প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ধারাটিই ‘মঙ্গলকাব্য’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঘটনা সংঘাতে সমকালের সমাজজীবনে বিপুল বিপর্যয় হেতু আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীল সামাজিকগণও অনার্য-সমাজকে অনেকটা কাছে টেনে নিয়ে তাদের ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, দেব-দেবী এবং ধর্মবোধকেও কিয়ৎ পরিমাণে আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেছিলেন। এরই প্রত্যক্ষ ফল—মঙ্গলকাব্যগুলির উদ্ভব। মূলত কোনো কোনো অনার্য দেব-দেবীর মাহাত্ম্য পাঁচালী আকারে রচিত হ’লেও পরবর্তীকালে ক্ষমতাশালী কবিগণ পাঁচালীর কাহিনীকে মঙ্গলকাব্যে উন্নীত করেন। মঙ্গলকাব্যগুলিতে কোন না কোন দেব-দেবীকে মর্ত্যের মানুষের আশ্রয় ক’রে আপন মাহাত্ম্য ও পূজা প্রচারে ব্রতী হ’তে দেখা যায়। ফলত মঙ্গলকাবো একদিকে যেমন পৌরাণিক আদর্শের প্রতিফলন রয়েছে, তেমনি রয়েছে লৌকিক জীবনের উপাদান। যে কবি যত শক্তিমান, তিনি তত বেশি এই বিরোধী উপকরণের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ক’রে তার মধ্যে মানবজীবনের রস সঞ্চারিত ক’রে সেই সাহিত্যকে সমকালের সমাজপটে প্রতিস্থাপিত করেছেন। সমগ্র মঙ্গলকাব্য সাহিত্যে এ বিষয়ে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর জুড়ি নেই—এই কারণেই সাহিত্য সমালোচকগণ একবাক্যে কবিকঙ্কণকে ‘জীবন-রসিক মুকুন্দ’ বলে অভিনন্দিত করেন।
সেকালের যে পটভূমিকায় কবিগণ এক অতাশ্চর্য জীবনবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার বলেন, “বাংলার সমাজ জীবনে যে সময়টা সাধারণভাবে মধ্যযুগ বলে আখ্যাত সেই যুগের বিচিত্র আবহাওয়ায় স্নান করেই মঙ্গলকাব্যগুলির আবির্ভাব। এই সুদীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় ওঠা-নামা, একটানা ভাঙ্গা আর ভাঙ্গা, এবং ভাঙ্গার কলুষ স্পর্শ থেকে বাঁচার আকুল আকৃতিতে মুখর। বিভিন্ন রাজা ও বিভিন্ন আদর্শ আশ্রয়ী রাষ্ট্রের আসা-যাওয়া এবং সামাজিক আবর্তের কম্পন লৌকিক জীবনেই অনুভূত হয় সর্বাপেক্ষা বেশি। আর সামাজিক সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ মানুষের জীবন বা তার সমাজ-জীবনের কোনো অঙ্গাবরণকেই কোনোরূপ সম্মান বা ক্ষমা করে না বলেই মানুষের জীবনে যা কিছু মূল্যবান, যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু মাননীয় তা সমস্ত যায় নিঃশেষে ধূলিসাৎ হ’য়ে। আর এই ধ্বংসের ধূলি মেখেই মানুষ নিজেকে মনে করে অসহায় এবং জীবনকে মনে করে দুর্বিষহ। কিন্তু এই অসহায় চেতনা তার মধ্যে যত প্রবল হোক না কেন, মানুষের কাছে এর থেকেও বড় সত্য হ’ল যে সে মানুষ এবং মানুষ হিসেবে তার জীবনের অবিশ্রাস্ত সাধনা হল নিজেকে সৃষ্টি করা, প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে নিজের পরিপূর্ণ শক্তি সৌন্দর্যে নিজেকে উপলব্ধি তাই তার পরাজয়ের দিনেও তার মধ্যেই এই চেতনা বর্তমান। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসের সঙ্গে এই চেতনা ও তার সার্থক প্রকাশ অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে।”
মঙ্গলকাব্যের সমাজ প্রধানত গ্রামনির্ভর। রাজধানী রাজপ্রাসাদের বাইরে প্রায় গোটা দেশ জুড়ে নাগরিক জীবনবোধমুক্ত যে জীবনধারা আপনাকে প্রসারিত করে রেখেছে, মঙ্গলকাব্যে সেই জীবনবোধেরই প্রকাশ। মঙ্গলকাব্যের কবিরা কাহিনী বয়নে এবং চরিত্র-চিত্রণে সেই জীবনবোধকেই ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। এমন সব কবিদের মধ্যে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী সর্বাগ্রগণ্য। প্রকৃতির স্বভাবসৌন্দর্যের মতোই নিরাভরণ এই জীবনবোধে কোন চট্তা কিংবা সাজসজ্জা নেই, কবির কাব্য রচনা প্রচেষ্টাকে বিশ্লেষণ করলেই এর যথার্থ পরিচয় পাওয়া যাবে।
কবিকঙ্কণ চণ্ডীর মূলে আছে চণ্ডীমাহাত্ম্য প্রচার-প্রচেষ্টা। অনার্য দেবতা চণ্ডী কোনো পৌরাণিক বিধি-বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন, তাই আরা প্রতিষ্ঠায় তিনি যে কোনো কর্মে প্রবৃত্ত হতে পারেন। সেই প্রচেষ্টায় তিনি সমাজের নিম্নস্তরে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা পেলেও উচ্চস্তর পর্যন্ত তিনি এগুতে পারেন নি। কাহিনীটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক্।
কাহিনীর গোড়াতেই দেবী চণ্ডী পৌরাণিক দেবী সতী, এবং উমা-পার্বতীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেও কবিকঙ্কণ কিন্তু পৌরাণিক পরিমণ্ডলে তাঁকে স্থাপন করেন নি। দেবীর জীবনধারা একাস্তভাবেই মানবিক, তাঁর কাহিনী রচনা করতে গিয়ে কবি একেবারেই নিম্নমধ্যবিত্ত গৃহস্থ ঘরের শরণ নিয়েছেন—যেখানে গিরিরাজ হিমালয় পত্নী মেনকা বলেন যে জামাইকে পুষতে গিয়ে গিরির গিরিয়ালি চলে যেতে বসেছে যেখানে জগন্মাতা ভগবর্তী কোমর বেঁধে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে বসেন। কৈলাসে হরগৌরীর জীবনযাত্রায় কলহ অনিবার্য হয়ে ওঠে, যার ফলে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই ঘর ছেড়ে চলে যেতে চান। বলা বাহুল্য, গভীর জীবনবোধ থেকেই কবির পক্ষে পৌরাণিক দেবদেবীদের এমন স্বাভাবিক মানব-জীবনযাত্রার পটভূমিতে উপস্থাপিত করা সম্ভবপর হয়েছে।
দেবী চণ্ডী মর্ত্যলোকে আপন মাহাত্ম প্রচারের জন্য মহাদেবের সহায়তায় ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে ব্যাধসস্তান কালকেতু রূপে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনলেন এবং তাকে প্রচুর ধনের অধিকারী করে দিয়ে গুজরাট রাজ্যের রাজা বানালেন। দেবী চণ্ডী বন্যায় কলিঙ্গদেশ ভাসিয়ে দিয়ে তথাকার প্রজাদের গুজরাটে নিয়ে এলেন। কিন্তু কলিঙ্গরাজের সঙ্গে যুদ্ধে কালকেতু পরাজিত ও বন্দী হ’লে দেবীর আদেশে কলিঙ্গরাজ কালকেতুকে মুক্তিদান করেন। এই কাহিনীতে দেখি, তখনও পর্যন্ত অনার্য ব্যাধের প্রাণধর্মী জীবনদর্শন উচ্চবর্ণের সমাজব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠা পায়নি, তবে সাধারণভাবে সমাজে কিছুটা স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছে। কাহিনীর এই কাঠামোর মধ্যে স্থানকালধৃত যে সকল চিত্র পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে তৎকালীন সমাজ জীবনের একটি সামগ্রিক রূপকে ফুটে উঠতে দেখি। তার কারণ, এ সকল চিত্রের রয়েছে কবিমানসের গভীর জীবনবোধ, এর অভাবে কোনো কবিই তার সমকালকে প্রত্যক্ষ ক’রে তুলতে পারেন না। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই, যে জীবন আপনাকে সাহিত্যের জগতে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, সেই জীবন একান্তভাবেই লৌকিক পৌরাণিক দেবদেবীরা ক্যহিনীর একটি অংশ জুড়ে থাকলেও কাব্যের আভ্যস্তরসা এবং মূলকথাই একান্তভাবে ইহজাগতিক ও মানবীয়। ঘটনা-বিশ্লেষণে এর মধ্যে আমরা অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরস্নার কথা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের কথাই শুনতে পাই। মুকুন্দ কবি ছিলেন সমকালীন সমাজজীবন বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন এবং এই কারণেই তার জীবনবোধও ছিল ব্যাপক ও বলিষ্ঠ।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বিভিন্ন চরিত্র-বিশ্লেষণেও আমরা কবিকঙ্কণের গভীর জীবনবোধের পরিচয় পেয়ে থাকি। কাহিনী-বিশ্লেষণকালে আমরা দেখেছি, গিরিজায়া মেনকা, উমারূপিণী আদ্যাশক্তি ভগবর্তী এবং দেবাদিদেব মহাদেবও সুখদুঃখের অতীত অমরাবতীর অধিবাসী নন, এঁরাও ধূলিমাটির এই ধরণীরই সম্ভান—যে কোনো মানব-মানবীর মতোই সুখদুঃখের অধীন; এঁরা যেন কবিরই প্রতিবেশী হর ঠাকুর আর গৌরী ঠাকুরুন। একান্ত সামাজিক জীবনবোধ এঁদের স্বর্গ থেকে নামিয়ে এনে ধরার বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ডিহিদার মামুদ সরীফের দ্বারা অত্যাচারিত কবি এবং তার প্রতিবেশীদের জীবনবোধ সম্প্রসারিত হয়েছে বনের পশুকুলের মধ্যে। কবির যে গভীর জীবনবোধ স্বর্গের দেবদেবীর মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল, কবিকঙ্কণের কাব্যে তার কবলে পড়েছে বনের পশুরাও, একালের সাহিত্যেও কবিরা এতখানি সাহস দেখিয়ে পশুদের মধ্যে এমন মানবিক জীবনবোধ সঞ্চারিত করতে পারেন কিনা সন্দেহ। এরি উল্টো পিঠের ছবি দেখতে পাই কালকেতু কর্তৃক গুজরাট নগর পত্তনে। দুঃখদারিদ্র্যপীড়িত কালকেতু জীবিকা সংগ্রহের প্রয়োজনে বনের পশুদের ওপর অত্যাচার করতে বাধ্য হয়েছিল, এখানে কালকেতুর ভূমিকা মামুদ সরীফের; এই কালকেতুই যখন দারিদ্র্যোর কবল থেকে মুক্তি পেলো দেবীর দয়ায়, তখন সেই দয়া সংক্রামিত হল কালকেতুর চিত্তেও। গুজরাটে বুলান মণ্ডলের নায়কত্বে যে সকল প্রজা এলো, কালকেতু সাধ্যমতো তাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করলো। মামুদ সরীফের অত্যাচারে নির্যাতিত কবি মুকুন্দের মনোজগতে যে আদর্শ সমাজব্যবস্থার চিত্র বর্তমান ছিল, সেই জীবনবোধেই তিনি কালকেতু চরিত্রের এই সমুন্নতি ঘটিয়েছেন।
ফুল্লরা দরিদ্রগৃহিণী – অভাব তার নিত্যসহচর, কিন্তু সে স্বামিপ্রেমধন্যা, স্বামীর ওপর তার অসপত্ন্য অধিকার। ছদ্মবেশিনী দেবী তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করেছেন, যাতে তাকে কিছুদিন থাকতে দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থের মোহ ফুল্লরাকে স্বামিপ্রেম থেকে বিন্দুমাত্রও টলাতে পারেনি। কী গভীর জীবনবোধের প্রত্যয়ে স্থিতধী এই ফুল্লরা—মানবসংসারে এর চেয়ে আদর্শ জীবনবোধ আর কোথায় পাওয়া যাবে।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দুটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র— ভাদ্ভদত্ত ও মুরারিশীল। কাব্যে এদের ভূমিকা খলের। কিন্তু খল হ’লেও এরা মানুষ মানুষের মধ্যে যেমন দেবতু আছে, তেমনি আছে পশুড়ও। দোষে-গুণে মিলে মানুষ। সংসারে আদর্শ মানুষ খুবই কম দেখা যায় দুর্বৃত্তের দেখা মিলে পদে পদে। কবিকঙ্কণ তার অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির সহায়তায় আমাদের পরিচিত জগৎ থেকে তুলে এনেছেন এই দু’টি চরিত্রকে। এদেরও আছে এক ধরনের জীবনবোধ—এই অতিশয় বাস্তব চরিত্র দুটিতে সেই জীবনবোধই উপস্থাপিত হয়েছে।
Leave a comment