-সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি সকল বিষয়েরই আলোচনা এতে স্থান পেত।

‘সমাচার দর্পণে’ হিন্দুবিরোধী প্রচারের প্রতিরোধকল্পে রামমোহন রায় প্রমুখ হিন্দুসমাজের কয়েকজন উৎসাহী নেতা ১৮২১ খ্ৰীঃ সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশ করেন। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এর অন্যতম প্রকাশক। সমাজসংস্কার বিষয়ে রামমোহন রায়ের সঙ্গে মতভেদ হওয়াতে ভবানীচরণ সম্বাদ কৌমুদী ছেড়ে দিতে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ নামে সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করেন। সম্বাদ কৌমুদীর একজন প্রধান লেখক ছিলেন রামমোহন। এই পত্রিকাতে সরল ভাষায় উপদেশাত্মক আখ্যান ও শিক্ষামূলক বিবিধ প্রসঙ্গ প্রকাশিত হত। এই আখ্যান ও প্রস্তাবগুলির, ভাষার ন্যায় সহজ ও সরল ভাষা এর পূর্বে দেখা যায় নি। যেমন—‘গ্রীকদেশে একজন পণ্ডিত অবিরোধে কালযাপন করত। এক সময় তিনি আপন মিত্রদিগের সহিত পথ ভ্রমণ করিতেছেন, ইত্যবকাশে এক ব্যক্তি গোঁয়ার আসিয়া তাঁহাকে পদাঘাত করিল। তাহাতে তিনি কিছুই উত্তর করিলেন না, ইহা দেখিয়া তাঁহার মিত্রেরা কহিল একি! আপনি ইহাকে যে কিছু কহিলেন না। পণ্ডিত কহিলেন যে, যদি কোন ব্যক্তি গৰ্দ্দভের নিকট যায় এবং সে গৰ্দ্দভ চাইট্ মারে তবে কি গৰ্দ্দভের নামে কেহ নালিশ করিয়া থাকে?”

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাহার সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকায় ‘কলিকাতা কমলালয়’, ‘নববাবুবিলাস’ ইত্যাদি ব্যঙ্গরচনার দ্বারা সেকালের ধনী রসিকদের মনোরঞ্জন করার প্রয়াস পান। এই সব রচনা ঊনবিংশ শতাব্দীতে সাহিত্যে রসসৃষ্টির একটা উল্লেখযোগ্য স্বাধীন প্রয়াস বলা যায়।

বাংলা ভাষায় অপর একখানি উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিক পত্রিকা হল ‘বঙ্গদূত’। নীলরতন হালদার ছিলেন এর সম্পাদক। তখনকার দিনের সংবাদপত্রসমূহ কি করে রাজনীতি-অর্থনীতি বিষয়ে ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠেন তার নিদর্শন পাই এই বঙ্গদূত পত্রিকায়।

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হয় ১৮৩১ খ্রীঃ। সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। এই ‘পত্রিকায় বহু কবি ও সাহিত্যিকের প্রথম উদ্যম প্রকাশিত হয়েছিল। পুরানো বাংলা কবির ও কাব্যের বিষয় গবেষণার সূত্রপাত করেন ঈশ্বরচন্দ্র সংবাদ প্রভাকরের পৃষ্ঠায়।”

সংবাদ প্রভাকরের পর জ্ঞানান্বেষণ, সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় ইত্যাদি পত্রিকাতেও গদ্যের ব্যাপকতর অনুশীলন চলতে থাকল।

ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্ররূপে ১৮৪৩ খ্রীঃ প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ বাংলা গদ্যের এবং সাহিত্যের ইতিহাসে নবযুগের সূচনা করে। ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্ররূপে প্রকাশিত হলেও এই পত্রিকায় ধর্ম ব্যাখ্যা ছাড়াও নীতিগৰ্ভ বিজ্ঞানবিষয়ক এবং অধ্যাত্মতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞানোদ্দীপক প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। সরল এবং সহজবোধ্য রচনাগুলি বাংলা গদ্যে সংযম ও দৃঢ়তা আনে। এই পত্রিকার প্রধান লেখক ছিলেন, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি। এই সব মনীষী লেখকদের রচনাসম্ভার বাংলা সাহিত্যে নব ঐশ্বর্যের যোগান দেয়।

সাময়িকপত্রের ক্ষেত্রে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা যে আদর্শ প্রবর্তন করে তাই পরবর্তীকালে বিবিধার্থ সংগ্রহ ও রহস্যসন্দর্ভ ইত্যাদি পত্রিকার মধ্য দিয়া বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শনে ও দ্বিজেন্দ্রনাথের ভারতীতে পরিণতি লাভ করে।

দেখা যাচ্ছে সংবাদপত্রের প্রবর্তনের পর হতেই বাংলা গদ্যের উন্নতির পথ অবাধ হল। কেননা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্য-পুস্তকের রচনার বিষয় ছিল নিতান্ত সীমাবদ্ধ। ফলে গদ্যের ব্যাপকতর চর্চার অবকাশ তাতে ছিল না। পক্ষান্তরে বিভিন্ন সাময়িকপত্রে স্থানলাভ করত বিভিন্ন বিষয়ের রচনা। বিষয়-বৈচিত্র্যের জন্য এর গদ্যভঙ্গিও বিচিত্রতর হইত। এইভাবে ব্যাপকতর ক্ষেত্রে গদ্যের অনুশীলন চলতে থাকে। সাধারণ পাঠকের উপযোগী সংবাদ ও সরস কাহিনী পরিবেশনের দ্বারাই সাময়িকপত্র সমসাময়িক বাংলা গদ্যের পঙ্গুত্ব দূর করে তাকে প্রতিদিনের কাজকর্মের উপযোগী এবং সর্বসাধারণের উপভোগ্য রস সৃষ্টির বাহন করে তোলে। প্রসঙ্গত জনৈক সুখীসমালোচকের মন্তব্য স্মরণ করা যাইতে পারে। “১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া প্রায় আজ অবধি দেখিতেছি যে বাংলা গদ্য সাহিত্য (এবং বাংলা আধুনিক সাহিত্য) প্রধানত সাময়িক পত্রিকার আশ্রয়েই বাড়িয়া উঠিয়াছে। বাংলা গদ্যের শ্রেষ্ঠ লেখকগণের বাহন হইয়াই সংবাদ প্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বিবিধার্থ সংগ্রহ, মাসিক পত্রিকা, সোমপ্রকাশ, বঙ্গ দর্শন, ভারতী, জ্ঞানাঙ্কুর, আর্যদর্শন, বান্ধব, নবজীবন, সাহিত্য, সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ ও সবুজপত্র ইত্যাদি নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হইয়াছে।”