‘লেখা থেকে লেখকের ব্যক্তিগত চরিত্র বা রুচি সম্বন্ধে কোন ধারণা করে নেওয়া ভুল জানি : কিন্তু আবার না করেও পারি না।” “এই মন্তব্য করেছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী ‘বনফুল’ আলোচ্য প্রসঙ্গে। যাই হোক আধুনিক উপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ী বৈচিত্র্যময় এবং তার জীবন আলোকে তাঁর উপন্যাসগুলি উদ্ভাসিত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপত্তি : সতীনাথ নিজেকে সাহিত্যিক বলে মনে করতেন, নিজেকেই বলতেন পাঠক। বহু বিষয়ে তার জানার আগ্রহ ছিল এবং তিনি একই সঙ্গে সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি বহু বিষয়ে (তিনি) আকর্ষণ অনুভব করেছেন। তিনি কয়েকটি ভারতীয় ভাষা বিদেশী ভাষার ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দী, উর্দু এবং ফার্সী। ফরাসী ভাষা তিনি বিশেষ ভাবে আয়ত্ত করেছিলেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা বিশেষ করে মূল পর্যায়ে তার আংশিক দক্ষতা ছিল। এছাড়া চিরকুমার সতীনাথের পেশা ছিল বই এবং ফুলের বাগান।

সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্ম:

সতীনাথ ভাদুড়ী পূর্ণিয়া ইষ্টবাজারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে তিনি অর্থনীতিতে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়েন। ১৯৩২-৩৯ পর্যন্ত তিনি তার পিতা ইন্দ্র ভূষণের মতো আইন ব্যবসায়ে যোগ দান করেন।

সতীনাথ ভাদুড়ীর কর্মস্থান:

১৯৩৯ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে যোগদান করেন এবং বৈদ্যনাথ চৌধুরী টীকাকোক্তি আশ্রমে যোগদান করেন। নয় বছরে তিনি তিনবার কারাবরণ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের সভাপতি হয়েছিলেন কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই কংগ্রেসী রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। যখন ১৯৪৮ সালে পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের অবনতি হয়েছিল সেই সময় সতীনাথ পদত্যাগ করেন। কংগ্রেস ত্যাগের তিন মাসের পর স্বেচ্ছায় কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে তিনি নিজেকে নিযুক্ত করলেন, এখানেও তিনি বেশী দিন থাকতে পারেননি। কারণ এই দেশের বিত্তবান জমিদারদের প্রভাব দেখে তিনি ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন।

সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস:

ব্যক্তিগত জীবনে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছিল বিভিন্ন উপন্যাসে এবং এ বিষয়ে তার ‘জাগরী’, ‘হিসাবী নায়ক’ এবং ‘বোরাহ চরিত মানস’ প্রভৃতি উপন্যাসের কথা স্মরণ করতে হয়। জাগরী উপন্যাসে মধ্যবিত্ত মানুষের রাজনৈতিক সত্যের অনুসন্ধান এবং ঢোরাই চরিত ‘মানস অন্ত’ ও অস্পৃশ্য ভারতের চিত্ত জাগরণের ইতিহাস। অপর একটি উপন্যাস চিত্রগুপ্তের ভাই।’ সেখানে সতীনাথ শ্রমিক সংগঠনী রাজনীতির কাহিনী পরিবেশন করেছেন। প্রসঙ্গত স্মরণীয় রাজনৈতিক উপাদান থাকলেও এই উপন্যাসগুলির গঠন কৌশলও বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য এই—তার অন্য চারটি উপন্যাস হল ‘সংকট’ ‘অচিন রাগিনী’, ‘দিক ভ্রান্ত’, এবং ‘সঙ্গী’ ভ্রমণ কাহিনী অচিন রাগিনী মূলত মনস্তাত্ত্বিক, কিন্তু এখানে একটি কাহিনী বা ঘটনা অনুপস্থিত নন সংকট উপন্যাসে কোন দৃঢ় পিনদ্ধ কে’ন প্লট পাওয়া যায় না। এখানে ঔপন্যাসিক মানুষের জীবনের কয়েকটি চরম মুহূর্তের অনুপম বিশ্লেষণ করেছেন।

ঢোরাই চরিত মানস: ঢোরাই চরিত মানসে সতীনাথ বস্তুনিষ্ঠ। সে সক্রিয়তা প্রকাশ করেছেন অবলীলাক্রমে সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির সহায়তায় একটি গোষ্ঠী জীবনের মধ্যে তাদের প্রবাদ প্রবচন থাকার দৃষ্টি ভঙ্গিমা নীতিবোধ সংস্কার আচার আচরণ সব কিছুর মধ্যে দিয়ে অনবদ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ঢোরাই সতীনাথের সর্বপ্রথম উপন্যাস। বাংলা ভাষার এর কোনও সমগোত্রীয় নেই। বিহার প্রদেশে চীরানীয়া গ্রামে অন্তগোষ্ঠী মানুষেরা এর প্রধান পাত্রপাত্রী যদিও এই উপন্যাসটির বৈশিষ্ট্য আঞ্চলিকতা তবুও এর কথাতে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ উপস্থিত রয়েছে। গোষ্ঠীর নায়ক চোরাই দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং সেই সঙ্গে ‘ভারতবর্ষে’র গ্রামীণ অন্যান্য মানুষের উন্নতির কথা ভেবেছিলেন। এই উপন্যাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিয়াল্লিশের ভারত ছাড় আন্দোলন। যাইহোক পঞ্চায়েতের সঙ্গে বিরোধিতা করে ঢোরাই সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। আগষ্ট আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাজনীতিবিদদের মিথ্যাচার তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং নব জীবন বোধের তাড়নায় সে শেষ পর্যন্ত নূতনতর পথে যাত্রার ইঙ্গিত দিয়ে যায় এবং এখানেই উপন্যাসের শেষ।

‘জাগরী’ উপন্যাসে কেবলমাত্র একটি, রাত্রিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এবং এখানে চেতনামূলক প্রবাদই উপন্যাসের ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘বিলু’, আগষ্ট আন্দোলনের ফাসীর আসামী। ফাসীর পূর্ববর্তী রাত্রে সারাজীবনের কাজের হিসাব নিকাশ করা হয়েছে চারটি অধ্যায়ে।

১। ফাসী সেল ২। আপার ডিভিশন অফার্ড ৩। আওরাত কিতা ৪। জেল গেট, দাগরী স্মৃতি চারণের ইতিবৃত্ত এবং এই উপন্যাসটি গ্রহণীয়র দিক থেকে বা আঙ্গিকগত দিক থেকে অভিনবত্বের দাবী করতে পারে। অপরদিকে ঢোরাই চরিত মানসে এ ধরনের আঙ্গিকগত অভিনব উপস্থিত না থাকলেও নানা কারণে বিশিষ্টতা লাভ করেছে। ঢোরাই চরিত মানসকে সতীনাথ তুলসী দাসের রামচরিত মানসের আদর্শে সাজিয়েছেন। নচেৎ বা কাহিনী কথনের ভঙ্গী লক্ষ্য করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপন্যাসে তুলসী দাসের রামায়ণে প্রায় সব কটি সৃক্তি উপন্যাসিক উপস্থিত করেছেন।

‘জাগরী’ উপন্যাসে কংগ্রেস কমিউনিষ্ট পদের সংঘাতকে উপজীব্য করে কাহিনী রচনা করেছেন। ঢোরাই-এর রাজনীতি সম্পূর্ণ অন্যপথে অগ্রসর হয়েছে। জাগরী ও ঢোরাই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বেকার কাহিনী আর চিত্রগুপ্তের ভাই স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরবর্তীকালের কাহিনী।

সতীনাথের শেষ পর্যায়ের রচিত অচীন রাগিনী যথার্থ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস।

জাগরী সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস। রাজনীতির মধ্যেই চরিত্রগুলির পূর্ণ রূপ লাভ করেছে। পূর্ণিমা প্রবাসী একটি বাঙালী পরিবারকে কেন্দ্র করে সতীনাথ ১৯৪২ সালের আগষ্ট আন্দোলনে এক বিশ্বস্ত রূপ তুলে ধরেছেন। ‘জাগরী’ নিঃসন্দেহে তার একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

ঢোরাই চরিত (প্রথম চরম খণ্ড ১৩৯৬ দ্বিতীয় চরম খণ্ড ১৩৫৮) রাজনৈতিক চেতনার সুন্দর এবং স্বাভাবিক প্রকাশ। এই উপন্যাস জীবন যুদ্ধের প্রয়োজনের আর্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার জন্যে চিত্রিত হয়েছে। গান্ধী ভাবনা পুষ্ট রাজনৈতিক আন্দোলন সমাজের অন্তঃশ্রেণীর মানুষদের কেমন করে স্পর্শ করেছিল। তারই পরিচয় পাওয়া যায়। তাত্মার্কগুলি ঢোরাইকে কেন্দ্র করে বিহারের রাজসমাজের—জাতিভেদ গোষ্ঠীকলহ সামন্ত তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শোষণ, সরকারী আমলা আইন আদালতে পুলিশের ভূমিকা পুলিশ ও কৃষকদের অবস্থা এই উপন্যাসে অনবদ্ধভাবে চিত্রিত হয়েছে। রাজনৈতিক বাহবা পুষ্ট আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এমন বিস্তৃতি জীবন্ত উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যে বিরল। বিশেষ ভাবে এই উপন্যাসে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস কুসংস্কার তাদের ভাষা প্রবাদ প্রবচন প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে এই উপন্যাসটিকে একটি বিচিত্র আঞ্চলিক উপন্যাসের মর্যাদা দান করেছিল।

সতীনাথ ভাদুড়ীর ছোটগল্পের সংখ্যা মোট প্রায় ৬০টি। এই গল্পগুলি ৬টি সংকলন গ্রন্থের হিসাবে প্রকাশ পায়। গণ নারায়ণ / চিত্রগুপ্তের ভাই / অপরিচিতা / চকাচকি / “গল্পলেখার বা”/ যমযমী / আলোক দৃষ্টি রচনাকাল ১৯৪৮-৬৪ এর মধ্যে।

ঔপন্যাসিক হিসাবে সতীনাথ যতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ছোট গল্পকার হিসাবে ততটা নয়। তার গল্পগুলির পাত্রপাত্রী ও ভৌগোলিক অবস্থান বাঙালী পাঠকের কাছে বিশেষ পরিচিত ছিল না। বাঙালী পাঠক খুব সম্ভবত বিহারের গ্রাম জীবনের ছাপ গ্রহণ করতে পারেননি। সতীনাথ ভাদুড়ীর গল্পে বাঙালী থাকলেও নিঃসন্দেহে তার প্রবাসী বাঙালী।

‘গণনারায়ণ’ সতীনাথের প্রথম গল্প, এই গল্পটি তার রাজনৈতিক ভাবনার ফল এবং জাগরী উপন্যাসের রাজনৈতিক ভাবনার পরিশিষ্ট বলা যায়। গল্পটি ব্যঙ্গাত্মক দেশ বিভাগের ফলে প্রকৃতপক্ষে কারা লাভবান হলেন সেকথা গণনারায়ণ গল্পটিতে লেখক স্পষ্ট করে বলেছিলেন। ‘বন্যা’ গণনারায়ণের সমগোত্রীয় রচনা। এই গল্পের পাত্রপাত্রীরা কাশী নদীর বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাময়িক ভাবে মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ সোপানে উঠেছিল। বন্যা শেষে আবার পূর্বেকার ক্ষুদ্রতায় তারা নিমজ্জিত হল।

“দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আয়কর বাংলা গল্প উপন্যাসও হয়। কাহিনী কাল দীর্ঘ সময় ব্যাপী। বহু চরিত্র বহু ঘটনা— আবেদন রোমান্টিক। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং চাষীদের সহনশীলতার চিত্র এখানে পরিবেশিত হয়েছে। ‘অপরিচিতা’ বিদেশের পটভূমিতে লেখা গল্প। সত্যি ভ্রমণ কাহিনী উপন্যাসটির সঙ্গে এই গল্পে খানিকটা মিল রয়েছে। ‘ইর্ষা’ গল্পটি কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক মূলক। অবিবাহিত এক যুবক তার বৃদ্ধ এবং মৃত্যু এই গল্পের বিষয় বাংলাদেশের পটভূমিকায় রচিত ‘দৃশ্যপুরি’ নৈহাটির সুরথবাবু এবং তার উচ্চ শিক্ষিতা ও অসুন্দরী মেয়ে ‘রেখার’ জীবনের কাহিনী পিতা ও কন্যার মনস্তত্ত্ব এখানে সতীনাথ সুন্দর ভাবে পরিস্ফুট করেছেন।