ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত ইংরেজী বিদ্যার অধিকারী ছিলেন না, ইউরোপীয় সাহিত্যের যুগোচিত পাঠ তিনি লাভ করতে পারেন নি। কিন্তু তাঁর অন্যতম প্রধান শিষ্য রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজী বিদ্যায় সুশিক্ষিত ছিলেন। সেই বিদ্যার বলে তিনি ইউরোপীয় কাব্য সাহিত্য যথোচিত পরিমাণে অধিগত করেছিলেন।
ঈশ্বরগুপ্তে যুগে যে কাব্যধারা প্রবহমান ছিল, সেই পুরাতন রীতি তিনি পরিহার করলেন এবং বাংলা কাহিনী কাব্যে ইংরেজী কাহিনী কাব্যের রোম্যান্স রস যোগান দিয়ে নবযুগের দিকে বাংলা সাহিত্যের মুখ ফেরালেন, ঐতিহাসিক পটভূমিকায় স্বদেশ প্রেমকে স্থাপন করে ইংরেজী শিক্ষিত যুববৃন্দকে তার কাহিনীকাব্য ‘পদ্মিনী উপাখ্যানের প্রতি আকৃষ্ট করলেন। বাংলা কাব্য সাহিত্যে পুরাতনের অবসান হল, সূচনা হল নবযুগের রঙ্গ-লালের নব রোম্যান্টিক কবিত্ব প্রত্যুষান্ধকারে অকাল জাগ্রত একটি বিহঙ্গের কাকলির ন্যায় দ্বিধাগ্রস্ত।
তথাপি শেক্সপীয়ার স্কট বায়রণের এবং প্রধানত টমাস মূরের ছায়া প্রভাবিত পদ্মিনী উপখ্যানে শিক্ষিত বাঙালী আপনার মনের কোন কোন ভাবনাকে কতকটা বাঙ্ময় দেখে আশ্বস্ত হল। পুরাতন কাব্য রীতির অপসারণ এবং নতুন কবিতার উদ্ভাবনায় রঙ্গলালের বিশেষ ও প্রথম অবদানের জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি বৈশিষ্টের গৌরব লাভের যোগ্য, বাংলা কাব্য সাহিত্যের রঙ্গভূমিতে মধুসূদনের আবির্ভাবের পূর্বে তিনিই নান্দী গেয়েছিলেন।
রঙ্গলাল যেমন ইংরেজী ভাষায় সুশিক্ষিত তেমনি সংস্কৃত ভাষাতেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তিনি ‘ঋতুসংহার’ ও ‘কুমারসম্ভবে’র অনুবাদ করেছিলেন। বিভিন্ন সাময়িক পত্র-পত্রিকার সঙ্গে তাঁর ছিল ঘনিষ্ট যোগাযোগ। যোগ্যতার সঙ্গে কোন কোন পত্রপত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন। যেমন—‘সংবাদ প্রভাকর’।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর বিশেষ সমাদরের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডীর সম্পাদনা করেছিলেন। সমকালীন নব্য শিক্ষিত যুবকদের মতো জ্ঞানের সাধনায় তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল৷ পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাসের প্রতি তাঁর ছিল গভীর আকর্ষণ। ওড়িয়া ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গেও তার ছিল নিবিড় পরিচয়। ওড়িয়া সাহিত্যকে বাঙালীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রথম প্রয়াস তিনি করেছিলেন। প্রথম সাহিত্য সমালোচক রূপেও তাঁর কৃতিত্ব অগ্রগামী—যা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
মূলত ঈশ্বরগুপ্ত ও মধুসূদনের মধ্যে কবিত্বের সংযোগ বিন্দুতে রঙ্গলালের অবস্থান। সেই অর্থে আধুনিক আঙ্গিক ও আধুনিক মনোভাবের এক বিচিত্র সমন্বয় তাঁর কাব্যগুলির মধ্যে লক্ষিত হয়। ‘গুপ্তকবির’ সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার পৃষ্ঠায় রঙ্গলালের প্রথম মুদ্রিত আত্মপ্রকাশ, তাঁর আগেও তিনি কবিগানের বাঁধনদার ছিলেন বলে জানা যায়। তারপর একে একে তাঁর বাংলা কাব্য কবিতার জগতে অবতারণ।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা সমূহ :
‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম জীবনে লেখা ‘ভেক মুষিকের যুদ্ধ’। এরপর হোমারের নামে প্রচলিত ‘Batrachomyo machia ব্যঙ্গ কাব্যের অনুবাদ (১৮৫৮), ‘সংবাদ প্রভাকরে’ প্রকাশিত ‘পার্ণেল ও গোল্ড স্মিথের ‘হামিট’ কাব্যের অনুবাদ (১৮৫৮), পদ্মিনী উপন্যাস (১৮৫৮), কর্মদেবী (১৮৬২), শূরসুন্দরী (১৮৬৮), কুমারসম্ভব কাব্যের অংশ বিশেষ অনুবাদ (১৮৭২), ‘নীতি কুসুমাঞ্জলি’ নামে দুশ সংস্কৃত শ্লোকের (১৮৭৫), কাঞ্চী কাবেরী (১৮৭৯) ইত্যাদি।
পদ্মিনী উপাখ্যান: এ কাব্যের কাহিনীর উৎস, টডের ‘Annals and Anliquities of Rajasthan’. ইতিহাস প্রসিদ্ধ আলাউদ্দীন খিলজী কর্তৃক রাজস্থানের রাণা রতন সিংহের সুন্দরী স্ত্রী পদ্মাবতীকে অপহরণের কাহিনী দেশপ্রেমের ভঙ্গিতে এখানে বর্ণিত হয়েছে।
কর্মদেবী: যশল্পীর প্রদেশ শাসকের পুত্রর সাধুর দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার জন্য দুঃসাহসিক বীরত্বের রমণী এখানে আছে। কাহিনীর শেষ অংশে দেখা যায় কর্মদেবী তার বিজলী প্রণয়ার সঙ্গে সহমরণে মৃত্যুবরণ করেছেন। কাহিনী বীররস এবং রোমান্স ভাবনার পরিপূর্ণ।
শূরসুন্দরী: কাব্যটি রাজপুত বীরত্বের কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘মোঘল সম্রাট আকবরের হিন্দু নারী লোলুপতার কাহিনী এই কাব্যের প্রধান বিষয়। কাহিনীর শেষে হিন্দু নারীর সতীত্ব ও মর্যাদার জয় দেখানো হয়েছে।
কাঞ্চী কাবেরী: উড়িষ্যার রাজ কাহিনীর সঙ্গে লোক কাহিনীর সংমিশ্রণে এর কাব্য বিষয় পরিকল্পনা করা হয়েছে। উড়িষ্যারাজ পুরুষোত্তমের সঙ্গে কাঞ্চীরাজের বিবাদ হয়, কাঞ্চীরাজ কন্যার হস্তান্তর এবং পুরুষোত্তমের হাতে লাঞ্ছনা ঘটে এবং শেষে বিবাহের মধ্য দিয়ে দুই রাজার বিবাদের নিষ্পত্তি হয়।
নীতি কুসুমাঞ্জলি : সংস্কৃতি নীতি ও তত্ত্বমূলক উদ্ভট কবিতার অনুবাদে রঙ্গলাল কিছুটা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ; যেমন—
“গ্রন্থগতবিদ্যা, পরহস্তগত ধন।
নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।।”
কিংবা,
মাতা নিন্দা পরায়ণ পিতা প্রিয়বাদী নন
‘সোদর না করে সম্ভাষণ।
ভৃত্য রাগে কহে কত পুত্র নহে অনুগত
কাস্তা নাহি দেন আলিঙ্গন।।
পাছে কিছু চাহে ধন এই ভয়ে বন্ধুগণ
কিছুমাত্র কথা নাহি কয়।
ওরে ভাই এ কারণ কর ধন উপার্জন
ধনেতেই সব বশ হয়।।
কাব্য কবিতায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-এর অবদান:
১। বাংলা কাব্যে তিনি প্রথম স্বদেশ প্রেম নির্ভর আখ্যান কাব্য ও জাতীয় ক্ষুদ্র কবিতা রচনার সূত্রপাত করেন। ইতিহাস কাহিনীর আশ্রয়ে নিসর্গ বর্ণনা এবং রোমান্টিক দেশপ্রেম তাঁর কাব্য পংক্তির মধ্যে রোমাঞ্চরূপে পরিগ্রহ করে। প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের রোমাঞ্চ নির্ভর স্বদেশ চেতনা প্রকাশেও হয়তো তা প্রেরণার কাজ করেছিল।
২। মধুসূদনের উপমালঙ্কার রীতি, সর্গ বিন্যস্ত কাব্য রচনা পদ্ধতি রঙ্গলাল যেমন গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি রঙ্গলালের পদ্মিনী অবিসংবাদিতভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল প্রমীলার মধ্যে।
৩। অনুবাদ কাব্য বা কবিতা রচনার ক্ষেত্রে রঙ্গলালের প্রয়াস সংস্কৃত কবি কালিদাস থেকে শুরু করে ওড়িয়া কবি দীনকৃষ্ণদাস, উপেন্দ্রভঞ্জ, এমন কি ওমর খৈয়াম পর্যন্ত প্রাদেশিক বা বিজাতীয় কবির কাব্যের অনুবাদ বাংলা কাব্যের অনুবাদ শাখার ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেছিল।
উপরিউক্ত অবদান সত্ত্বেও বলা যায় রঙ্গলাল আখ্যান কাব্য রচনার কাঠামো তৈরী করেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। কাব্য প্রকরণে বিদেশী কবিদের অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের ভাবধারাকে আত্মস্থ করতে পারেন নি। অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা Blank verse এর সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছিলেন কিন্তু লোকপ্রবাদের ভয়ে তা অভ্যাস করতে পারেননি বলে মধুসুদনের কাছে স্বীকার করেছিলেন।
তবুও বলতে হয়, রঙ্গলাল বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম আধুনিক ভাবের সূচনা করেছিলেন। যে ইতিহাস স্বদেশ প্রেমের পরিপোষক, তিনি ইতিহাসের সেই সমস্ত ঘটনা অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছিলেন। ফলে বাংলা কাব্যের নতুন পথে যাত্রা সম্ভব হয়েছিল। অবশ্য পাশ্চাত্য কাব্যের খোলা হাওয়াই তাঁকে বাইরের আকাশের জন্য উতলা করেছিল। কিন্তু কাব্যের বিষয় পরিবর্তনের দিকেই তিনি সচেতন ছিলেন। তাই পুরাতন ছন্দেও সংস্কৃত ঘেঁষা অলঙ্কারে কাব্যলক্ষ্মীর প্রসাধন নির্মাণ করতে গিয়েছিলেন।
মাইকেল মধুসূদন যেমন দিগ্দাহ সৃষ্টি করেছিলেন—জীর্ণ মুমুধুঁকে উড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমের খেয়া তরী বেয়ে বাংলা সাহিত্যের নদী তটে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, রঙ্গলালের সে শক্তি ছিল না। তবু তিনি মাইকেলের পূর্বে কিঞ্চিৎ নিম্নস্বরে নবজীবনের মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না।
Leave a comment