১৯৭৭ খ্রীঃ কিশোর রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীর প্রেরণায় প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন ‘করুণা’। প্রায় বছর খানেক ধরে ‘ভারতী’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়। তবে স্বয়ং লেখক এর প্রতি কোন গুরুত্ব দিয়ে গ্রন্থভুক্ত করেননি। পরবর্তী কয়েকটি মাত্র উপন্যাস গ্রন্থগৌরব লাভ করেছে।
বিষয়—বৈচিত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্র উপন্যাসগুলিকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে—
রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস:
কালগত বিচারে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস ঊনবিংশ শতকের বাংলা উপন্যাস ধারার অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্টিক উপন্যাস রচনার পূর্বসূরী বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই খুব সম্ভবত তাঁর প্রেরণা লাভ। কিন্তু দৃষ্টিকোণে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য মেরুপ্রমাণ। ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে ইতিহাসের অংশটি হল রাজা প্রতাপাদিত্যের কাহিনী। তবে প্রতাপের পিতৃব্য বসন্ত রায়, পুত্র উদয়াদিত্য এবং কন্যা বিভা-র অনৈতিহাসিক কাহিনী অংশই প্রধান। প্রতাপের নির্মাণ অমানবিক আচরণে কিভাবে অন্তঃপুরের শাস্তি ধ্বংস হল, ছেলে-মেয়ের জীবনে বিপর্যয় ঘটল, পিতৃব্য নিহত হলেন, সেই বেদনাময় করুণ কাহিনী এই উপন্যাসের উপজীব্য কাহিনী বয়নে ও চরিত্র-চিত্রণে পরিণত প্রতিভার অভাব সুস্পষ্ট।
‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ অপেক্ষা ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি অনেক পরিণত ও শিল্পগুণান্বিত রচনা। এই উপন্যাসের কাহিনীর উৎস, ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস উপন্যাসের পটভূমি ত্রিপুরা উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজা গোবিন্দমাণিক্য ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে বলিদান বন্ধ করে দেওয়ায় রাজা ও পুরোহিত রঘুপতির মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে। রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায় রঘুনাথের পক্ষে যোগ দিলে দ্বন্দ্ব জটিল হয়ে ওঠে। শেষে রঘুপতির পালিত পুত্র জয়সিংহের আত্মদানে এই বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে।
রবীন্দ্রনাথের সামাজিক উপন্যাস:
ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি প্রতিভার বিশেষত্ব ‘চোখের বালি’ উপন্যাস থেকেই সাধারণভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। ক্ষয়িষ্ণু সামন্তসমাজ আর বিবর্ণ নব্য ধনবাদী সমাজ কাঠামোর মধ্যে এর ‘থীম’ বা ভাবরূপটি মূর্ত। তাই নিঃসঙ্গ বিনোদিণীর বহুভুজ মানসিক জটিলতা, আশার সীমিত ব্যক্তিত্বের জড়তা, মহেন্দ্রের অবিবেকী অধিকারবোধ, বিহারীর হৃদয় সংযম ও নির্মম সততায় সজ্জিত এই উপন্যাসের বিষয় গৌরব পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলিকে অনায়াসে অতিক্রম করে গেল।
‘চোখের বালি’-র পরবর্তী উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’। নৌকাডুবির ফলে রমেশ নামে এক অপরিচিত যুবক এবং এক সদ্য বিবাহিতা নারী কমলা কোনক্রমে রক্ষা পায়। প্রকৃতপক্ষে, রমেশ নয়, কমলার আসল স্বামী ছিল নলিনাক্ষ। রমেশ ও কমলা নয়, ছিল হেমনলিনীর প্রতি আসক্ত কিন্তু উপযুক্ত সম্ভাবনা সত্ত্বেও দুই পুরুষকে কেন্দ্র করে এক নারী মনে (কমলা) অথবা দুই নারীকে কেন্দ্র করে এক পুরুষ মনে (রমেশ) যে জটিল অন্তর্দ্বন্দ্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল এখানে তা দেখা যায়নি। বহু সমালোচকের মতে ‘নৌকাডুবি’ রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতম রচনা।
‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত (১৩৩৪-৩৫ বঙ্গাব্দ) প্রথমে “তিনপুরুষ” নামে পরে “যোগাযোগ” নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়। হয়ত লেখকের ইচ্ছা ছিল তিনপুরুষের জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু এক পুরুষের কাহিনী রচিত হয়। উপন্যাসের মূল আকর্ষণ কুমুদিনী বা কুমু। যার চেহারা কবির ভাষায়—“যেন রজনীগন্ধার পুষ্পদণ্ড, চোখ বড়ো না হোক একেবারে ‘নিবিড়’ কালো, আর নাকটি নিখুঁত রেখায় যেন ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরী। রঙ শাঁখের মতো চিকন গৌর; নিটোল দুখানি হাত; সে হাতের সেবা কমলার বরদান, কৃতজ্ঞ হয়ে গ্রহণ করতে হয়’” বনেদী অভিজাত এবং সংস্কৃতি ও সুশিক্ষায় মার্জিত দাদা বিপ্রদাসের শিক্ষায় ও স্নেহচ্ছায়ায় সে লালিত। এহেন সুকুমার মন ও দেহ সৌন্দর্যের অধিকারী কুমুর বিয়ে হল ‘স্থল’ রুচির বিত্তবান পুরুষ মধুসূদনের সঙ্গে। তার সর্বগ্রাসী প্রভুত্ব ও বিত্তের অহমিকায় বিরক্ত ক্লান্ত কুমু যখন স্বামী-স্ত্রীর যান্ত্রিক সম্পর্ক ছেদ করতে চাইছে, তখন জানল সে সন্তানসম্ভবা। সনাতন সমাজ ও পাঠকের উদ্দেশে ছুঁড়ে ছিল তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন : উপন্যাসের প্রধান অংশ এই কুমুর মানসিক সংগ্রামের তথা মনোবিশ্লেষণের বিবরণ। পটভূমির বিশালতা এবং শিল্পনৈপুণ্যের বিচারে ‘যোগাযোগ’ বাংলা উপন্যাসে এক নতুন সংযোজন।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চেতনামূলক উপন্যাস:
স্বদেশচেতনার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে ‘গোরা’ উপন্যাসে। স্বদেশের প্রকৃত স্বরাপ জানবার জন্য গোরা ছিল আগ্রহী। প্রথমদিকে সে ছিল নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু, অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের হাতে জলপানে পর্যন্ত অনিচ্ছুক। কিন্তু একদিন ঘটনাক্রমে সে জানতে পারে, সে জাতে আইরিশ; মিউটিনির সময়ে তার জন্ম, কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর ঘরে সে পালিত পুত্র মাত্র। এই সংবাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় তার রক্ষণশীল ভাবনার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে। শুধু তাই নয়, গোরার মাধ্যমে তার স্রষ্টা দেখিয়েছেন তার দেশপ্রীতি কতটা খাঁটি।
রবীন্দ্রনাথের এই স্বদেশ জিজ্ঞাসার ভিন্নতর রূপ মূর্ত হয়েছে ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘চার অধ্যায়ে। প্রথমটিতে আছে বয়কট—আন্দোলনের নামে জাতীয় উন্মাদনার মত্ততার চিত্ররূপ। মানুষের স্থির বিচারদৃষ্টিকে আবিল করে তার ধ্রুব কল্যাণ বুদ্ধিকে ধ্বংস করে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়কে সংঘাতের পথে প্ররোচিত করা এবং গৃহের শান্তি বিনষ্ট করার জলন্ত ইঙ্গিত, দ্বিতীয়টিতে আছে স্বভাবধর্ম উপেক্ষা করে সন্ত্রাসবাদে আত্মদানের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী, ‘ঘরে বাইরে তে বিমলা এবং ‘চার অধ্যায়ে’ এলার জীবন বিপর্যয়ে মনুষ্যত্ব ও ন্যায়নীতি বিরোধী রাজনৈতিক প্রমত্ততার ভয়াবহ দিকটি নির্দেশিত হয়েছে। দুটি উপন্যাসই আবেগধর্মী বক্তব্যে পূর্ণ। কিন্তু এই বক্তব্য পর একসময় যথেষ্ট সমালোচনা ও বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক উপন্যাস:
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত উপন্যাসই কবির কলমে লেখা তা অল্পবিস্তর রোমান্টিক। তবু ‘চতুরঙ্গ’ এবং ‘শেষের কবিতা’ এ ব্যাপারে অনন্য। ‘চতুরঙ্গ’ অখণ্ড জীবনরূপের যেন চারটি অঙ্গের কাহিনী। এই চারটি অঙ্গের এক একটির নামপরিচয় : জ্যাঠামশায় শচীশ দামিনী শ্রীবিলাস। এরা প্রত্যেকেই অন্তর্মগ্ন ভাষায় (চেতনাপ্রবাহ রীতি?) নিজের মনোবিশ্লেষণ করেছে। এইভাবে জ্যাঠামশায়ের ধর্ম, শচীশের প্রেম, দামিনীর উত্তাপ, শ্রীবিলাসের নিষ্ঠা এই উপন্যাসের কাহিনী গ্রন্থনে সহায়তা করে পরস্পরের ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র রচনা করেছে। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে চরিত্রগুলির জীবন সত্য অন্বেষণের প্রচেষ্টা এক নূতন আঙ্গিকে দেখা দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যোপম উপন্যাস:
শেষের কবিতা’র নায়ক অমিত প্রাণপ্রাচুর্যে উচ্ছল। জীবনরসে উদ্দীপ্ত, বুদ্ধিবাদের উজ্জ্বলতায় অনন্য। এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হওয়ার কারণ—
-
(ক) এর অনন্যসাধারণ কাব্যময় ভাষা, epigram ও wit দর চমক যার অজস্র দৃষ্টান্ত পাঠককে মুগ্ধ করে
-
(খ) রবীন্দ্রনাথের প্রেম-সম্পর্কিত ধারণার প্রায় অভিনব ও পূর্ণায়ত প্রকাশ ।
-
(গ) কল্লোল গোষ্ঠীর তরুণ কবিদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়ার প্রায় প্রেমমূর্তি। ‘দুইবোন’ গল্পের আঙ্গিকে লেখা, এখানে নায়ক আদিত্যকে কেন্দ্র করে নীরজা ও স্মরণাপন্ন প্রণয় দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কাহিনীর শেষে রুগ্না নীরজার বেদনাবিধুর চিত্র মুখে (রবি ঠাকুরের সঙ্গে নিবারণ চক্রবর্তীর তুলনা) এবং প্রেমমূলক উপন্যাস রচনায় তার অদ্বিতীয় ক্ষমতার প্রমাণ দেওয়া।
-
(ঘ) উপন্যাসের প্রচলিত আঙ্গিক কাঠামো ভেঙে নতুন রীতিতে কাহিনী কথনের পরীক্ষাদান।
‘দুইবোন’ উপন্যাস জীবনের দুই প্রান্তের আদর্শ পুত্তলি শর্মিলা এবং উর্মিমালা। শশাঙ্কের জীবনকে কেন্দ্র করেই তাদের আত্মপ্রকাশ ও ছায়াবিস্তার একজন খর গ্রীষ্মে ক্লান্তি হরণের স্নেহছায়া দেয়। অন্যজন ‘গোধুলিলগ্নের’ রোমান্টিক আলো-আঁধারী ছড়ায়। একজনের আছে মমতা, অন্যের মধ্যে প্রেমমূর্তি। ‘দুইবোন’ গল্পের আঙ্গিকে লেখা, এখানে উপন্যাসের জীবন— বিস্তার, চরিত্র সমারোহ ততটা নেই। এই বইয়ের সমস্যাকেই উল্টো ভাবে দেখানো হয়েছে ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে। এখানে নায়ক আদিত্যকে কেন্দ্র করে নীরজা ও সরলার প্রণয় দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কাহিনীর শেষে ‘রুগ্না নীরজার বেদনাবিধুর চিত্র প্রেমের মালঞ্চে ট্র্যাজেডির দীর্ঘশ্বাসকে ঘনীভূত করেছে। এখানেও গল্পের আঙ্গিকের কাহিনীরূপ নিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের ভাষাশৈলী:
রবীন্দ্র উপন্যাসের ভাষাশৈলী বাংলা সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ। প্রথম দিকের ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ ও ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের ভাষায় সাধু গদ্যের প্রকৃতি অনেক পরিণামে বঙ্কিমী গদ্যের চালে বিন্যস্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে কিন্তু তার বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখা দেয় এই পরিবর্তন শুরু হয় ‘ঘরে বাইরে’ থেকে। যেমন :
‘একজন অশ্বারোহী পুরুষ নিকটে আসিয়া কহিল, আহ, বাঁচিলাম।
দাদামহাশয় পথের ধারে এত রাত্রে কাহাকে গান শুনাইতেছ?”
“তুমি একবার বিশ্বের মাঝখানে এসে সমস্ত আপনি বুঝে নাও। এই ঘরগড়া ফাঁকির মধ্যে কেবলমাত্র ঘরকরনাটুকু করে যাওয়ার জন্যে তুমিও হওনি, আমিও হইনি সত্যের মধ্যে আমাদের পরিচয় যদি পাকান হয় তবেই আমাদের ভালোবাসা সার্থক হবে।” (‘ঘরে বাইরে’) এখানে দুই ভাষারীতি এবং ভঙ্গিমার মধ্যে রচনারীতির পরিবর্তন কোনমতেই দৃষ্টি এড়ায় না।
Leave a comment