ফুল্লরা চরিত্র অবলম্বন করে মধ্যযুগীয় সাধারণ বাঙালী মেয়ের দুঃখ-সহিষ্ণুতার স্বরূপটি বুঝিয়ে দাও।

রবীন্দ্র-স্বীকৃতিধন্য কবিকঙ্কণ-অঙ্কিত ‘ফুল্লরা’ চরিত্রটি সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি রূপে পরিচিত। কবিকঙ্কণ খলচরিত্র-চিত্রণে অবশ্যই সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তার বাইরে এই ফুল্লরা-চরিত্রেই তিনি বাস্তবতাবোধ এবং নির্মমতার সাহায্যে প্রাণ আরোপ করে চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলতে পেরেছেন।

ফুল্লরা শাপভ্রষ্টা দেবী ফুল্লরা স্বর্গজীবনে ছিল ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরের স্ত্রী। শিবের অভিশাপে নীলাম্বর মর্ত্যলোকে কালকেতুরূপে জন্মগ্রহণ করলে নীলাম্বরপত্নী ছায়াও পতির সঙ্গে সহমৃতা হ’য়ে মানবজীবনে ফুল্লরারূপে জন্মগ্রহণ করে। ফুল্লরা সঞ্জয়কেতু ব্যাধের কন্যা, সে একদিন মা হীরার সঙ্গে হাটে গিয়েছিল। দৈবক্রমে সেদিন হাটে ছিল কালকেতুর মা নিদয়া স্বামী-পুত্র সহ। দুই সখী পুরনো সুখ-দুঃখের কথায় যার যার পুত্র-কন্যার পরিচয় পায়। এর পর সোমাই ওঝার ঘটকালি শুরু। সোমাই কালকেতুর গুণপনা ব্যাখ্যা করে বলে

‘সেই বরযোগ্য তোমার কন্যা ফুল্লরা।

খুঁজিয়া পাইল যেন হাঁড়ির মত সরা।’

সঞ্জয়কেতুও কন্যার পরিচয় প্রসঙ্গে বলে

‘রন্ধন করিতে ভাল এই কন্যা জানে।’

সম্ভবত সেকালের কন্যার গুণপনায় রন্ধন-বিদ্যায় দক্ষতা ছিল সর্বাগ্রে। যাহোক, কালকেতুর সঙ্গে ফুল্লরার বিয়ে হয়ে গেল। ফুপরা কালকেতুর সংসার জীবনে প্রবেশ করেই শাশুড়ির প্রশংসা অর্জন করলো।

কালকেতু-ফুল্লরাকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে ধর্মকেতু ও নিদয়া কাশীবাসে চলে যান। এইবার সংসারের যাবতীয় ভার এসে পড়লো ফুল্লরা আর কালকেতুর ওপর। কালকেতু শিকারে বিভিন্ন জীবজন্তু হত্যা ক’রে নিয়ে আসে আর ফুল্লরা কখনও মাংস, কখনও হাতীর দাঁত, মোষের সিং, গণ্ডারের খড়া, চমরীর লেজ ইত্যাদি কেটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে আসে। ঘরের কাজকর্ম সবই করে ফুল্লরা, রান্নাবান্নাও তারই কাজ, সে রান্নাও করতো ভালো। কালকেতু ফুল্লরার প্রশংসা করে বলে

‘রন্ধন কর্যাছ ভালো আর কিছু আছে।’

আরো যা কিছু ছিল, সবই ফুল্লরা কালকেতুর হাতে তুলে দিয়েছে। আশঙ্কা হয়, সে রাত হয়তো বা ফুল্লরাকে উপবাসেই কাটাতে হয়েছিল।

এরপর একদিন কালকেতু শিকারে গিয়ে কিছুই না পেয়ে এক গোসাপ ধরে এনে শিল চাপা দিয়ে ফুল্লরার সন্ধান করতে গিয়ে পড়শীর কাছে শুনলো—ফুল্লরা হাটে গেছে। কালকেতু হাটের দিকে যাত্রা করছে, ফুল্লরা হাট থেকে ফিরছে। দূর থেকে কালকেতুর শূন্য হাত দেখে ফুল্লরা প্রমাদ গুণলো।

‘বীরে দেখি শূন্যপাণি    কপালে আঘাত হানি

করে রামা দৈব সোঙরণ।

বিধাতা আমারে দণ্ডী    জীয়স্থ ভাতারে রাজী

কৈল দৈব দুঃখের ভাজন।।’

ব্যাধের সংসার, স্থায়ী সম্বল বলতে কিছু নেই, দিন আনে দিন খায়, কাজেই অভাব এবং দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। ফুল্লরা তার দুঃখের আরও বিশদ বর্ণনা পরে করেছে, কিন্তু তাতে অভাবের চিত্রটি প্রস্ফুট হলেও তাতে আন্তরিক দুঃখবোধ ছিল না। কিন্তু সম্ভবত এইবারই শুধু তাকে কপাল চাপড়াতে হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় স্বামী জীবিত থাকতেও যে তাকে এ হেন জীবন-যাপন করতে হয়েছে, তার জন্য সে স্বামীকে নয়, স্বয়ং বিধাতাকেই দায়ী করেছে। ভালোমন্দ সবকিছুর জন্য ভাগ্যকে দায়ী করবার এই মনস্তত্ত্ব ব্যাধনারীর পক্ষে একান্তই স্বাভাবিক।

যাহোক কালকেতু বাসি মাংসের পসরা নিয়ে আবার হাটে গেলো, ফুল্লরাকে বলে গেলো সখী বিমলার মার কাছ থেকে চাউল ধার করে আনতে। ফুল্লরা সখীর মাথার উকুন বেছে দিয়ে একথা সে কথা বলে দু’কাঠা খুদ ধার করে নিয়ে ঘরে ফিরলো।

কালকেতু ঘরে যে গোসাপ রেখে গিয়েছিল, সে ছিল ছদ্মবেশিনী দেবী চণ্ডী। কালকেতু ফুল্লরা দু’জনেই যখন বাইরে সেই অবসরে দেবী এক ষোড়শীর রূপ ধারণ করে ঘর আলো ক’রে বসে রইলেন। সখীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে ফুল্লরা এই অপরূপা রমণীকে দেখে বিস্ময় মনে তার পরিচয় জানতে চাইলো। কিন্তু দ্ব্যর্থবোধক দেবী আপন পরিচয় জানালেন

‘সাত সতা গৃহে বাস বিষম জঞ্জাল।।

তুমি গো ফুল্লরা যদি দেহ অনুমতি।

এই স্থানে কতক দিন করিব বসতি।।’

এ কথায় ফুল্লরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এতদিন এ গৃহে ছিল ফুল্লরার অসপত্য অধিকার ফুল্লরার অভাব এবং দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু স্বামী-প্রেমের কোনো অংশীদার না থাকায় তার অন্তরে কোনো দুঃখবোধ ছিল না। তাই ‘হহৃদে বিধ মুখে মধু নিয়ে সে নানাভাবে ষোড়শীকে এ গৃহ ত্যাগ করে স্বগৃহে যাবার নানারকম যুক্তি দেখালো। এমন কি ঐ রূপসীর সঙ্গে গিয়ে ফুল্লরা তার শাশুড়ি-ননদীকেও গালমন্দ করে আসতে পারে। আর যদি সতীনের ঘর হয়, তবে—

‘সতিনী কোন্দল করে    দ্বিগুণ বলিবে তারে

অভিমানে ঘর ছাড় কেনি ।

কোপে কৈলে বিষপান    আপনি তেজিবে প্রাণ

সতিনের কিবা হবে হানি।।’

ব্যাধরমণীর কণ্ঠে এ জাতীয় উক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই বোধ হয়, কারণ এর সঙ্গে বাস্তবের মিল রয়েছে। কিন্তু এই ফুল্লরাই যখন সীতা বা পরশুরামের জননী রেণুকার পতিভক্তির দৃষ্টাস্ত উল্লেখ ক’রে ঐ ষোড়শী কন্যাকে নানাপ্রকার সদুপদেশ দেয়, তখন তা আর বিশ্বাস্য থাকে না—একে একেবারেই কৃত্রিম বলে মনে হয়। দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতা কবির ছিল, ছিল তার বস্তুনিষ্ঠাও; কিন্তু যখনি কবি তার বাইরে গিয়ে কল্পনার সহায়তা নিয়েছেন, তখনি ব্যর্থ হয়েছেন। অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন “পর্যবেক্ষণ শক্তির ওপরেই মুকুন্দরামের প্রতিষ্ঠা—যখনই তিনি অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাইয়াছেন, সফল হইয়াছেন, কিন্তু যখনই কল্পনাকে আশ্রয় করিয়াছেন, তাঁহার প্রতিষ্ঠা ভাঙিয়া পড়িয়াছে।” এই সমস্ত সদুপদেশ সত্ত্বেও যখন দেবী বলেন

‘আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে। 

আনিয়াছে তোর স্বামী বান্ধি নিজগুণে।।’

তখন ফুল্লরা ভাবলো,—তার বারো মাসের দুঃখের কাহিনী যদি ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে পারি, হয়তো অভাব ও দারিদ্র্যের ভয়ে এই ষোড়শী স্থানাস্তরে যেতে পারে। এই ভেবে ফুল্লরার শুরু হল বারমাস্যা। এই বারো মাসের বর্ণনায় নিম্নবিত্ত ব্যাধগৃহের একটি অপূর্ব বাস্তবচিত্র রূপায়িত হ’য়ে উঠেছে, একান্ত অভাব ও দারিদ্র্যলাঞ্ছিত সেই জীবন। এই বর্ণনায় অবাস্তব কিছু নেই, কিন্তু ফুল্লরা একটু ছলনার পরিচয় দিয়েছে। তার উক্তি—

‘অভাগ্য মনে গুণি, অভাগ্য মনে গুণি। 

কত শত খায় জোঁক, নাহি খায় ফণী।।’

এ থেকে মনে হয়, দারিদ্র্যের জ্বালায় ফুল্লরা বুঝি মৃত্যু কামনা করেছে, কারণ এই দুঃখময় জীবন তার নিকট অসহ্য হয়ে উঠেছে। এখানে অভাব ও দারিদ্র্যের চিত্রটি বাস্তব, কিন্তু ফুল্লরার দুঃখবোধ বা মৃত্যুকামনাটি ছলনামাত্র। স্বামী-প্রেমধন্যা ফুল্লরার জীবনে আনন্দের বা সুখের অভাব ছিল না বলেই সে এই জীবনে অপর কোনো অংশীদারের আগমনকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। তাই আত্যন্তিক দুঃখবোধের ছলনায় সে ষোড়শীর মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ফুল্লরার ভূমিকা সুবিস্তৃত নয়। ব্যাধজীবনেই উল্লেখযোগ্যভাবে তাকে পাওয়া যায়। দেবী যখন কালকেতুকে মাণিক্যের অঙ্গুরী দিতে চাইলেন, তখন ফুল্লরা তাকে অঙ্গুরী নিতে নিষেধ ক’রে বলে

‘একটি অঙ্গুরী নিলে হবে কোন কাম। 

সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম।।’

অশিক্ষিতা গ্রাম্য ব্যাধনারীর ধনের প্রকৃত মূল্যাবধানের অপারগতা-হেতু এই অবিশ্বাস অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক বলেই বোধ হয়। ফুল্লরার কার্যকরী ভূমিকা এখানেই প্রায় শেষ, এর পর সে রাজরানী। রাজরানীরূপে ফুল্লরা অনুল্লেখ্য এবং ব্যর্থ। তার বুদ্ধিতে আস্থা স্থাপন করে কালকেতু কাপুরুষোচিতভাবে আত্মগোপন করে এবং ফুল্লরার নির্বুদ্ধিতাহেতু কালকেতু কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। কালকেতু ধরা পড়লে তার মুক্তির জন্য ফুল্লরা যেভাবে কলিঙ্গরাজের নিকট কাকুতি-মিনতি করে, তাতে তার স্বামীপ্রীতির প্রকাশ ঘটলেও রাণীরূপে চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি বিহীন।

ফুল্লরাকে রানীরূপে প্রকাশ করতে যে কল্পনার প্রয়োজন কবিকঙ্কণের ততখানি কল্পনা শক্তি ছিল না, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখতে পারলে, এই অসঙ্গতি দেখা দিত না, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রাজকীয় জীবনযাত্রার সঙ্গে কবির তেমন পরিচয়ও ছিল না।