নায়ক বা নায়িকার প্রিয় মিলনের উদ্দেশ্যে সঙ্কেতস্থানে গমনকে অভিসার বলা হয়। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে ত্রয়োদশ প্রকার নায়ক নায়িকার কথা বলা হয়েছে, -এদের প্রত্যেকের আটটি – অবস্থা এবং প্রবং প্রথমটিই অভিসারিকা। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তে অভিসারিকার লক্ষণ বলা হয়েছে

‘যাভিসরতে কাস্তং স্বয়ং বাভিসরত্যপি। 

সা জ্যোত্রী তামসী যানযোগ্যবেশাভিসারিকা।।

লজ্জয়া স্বাঙ্গলীনেব নিঃশব্দাখিলমণ্ডনা।

কৃতাবগুণ্ঠা স্নিগ্ধেকসখীযুক্ত প্রিয়ং ব্রজে।।

অর্থাৎ যে নায়িকা কান্তকে অভিসার করান বা স্বয়ং অভিসার করেন, তাকেই বলে অভিসারিকা। জ্যোত্রী এবং তামসীভেদে ইনি দ্বিবিধা। এই নায়িকা কাস্তুসমীপে গমনকালে লজ্জায় যেন স্বীয় অঙ্গে লীন হয়ে থাকেন, এঁর কঙ্কণকিঙ্কিণি ও নূপুরাদি-ভূষণ নিঃশব্দ থাকে, অবগুণ্ঠনবর্তী হয়ে ইনি স্নেহপরায়ণা একটিমাত্র সখীর সঙ্গে অভিসার করেন।

অবশ্য বৈষ্ণব পদে অভিসারিকার এই দুটি মাত্র রূপই নয়, রূপ আরও আছে। বৈষ্ণব পদকর্তাগণ অদ্ভুত অষ্টবিধ অভিসারের পদ রচনা করেছেন, এদের মধ্যে আছে – জ্যোৎস্নাভিসার, – তামসী অভিসার, বর্ষাভিসার, দিবাভিসার, কুঞ্ঝটিকাভিসার, উন্মত্তাভিসার ও সঞ্চরাভিসার।

‘উজ্জ্বলনীলমণি’র সংজ্ঞামতে নায়িকা নায়ককেও অভিসার করাতে পারেন কিন্তু এর তত প্রসিদ্ধি ও ব্যাপকতা নেই। পদাবলী সাহিত্যে অবশ্য কৃষ্ণেরও অভিসার আছে। এইদিক থেকে ইউরোপীয় সাহিত্যের serenade এর সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। Serenade বলা হয় পুরুষের অভিসারকেই।

প্রেমের মধ্যে যে ত্যাগের অমোঘ বীর্য নিহিত আছে তার বলেই প্রেমাস্পদের জন্যে নায়িকার সর্বপ্রকার দুঃখক্লেশ বরণের শক্তি জন্মায়। প্রেমের জন্য এই স্বার্থত্যাগ এবং কষ্টস্বীকার পদাবলী সাহিত্যেরই শুধু সম্পদ নয়, এর পেছনে রয়েছে প্রাচীন ভারতীয় মহান ঐতিহ্য। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে ‘উমা’ এবং ‘কাদম্বরী’ কাব্যের ‘মহাশ্বেতা’ও দুঃখের দহনে নিজেদের অগ্নিশুদ্ধ করে নিয়েছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবতের ‘রাস পঞ্চাধ্যায়ে’ কৃষ্ণের অনঙ্গবর্ধন গীতধ্বনি শুনে মুগ্ধা গোপীগণ লোকলজ্জাভয় তুচ্ছ করে দয়িতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। বাংলা পদাবলী সাহিত্যের অভিসার এর মূল এখানেই নিহিত থাকতে পারে। অবশ্য বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে অভিসারিকা-রূপিণী নায়িকাব স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু তারও আগে বৈষ্ণব পদাবলীর পুরোধা জয়দেব গোস্বামী ‘গীতগোবিন্দে’র—

‘রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্। 

ন কুরু নিতম্বিনী গমনবিলম্বনমনুসর ত্বং হৃদয়েশম্।।

এর মধ্যেও অভিসারের বীজ পাওয়া যায়।

অভিসারের সঙ্গে মানবজীবনের একটি গভীর যোগ লক্ষ্য করা যায়। রাধার অভিসার আর জীবন-যন্ত্রণায় বিদ্ধ সাধারণ মানুষের কোনো অনির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় কেবলি এগিয়ে চলার মধ্যে একটা সঙ্গতি বর্তমান রয়েছে। ব্যাকুল প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে সুদুরকে নিকটে পাওয়া কিম্বা অসীম রহস্যলোকের সঙ্গে নিজেকে বিলীন করার তীব্র গতিবেগ এও যেন এক অভিসার। এইদিক থেকে বিচার করলে ‘অভিসার’ এর একটা আধ্যাত্মিক গৌরবও স্বীকার করতে হয়। অবশ্য সামগ্রিকভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মূল তত্ত্বের মধ্যেই অনুরূপ একটা অভিসারের ব্যাপার রয়েছে। সেখানেও জীবাত্মা অর্থাৎ আরাধিকা জীবনব্যাপী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরমাত্মা অর্থাৎ কর্ষণকারী কৃষ্ণের প্রতি অগ্রসর হচ্ছেন। এই প্রচেষ্টাই অর্থাৎ অনবরত এগিয়ে চলাই জীবন-এর সমাপ্তি অর্থাৎ মিলন আর জীবনকালে সম্ভব নয়। এটিকে রূপক রূপ গ্রহণ করলেও নায়িকার অভিসারটিকে রূপক বলে গ্রহণ করা যায় না, এর একটা বাস্তব রূপ আছে। সেখানে প্রকৃতই একটা অনির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় নায়িকা দুর্গম পথের মধ্য দিয়ে শুধুই এগিয়ে চলে, কিন্তু অপ্রাপ্য আর হাতের নাগালে এসে পৌঁছায় না। ফলত একটা রোম্যান্টিক মনোভাবই আধ্যাত্মিক গৌরবের সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে অভিসারের পদে এসেছে স্বাদ বৈচিত্র্য। আধুনিক কবির কণ্ঠেও ধ্বনিত হয়—

“তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে

চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগাস্তর পানে

ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে।”

এই দুর্গম পথ উত্তীর্ণ হবার জন্য শ্রীমতী রাধিকা কত না মহড়া দিয়েছেন একালের নারীর কণ্ঠেও শোনা যায় তেমনি এক আতধ্বনি— ‘আমারে প্রেমের বীর্যে কর অশঙ্কিতা।’

একালের মনীষী-প্রাবন্ধিক প্রাকৃতিক সত্যের সমান্তরালে এনেছেন অভিসারকে “পৃথিবীর যেমন দুই গতিঃ আহ্নিক ও বার্ষিক – একটি স্ববৃত্ত, অন্যটি সূর্যবৃত্ত, তেমনি মানবজীবনেরও দুই – গতি; একটি হইল অসীম অতীত হইতে অনস্ত ভবিষ্যতের অভিমুখে পথ পরিক্রমা, অন্যটি সেই পথে চলিতে চলিতেই আত্মপ্রেম, স্বীয় কামনাবাসনার চতুর্দিক চক্রমণ। মানবীয় প্রেমের জন্য – তেমনি স্ব-বৃত্তগতি বহু পূর্বকালেই অভিসার আখ্যা পাইয়াছে।”

এইদিক্ থেকে বিচার করলে ‘অভিসার কে আমরা কৃষ্ণলীলার বাইরেও লৌকিক এবং অলৌকিক – উভয় জগতে উপস্থাপিত করতে পারি। অলৌকিক জগতের অভিসার আত্মার অভিসার, ভূমার প্রতি অভিসার, পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার অভিসার। বহু ধর্মমতেই ভক্ত যে সাযুজ্য কামনা করেন কিংবা উপাস্য বা উপাস্যার চরণে লীন হতে চান, তাও একপ্রকার অভিসার। অতএব অভিসারের একটা আত্মিক তথা আধ্যাত্মিক মূলাও স্বীকার করে নিতে হয়।

লৌকিক অভিসারের একটি সুন্দর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে

‘গচ্ছস্তীনাং রমণবসতিং যোষিতাং তত্র নং রুদ্ধালোকে নরপতিপথে সুচীভেদ্যৈস্তমোভিঃ।’

সৌদামিন্য কনকনিকষসিগ্ধয়া দর্শয়োবীং তোয়োৎসর্গ স্তনিতমুখরো মাত্ম ভূৰ্বি বাস্তাঃ।। – পূর্বমেঘ ৩৮।

সেখানে প্রেমিকের ভবনে যোষিতেরা চলেছে পুঞ্জিত আঁধার ঠেলে 

বিজন রাজপথে, তামসী যামিনীতে দৃষ্টিবিরহিত চরণে

দেখিয়ে নিয়ে পথ স্নিগ্ধ বিদ্যুতে নিকষে বনকের ক্লান্তি এঁকে, 

কিন্তু বরিষণ অথবা গর্জন কোনো না, তারা অতি ভয়াতুরা।

অভিসার বৈচিত্র্য : পদাবলী সাহিত্যে শ্রীরাধার অভিসারই যেন সমগ্র লীলাতত্ত্বের মেরুদণ্ড। প্রেমাবেগের পর্যায়ে এই অসাধ্যসাধন প্রচেষ্টা। বৈষ্ণবপদকর্তারা অভিসার পর্যায়ের পদ রচনা করতে গিয়ে লৌকিক গণ্ডি অতিক্রম করে একে আধ্যাত্মিকতার স্তরে উন্নীত করেছেন রাধার অভিসার যেন এক অপ্রাকৃত মায়ালোক বৃন্দাবনের পথে।

পদাবলী সাহিত্যে অভিসার বর্ণনায় বৈচিত্র্যের অবধি নেই। গোবিন্দদাস জ্যোৎস্নাভিসার বর্ণনায় দেখিয়েছেন— ‘রঙ্গপুতলি যেন রস মাহাবুর’ অর্থাৎ রঙের পুতলি যেন পারদে ডুবে আছে। রাধা তামসী রজনীতে অভিসার যাত্রা করেছেন, তাই নীল নলিনী জনু শ্যাম সায়রে লখয়ে ন পারই কোই’—রাধা নীল শাড়ি পরেছেন – শ্যাম সরোবরে নীল পদ্ম ফুটেছে, কাজেই কেউ আর লক্ষ্য করতে পারছে না।

পদাবলীকাররা রাধিকার শীতনিশীথের অভিসারও বর্ণনা করেছেন হিমময়ী দীর্ঘ রজনী রাধিকা শ্যামের জন্য প্রতীক্ষমাণা– সেই ‘বিদীঘল রজনীতে ‘উজাগরময়ী’ রাধার চিত্রাঙ্কনে কবিরা যথেষ্টই বৈচিত্র্য প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছেন। দিবাভিসার বর্ণনাতেও কবিদের কৃপণতা নেই।

‘মাথইি তপন তপত পথ বালুক আতপ দহন বিধার।

নুনিক পুতলী তনু চরণকমল জনু দিনহি কয়ল অভিসার।”

-মাথার ওপর সূর্য, তপ্ত বালুরাশি, দিগন্তবিস্তৃত রৌদ্র—তার মধ্যে নুনেক পুতুল রাধিকা — শ্যামের সঙ্গে মিলনের কৃচ্ছ্রতাসাধ্যতা কবিরা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

রাধার ভ্রমাভিসারের একটি কৌতুকময় চিত্র—

‘রাই সাজে বাঁশি বাজে পড়ি গেল উল। 

কি করিতে কিবা করে সব হৈল ভুল।।

করেতে নূপুর পরে পায়ে পরে তাড়।

গলাতে কিষ্কিনী পরে কটিতটে হার।।’

কৃষ্ণপ্রেমিকা রাধার দুঃসাহসের দৃষ্টাত্তরূপে বিদ্যাপতি তাকে পুরুষবেশেও অভিসারে পাঠিয়েছেন।

‘পুরুষক বেশে কয়ল অভিসার।’

অভিসারের পদ-বর্ণনায় আরো বৈচিত্র্য আছে, কিন্তু এ বিষয়ে বর্ষাভিসারই সর্বাগ্রগণ্য—গুণ এবং গণনায়।

‘অভিসারে’র কবিগণ

(১) বিদ্যাপতি : বৈষ্ণব কবিদের অনেকেই অভিসারের পদ রচনা করেছেন। প্রাক্-চৈতন্যযুগের কবিদের রচনা আধ্যাত্মিকতা-বর্জিত। চৈতন্যোত্তর যুগের কবিদের অভিসার বর্ণনার মধ্য দিয়ে পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার অভিসারের একটা রূপ ফুটে ওঠে।

বিদ্যাপতির অভিসার বর্ণনায় একটা চিরন্তন ব্যথা বেদনার পুরবীর সুর প্রবাহিত হয়—যা সাধারণত তার মধ্যে থাকে না। অভিসারের পদে বিদ্যাপতির রচনায় আধ্যাত্মিকতার ইঙ্গিত সত্যই বিস্ময়কর—

‘নিঅ পহুঁ পরিহরি    সঁতরি বিম পরি

অগিরি মহাকুল গারী।

তুঅ অনুরাগ    মধুর মদে মাতলি

কিছু ন গুণল বরনারী।।’

কিংবা

‘কুলবর্তী ধরম করম ভয় অব সব

গুরুমন্দির চলু রাখি।’

এ পদগুলোর তুল্য অভিসারের পদ গোবিন্দদাস ব্যতীত অপর কেউ লিখতে পারেননি বললে অত্যুক্তি হয় না।

রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন, ‘নদী চলেছে যাত্রার ছন্দে, সমুদ্র দুলছে আহ্বানের সুরে– এর মধ্যে সেই চিরন্তন অভিসারের সুরটিই সুস্পষ্ট। বিদ্যাপতির রাধা-রূপিণী নদী—একটা আকুল আহ্বানে‌ যেন কৃষ্ণরূপ সমুদ্রের দিকে ছুটে চলেছে – বিদ্যাপতির রচনায় রয়েছে এরই প্রমাণ।

(২) জ্ঞানদাস: অন্যদের মতো জ্ঞানদাসও অভিসারের পদ রচনা করেছেন; কিন্তু তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। জ্ঞানদাস রূপের কবি, অভিসারেও তাই রূপ বর্ণনার সুযোগ নিয়েছেন। ‘চলে বা না চলে রাই রসের তরঙ্গ এখানে কবি রাধার চলার কথা বললেও আসলে তিনি যেন রাধাকে গতিহীন রূপতরঙ্গের ওপর স্থাপন করেছেন। তবে কোনো কোনো পদে—’কানুরাগে হৃদয় ভেল কাতর / রহই ন পারই গেহ।’ কিংবা— ‘মেঘ যামিনী অতি ঘন আন্ধিয়ার।’ কবি প্রকৃতই রাধার অভিসার বর্ণনা করেছেন, যদিচ তা প্রায় গতানুগতিক।

বৈষ্ণব রসশাস্ত্র ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তে শ্রীরাধার অভিসারে সঙ্গিনী ছিলেন এক সখী। সাধারণত বৈষ্ণব কবিরা শ্রীমতীকে একলা অভিসারে পাঠালেও জ্ঞানদাস কিন্তু উজ্জ্বলনীলমণি’কেই অনুসরণ করে লিখেছেন –

‘মেঘ যামিনী অতি ঘন আন্ধিয়ার। 

ঐছে সময়ে ধনী করু অভিসার।। 

কলকত দামিনী দশ দিশ আপি। 

নীল বসনে ধনী সব তনু কাঁপি।।

দুই চারি সহচরী সঙ্গহি নেল। 

নব অনুরাগ ভরে চলি গেল।।’

(৩) চণ্ডীদাস : চণ্ডীদাস অভিসারের পদ বেশি লেখেন নি। কিন্তু একটি পদে দেখা যায় কৃষ্ণের অভিসার বর্ণনায় কবি পরম আকুলতার সৃষ্টি করেছেন। এখানে বর্ষাবিক্ষুব্ধ অমা রজনীতে রাধা নন কৃষ্ণই অভিসারে এসেছেন।

“এ ঘোর রজনী    মেঘের ঘটা

কেমনে আইল বাটে।

আঙ্গিনার মাঝে    বঁধুয়া ভিজিছে

দেখিয়া পরাণ ফাটে।।

সই, কি আর বলিব তোরে।

কোনো পুণ্যফলে    সে হেন বঁধুয়া

আসিয়া মিলল মোরে।।”

এই উক্তি থেকেই অভিসারের লক্ষণ ধরা পড়েছে। নইলে এইটিকে ‘রসোগার’-এর পদ বলেই ব্যাখ্যা করা চলে। রবীন্দ্রনাথ পদটির অন্তর্নিহিত ভাবসত্যের খুব প্রশংসা করেছেন।

(8) গোবিন্দদাস: অভিসার পর্যায়ে গোবিন্দদাস রাজাধিরাজ। বৈষ্ণব কবিদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি এই পর্যায়ের কবিতায় গোবিন্দদাসের প্রতিস্পর্ষী হতে পারেন। তার এই সার্থকতার কারণ সম্বন্ধে জনৈক বিদগ্ধ সমালোচক বলেছেন, তাহা কবির স্বকীয় প্রতিভাধর্ম – তাহার চলিষ্ণুতা ও চিত্ররস-রসিকতা এবং পরোক্ষ অভিজ্ঞতারস। কবির নিজ কবি-মর্ম কাব্যের রূপনি মাণে শক্তি দিয়াছে এবং শ্রীচৈতন্য-জীবনের অপূর্ব অভিজ্ঞতা সেই শক্তিকে সার্থকতার পদ প্রদর্শন করিয়াছে।”

অভিসারের পদে যত বৈচিত্র্য আছে, তার প্রায় সবই যে গোবিন্দদাস কর্তৃক রূপাঙ্কিত হয়েছে, তা পূর্বেই দেখানো হয়েছে। চিত্রধর্ম, নাটকীয়তা এবং তৎসহ সঙ্গীত হিল্লোলের সংমিশ্রণে গোবিন্দদাসের অভিসার পর্যায়ের যাবতীয় পদই রসোত্তীর্ণতা লাভ করেছে। এই পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা – ‘কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল / মঞ্জীর চীরহি ঝাপি’— কবিতাটি বিশ্লেষণ – করলেই গোবিন্দদাসের কৃতিত্বের পরিমাণ সহজেই উপলব্ধি হবে। অভিসার ব্যাপারটি একটি বাস্তব এবং দৈহিক ঘটনা এখানে মানসজগতের কিংবা কল্পনার কোনো স্থান নেই, পদটি বর্ষাভিসারের পদ—তামসী বর্ষা রজনীতে শ্রীমতীকে অভিসারে যেতে হবে এটা তো নিত্য নিয়মিত ব্যাপার নয়, তাই তার জন্য পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন। আলোচ্য পদটিতে রাধার কৃচ্ছসাধনার পুনঃ পুনঃ অভ্যাস এবং প্রস্তুতি রয়েছে। অন্ধকার রজনীতে পথ চলতে গেলে পায়ে কাঁটা ফুটতে পারে, পথ পিছল হতে পারে, পায়ের নূপুর বেজে উঠতে পারে তাই ঘরে বসেই এ সকল দুস্তর বাধা অতিক্রমের সাধনা তিনি করে চলছেন। রাত জেগে তিনি অভিসারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উঠোনে জল ঢেলে কঁাটা পুঁতে, পায়ের নূপুর কাপড়ে বেঁধে তিনি পথ চলা অভ্যাস করছেন। অন্ধকারে পথ চলতে হবে, তাই দুহাতে চোখ ঢেকে পথ চলা আয়ও করছেন। কিন্তু বিপদ তো শুধু এটুকুই নয়। অন্ধকার বর্ষা রাতের অভিসারে যদি দৈবক্রমে সর্পদষ্ট হন, তবে তো অভিসারে যাওয়া হবে না। অতএব করকক্ষণপণ ফণিমুখ-বন্ধন শিখই ভুজগ-গুরু পাশে নারীর সর্বস্ব, তার করকক্ষণ বাঁধা রেখে সাপের ওঝার কাছ থেকে তার মুখ বন্ধ করার মন্ত্র শিক্ষা নেন। কিন্তু এহো বাহ্য – শ্রীমতীর অভিসারে প্রকৃতিই তো একমাত্র বাধা নয়, সমাজ, সংসার, সংস্কার—সবই তো পথ আগলে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে তিনি সকলের অবাধ্য হয়ে উঠবেন কী করে? অতএব ‘গুরুজন-বচন বধির সম মানই / আন শুনই কহ আন” – তিনি গুরুজনের কথা শুনতে পান না, এক বলতে আর শোনেন, এই ভান করে অবাধ্যতাকে ক্রমে ক্রমে সইয়ে নেন, আত্মীয়স্বজনের কথায় শুধু বোকার মতো হাসেন যেন ধরা পড়ার পরবর্তী গল্পনাটাও তিনি সয়ে নিতে পারেন।

সমগ্র কবিতাটিতে রাধিকার কৃচ্ছ্বসাধনা-প্রচেষ্টার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা যেন অক্ষরে অক্ষরে ক্ষরিত হচ্ছে।

রাধার নিকট এই সকল প্রাকৃত বাধার কোনোটিই আর বাঁধা নয়। তিনি বলেন, কুলমর্যাদারূপ কপাট যখন উদ্‌ঘাটন করেছেন, তখন কাঠের কপাট তার অভিসারে আর কতটুকু বাধা দিতে পারে? আত্মসম্মান রূপ সমুদ্র যেখানে তিনি হেলায় পার হয়েছেন, সেখানে সামান্য নদী পার হওয়ার আর কী এমন কঠিন –

‘কুল মরিয়াদ    কপাট উদ্ঘাটলু

তাহে কি কাঠকি বাধা।

নিজ মরিয়াদ    সিন্ধু সক্রে পড়ারলু

তাহে কি তটিনী অগাধা।।’

পথের কাদায় ও কাটায় তার চরণ ক্ষত-বিক্ষত হল। তবু তার সব ক্লেশ ও পরিশ্রম আজ সার্থক হয়েছে শ্যাম সঙ্গ লাভে –

এক পদ-পঙ্কজ    পঙ্কে বিভূষিত

কণ্টকে জর জর ভেল।

তুয়া দরশন আশে    কছু নাহি জানলু

চিরদুখ অব দুরে গেল।

তোহারি মুরলী যব    শ্রবণে প্রবেশল

ছোড়লু গৃহ সুখ-আশ 

পন্থক দুখ তৃণ    হুঁ করি না গণলু

কহতহি গোবিন্দদাস।।

রূপ জগতের সঙ্গে অরূপ জগতের আধ্যাত্মিকতা বিখণ্ডিত হয়ে এই পদসমূহ ভক্ত হাদয়কে আকুল করে তোলে।