দেবী চণ্ডী পুরাণ-প্রোক্ত দেবী আদ্যাশক্তি ভগবর্তীর একটি বিশেষ রূপভেদ মাত্র। ‘চণ্ডের কপালে পড়ে নাম হৈল চণ্ডী’— হনি ভীষণামূর্তিতে চণ্ডাসুরকে বধ করেছিলেন। এটি হল ধর্মবিশ্বাসী ভক্তদের কথা। সমাজবিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে আর্য-প্রাগার্য সমন্বয়ের ফলে এক প্রাগার্য দেবীহ পরে বাংলা মঙ্গলকাব্যে ও সংস্কৃত পুরাণে রূপান্তর লাভ করে। অনেকে এর পশ্চাতে বৈদিক যুগের দেবী অরণ্যানী থেকে আরম্ভ ক’রে আরো অনেক দেবীর প্রভাবের কথাও অনুমান করেন। সে যা-ই হোক, কবিকঙ্কণ-রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’ দেবী চণ্ডীর ভূমিকা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তা-ও তিনি একরূপে নন, ভিন্ন পরিবেশে ও কাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপও লাভ করেছেন।
গ্রন্থের প্রথম ভাগ আখেটিক পর্বে’র ‘দেব-খণ্ডে’ দেবী ও চণ্ডী সম্পূর্ণভাবেই পৌরাণিক দেবী দক্ষ-কন্যা সতী ও পরে হিমালয়-দুহিতা পার্বতী-রূপে আবির্ভূতা। কালকেতু-কাহিনী তে তিনি অরণ্যের পশুকুলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী; একসময় তিনি স্বর্ণগোধিকা রূপ ধারণ করেন ও পরে যোড়শী-কন্যায় রূপায়িতা হন। এই পর্বেই তিনি একবার দশভুজা মহিষমর্দিনী রূপেও আবির্ভূতা হ’রেছিলেন। গ্রন্থের ‘বণিকূপর্বে’ দেবী প্রথমে মিঙ্গলচণ্ডীকা’-রূপে ও পরে গজগ্রাসিনী ‘কমলে-কামিনী’-রূপে অনেককেই দেখা দিয়েছেন। অতএব চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দেবী চণ্ডী যে বিভিন্ন ভাবনা-কামনার একটা সমন্বিত রূপ, এ কথাটি অস্বীকার করবার উপায় নেই। তাই এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা যে তাঁর মধ্যে বিচিত্র ভাবেরই প্রকাশ দেখা যাবে। আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতি দেবী ভগবতীরই অন্যতম রূপ বলে দেবী চণ্ডীর মধ্যে যেমন অঘটন ঘটন-পটীয়সী অলৌকিক শক্তির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়, তেমনি মর্ত্য মানবের দুঃখকষ্ট মোচনে স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তা দেবীর মধ্যে মানব-মাতার স্বাভাবিক মমতাটুকুও একান্ত স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশিত হ’য়েছে। বস্তুত চণ্ডীমঙ্গলের দেবী দশ ভূজারূপে একবার দেখা দিলেও আসলে তিনি শতরূপা।
‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’র আর্থেটিক খণ্ডের প্রথম পর্ব ‘দেবখণ্ড’ এবং অবশিষ্ট পর্বটিই প্রকৃত আখেটিক খণ্ড বা ব্যাধ কাহিনী। মূল ব্যাধ-কাহিনী অর্থাৎ কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনীতে দেবী চণ্ডী যে রূপে বারবার দেখা দিয়েছেন, তার প্রায় কোনটিই শাস্ত্রানুমোদিত কিংবা পুরাণসম্মত নয়। প্রাগার্য সমাজ থেকে আগতা দেবীর এইরূপ উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজে এতকাল অপরিচিত ছিল, অথচ তার এই সমাজে স্বীকৃতি প্রয়োজন, নতুবা তিনি বৃহত্তর জন-সমাজে গৃহীত হ’বেন না। এই কারণেই তার সঙ্গে পৌরাণিক দেবীর সাযুজ্য প্রয়োজন ছিল— দেব-খণ্ডের সংযোজন ঘটেছিল এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই, নতুবা কাহিনীগতভাবে এর কোনই উপযোগীতা নেই। কালকেতু কাহিনীর দেবী চন্ডীও আসলে পৌরাণিক দেবীই এবং অপর সমস্ত দেব-দেবীর মতোই উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজেরও পূজাহ্, এবং তিনি যে আদ্যাশক্তি ভগবতীরই একটি রূপভেদমাত্র, এই বোধটি জাগিয়ে দেবার জন্যই সতী ও উমা পর্বের অবতারণা। প্রত্যক্ষভাবে এর সঙ্গে মুলকাহিনীর কোনো যোগ নেই।
‘দেবী-খণ্ডে’ দেবী চণ্ডী উমা পার্বতীরূপে দেখা দিয়েছেন। অবশ্য এই খণ্ডে উমা / পার্বতী তথা গৌরীকে কোথাও ‘চণ্ডী’ বলে উল্লেখ করা হয়নি এবং এই উমাই যে কালকেতু-কাহিনীতে চণ্ডীরূপে গ্রহণ করেছেন, তা-ও বলা হয় নি। শুধু ঘটনা-পরম্পরা সূত্রেই এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্রটি অনুমান ক’রে নিতে হয়। যাহোক্, আলোচ্য কাহিনীতে উমা-পার্বতী হিমালয় কন্যা ও শিবগৃহিণী এবং তিনিই যে পূর্বজন্মে ছিলেন দক্ষকন্যা সতী এই বিবরণটি এবং তাঁর তপস্যার মাধ্যমে শিবকে স্বামীরাপে লাভ এই পর্যন্তই পুরাণ-সম্মত। এতদতিরিক্ত, তার বিৰাহাদি, পিতৃগৃহে স্বামিসহ বসবাস, মা মেনকার সঙ্গে বাদ-বিসম্বাদ কিংবা কৈলাস-জীবন যাপন প্রভৃতি বিষয়ে কবি যে বিস্তৃত বিবরণ দান করেছেন, সবই একান্তভাবে মানবিক। শুধুই মানবিক নয় ঊমা এই পর্বে একেবারে নিম্নবিত্ত গৃহস্থ ঘরের কন্যা ও বধূ অলৌকিকত্বের ছিটেফোটাও কোথাও নেই, দোষে-গুণে মূর্তিমতী একটি মানব-কন্যা। এই পর্বের শেষতম মুহূর্তে তার একটু নিষ্ঠুরতা ও অলৌকিকত্বের পরিচয় পাওয়া যায় ছলনার দ্বারা ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে অভিশপ্ত ক’রে মর্ত্যলোকে পাঠানোর মধ্যে। মর্ত্যে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের প্রয়োজনে ঐ বেচারীকে কিছুদিনের জন্য এই মাটির পৃথিবীর সুখদুঃখ ভোগ করে যেতে হল বিনা অপরাধে।
এর পর মূল কাহিনী – কালকেতু-ফুল্লরা উপাখ্যান। এখানে বারবারই চণ্ডী দেখা দিয়েছেন। কিন্তু সর্বত্রই তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের পিছনে রয়েছে স্নেহময়ী মানবীমাতার সদাসক্রিয় মন। হয়তো বা কখনো তাকে সাময়িকভাবে কঠোর হতে হয়েছে, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো, তার সস্তানের তথা ভক্তের মঙ্গলসাধন।
দেবী চণ্ডী মর্ত্যলোকে তার মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে শাপগ্রস্ত করে মানবসত্তানরূপে মর্ত্যলোকে নিয়ে এলেন—এই মানবসস্তানটিই হল সমাজ অবহেলিত ব্যাধকুলজাত কালকেতু। দেবী তাকেই দয়া করবেন এবং তার মাধ্যমেই নিজের মাহাত্ম্য প্রচার করবেন। এই সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তাঁকে কিছু অলৌকিক ক্ষমতারও পরিচয় দিতে হয়েছে, যেমন তিনি পরপর যথাক্রমে মায়ামৃগ, সুবর্ণ গোধিকা, ষোড়শী নারী এবং দশভুজা মহিষমর্দিনী রূপ ধারণ করেছেন। আবার ইচ্ছামাত্র দাড়িম্ববৃক্ষতলে সাতঘড়া ধনও সৃষ্টি করলেন। কিন্তু এই অবকাশেই তার করুণা মাতৃহহৃদয়ের প্রকাশও ঘটেছে বহুবার। তিনি পশুদের কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদের ভয়মুক্ত করেছেন ফুল্লরা সুন্দরীকে বলেছেন—’আজি হৈতে মোর ধনে আছে তোর অংশ’ এবং কালকেতুকে বলেন— ‘বিনাশ করিব দুঃখ তোরে করি দয়া’। এরপর ওদের মাণিক্যের অঙ্গুরি ও সাতঘড়া ধন পাইয়ে দিলেন। এবং কালকেতুকে নির্দেশ দিলেন, সে যেন গুজরাট বন কেটে সেখানে রাজ্য পত্তন ক’রে নিজে রাজা হয়ে সুখে প্রজা পালন করে।
এই পর্বেও যেমন কিছুটা অলৌকিকতা ও নিষ্ঠুরতা রয়েছে সস্তানের মঙ্গল সাধন-মানবী মায়ের এই পক্ষপাতিত্বটুকুই তো মানবিকতা দেবীর নির্দেশেই হনুমান ও বিশ্বকর্মা রাতারাতি মন্দির প্রাসাদাদিসহ নগর সৃষ্টি ক’রে দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাধসস্তানকে রাজা বলে মেনে নিতে চায় না কেউ, কাজেই কালকেতু রাজ্যে প্রজাপতন হচ্ছে না। তখন দেবী চণ্ডী অন্যত্র বন্যা সৃষ্টি ক’রে প্রজাদের বাধ্য করলেন পূর্বস্থান ত্যাগ ক’রে কালকেতুর রাজ্যে উঠে আসতে। এই ঘটনায় আপাত দৃষ্টিতে দেবীর নিষ্ঠুরতার পরিচয় পাওয়া গেলেও প্রজারা শেষ পর্যন্ত লাভবানই হয়েছিল। কারণ কালকেতু তার রাজত্বে প্রজাদের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দান করেছিল, সে সুযোগ প্রজারা পূর্বে কখনো পায়নি।
এরপর দেবীর পুনঃ সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, বন্দী কালকেতু যখন কাতরম্বরে মায়ের অনুগ্রহ কামনা করলো তখন। দেবী তার উদ্ধার কামনায় আবার দেখা দিলেন। একদিকে তিনি কলিঙ্গরাজকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে কালকেতুকে মুক্ত করে দেওয়ার আদেশ দিলেন। অপরদিকে ভীষণামূর্তিতে সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে মশানেও আবির্ভূতা হ’লেন। এই একটি মাত্র স্থলেই দেবী চণ্ডীর ভক্তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণে অগ্রসর হয়ে যথার্থ পূজালাভেচ্ছ দেবীর ভূমিকা গ্রহণ করেন। এছাড়া প্রায় সর্বত্রই দেবী স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হ’য়েই অপরের উপকার সাধন ক’রে গেছেন। হিতব্রত সাধনই যেখানে দেবীর লক্ষ্য সেখানে কালকেতুকে কেন তিনি কারা-যন্ত্রণা ভোগ করিয়েছেন, তারও একটা কৈফিয়ৎ এখানে দেবী দিয়ে রেখেছেন–কালকেতু যে একসময় অরণ্যের পশুদের ওপর অত্যাচার করেছিল, তারি স্বল্পকালীন শাস্তিরূপে কালকেতুকে এই বন্দীদশা ভোগ করতে হয়। শাপভ্রষ্ট কালকেতু মুক্ত হ’য়ে পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে আবার স্বর্গে চলে গেলো।
কালকেতু-কাহিনী বিশ্লেষণে দেবী চণ্ডীর যে ভূমিকা দেখা গেলো, তাতে কিন্তু কোথাও তাঁকে অপরাপর মঙ্গলকাব্যের দেব-দেবীদের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণা কিংবা নিষ্ঠুরা বলে মনে হয়নি। ভয় দেখিয়ে পূজা আদায়ের কোনো প্রচেষ্টা নেই বরং ভালোবাসা দ্বারা, মঙ্গল সাধন দ্বারাই তিনি ভক্তের হৃদয় জয় করতে সচেষ্ট হয়েছেন। স্থানে স্থানে অলৌকিকতার পরিচয় দিলেও তার হৃদয়টি ছিল মানবী-মাতার মতোই স্নেহরসে পূর্ণ। তাঁর দয়ার্দ্র হৃদয় অপরের দুঃখকষ্ট-দর্শনে সহজেই কাতর হয় এবং সেই দুঃখ মোচনে তিনি নিজেও যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করেছেন। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীগণ নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচারে রত থাকলেও তার মধ্যে প্রচারের প্রবণতা বিশেষ লক্ষ্য করা যায় না।
Leave a comment