দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যই চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়। মূলত দেবী ছিলেন অনার্য ব্যাধজাতির দেবতা। আর্যসমাজে যখন তিনি গৃহিতা হ’লেন, তখন কৌলীন্যদানের উদ্দেশ্যে তাঁকে পৌরাণিক দেবী শিব পত্নী সতী ও উমার সঙ্গে অভিন্ন রূপে দেখানো হয়। এই কারণেই গ্রন্থের প্রথমেই মহাদেব ও তার সংসার জীবনের কাহিনী বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য, এটিও যে দেবী চণ্ডীরই কাহিনী তা প্রতিপাদন করা।
মহাদেব ও তাঁর সংসারধর্ম বিষয়ে যে পরিচয় এখানে পাওয়া যায়, তাতে কিন্তু কোনো অলৌকিকতা নেই, এ একেবারেই নিম্নবিত্ত বাঙালী সংসারের কথা। কাজেই এই কাহিনীর মাধ্যমে আমরা সমকালীন জীবনের বাস্তবতা এবং কবির সমাজসচেতনতার যে পরিচয় লাভ করি, তা এই গ্রন্থের এক অমূল্য সম্পদ রূপে বিবেচিত হয়ে থাকে।
আমরা মহাদেবের সংসার জীবনের প্রথম পরিচয় পাই, দক্ষযজ্ঞে আমন্ত্রিত না হওয়া সত্ত্বেও সরকন্যা ও শিবপন্থী সতীর যজ্ঞদর্শনে যাবার অভিপ্রায়-জ্ঞাপনে মহাদেবের আপত্তি সত্ত্বেও সতী যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে বিবাহের পর অনেক কাল অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি পিতৃগৃহে যাননি, কিন্তু মায়ের রন্ধনে ভাত’ খাবার আকুলতা রয়েছে তাঁর। তা ছাড়া এ স্থানের এই সুদীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবনে তিনি বিষন্নতা অনুভব করেন। এই বলে তিনি আর শিবের অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করে পিতৃগৃহে গমন করেন। তথায় তিনি মায়ের আদর পেলেও তাঁকে যজ্ঞস্থলে পিতার মুখে পতিনিন্দা শুনতে হয়- ফলে তিনি স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন এবং হিমালয়ের গৃহে মেনকাগর্ভে উমা রূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন। এই জন্মে উমা কঠোর তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট কাঁরে তাকে পতিরূপে লাভ করেন। বিবাহের পর মহাদেব শ্বশুর গৃহেই থেকে গেলেন। শুরু হ’ল মহাদেবের সংসার জীবন।
কালক্রমে উমা গণেশ ও কার্ত্তিক – দুই পুত্রের জননী হ’লেন, তাদের কাছে তিনজন দাসী এবং মহাদেবের অসংখ্য অনুচর। সবাইকে নিয়ে মহাদেব শ্বশুরগৃহেই রয়েছেন রোজগারের কোনো চেষ্টা নেই। গিরিরাজ হিমালয়ের নিজের সংসারটি ছোট- তার সঙ্গে শিবের সংসার বৃদ্ধি পারার ফলে গৃহিণী মেনকার যেমন পরিশ্রম বাড়লো তেমনি অত্যধিক ব্যয়ে সংসারেও দেখা দিল অনটন। এই অবস্থায় একদিনের ঘটনা।
পার্বতী উমা সখী পদ্মাবতীকে নিয়ে পাশা খেলছেন, এমন সময় বিরসবদনে মা মেনকা এসেই রাগে ফেটে পড়লেন, বললেন—
‘তোমা ঝিএ হৈতে মজিল গিরিয়াল।
ঘরে জামাই রাখিয়া পুষিব কতকাল।।’
মেনকা অতিশয় বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। ঘুম থেকে উঠেই কার্ত্তিক-গণেশ থেতে চায়, কিন্তু ঘরে কোনো সঞ্চয় নেই। জামাতা শিব মিছে কাজে ঘুরে বেড়ান, চাষ-বাসও নেই, কাজেই বারোমাস তিনি ভাতকাপড় যোগাবেন কি করে? তা ছাড়া উমা নিজেও গৃহকর্মে মাকে কোনো সাহায্য করেন না—
‘দুগ্ধ উথলিয়া গেলে নাহি দেহ পানী।
পাশক খেলহ ঝিএ দিবস রজনী।’
অতঃপর কৈলাসে হরগৌরীর ঘর সংসারের কাহিনী। সংসার যাত্রা নির্বাহের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা নেই মহাদেবের। তাই তিনি গৌরীর সঙ্গে যুক্তি করে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করলেন। ত্রিদশেখর ডমরু বাজিয়ে ঘরে ঘরে ভিক্ষা ক’রে বেড়ান একদিকে যেমন—
‘কপালে চাদের ফেঁটা বাসুকি গলাতে পাটা
অঙ্গ শোভে বিভূতি ভূষণে।
মাথাতে বেড়িত ফণী অমূল্য যাহার মণি
সর্পের কুণ্ডল দোলে কানে।’
অন্যদিকে গলায় হাড়ের মালা আর হাতে লাউ ফল নিয়ে যান কোচ-পটিতে। কোচবধূর দেওয়া চাল রাখেন ঝুলিতে অন্যেরা ‘কেউ দেয় চাল কড়ি, কেই দেয় ডাল বড়ি তেলী দেয় কুপী ভ’রে তেল’–এইভাবে নানা দ্রব্য নিয়ে বেলা দু’প্রহরের সময় মহাদেব ঘরে ফিরে আসেন। কার্ত্তিক গণেশও সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত— তারপর,
‘দেখিয়া মোদক খই দোঁহে আলা ধাওয়া ধাই
কোন্দল লাগিল দুই ভাইয়ে।’
পরদিন প্রভাতে নিত্যক্রিয়া সমাপনাস্তে মহাদেব দুই পুত্রকে দুই পাশে নিয়ে বসে গৌরীকে জানালেন—
‘কালি ভিক্ষা কৈলু আমি ভ্রমি বহু ধামে।
সকালে ভোজন করি থাকিব আশ্রমে।।’
এদিন আর তিনি ভিক্ষায় বেরুবেন না, ঘরে থেকে বিশ্রাম করবেন এবং তৃপ্তি ক’রে খাবেন। এর পর কোন কোন খাদ্যবস্তু তিনি খাবেন সেগুলি কী ভাবে রান্না হবে, তা তিনি বিস্তৃতভাবে বুঝিয়ে দেন—নিম সীম বেগুন দিয়ে তিতো রান্না হবে, শীতের উৎকৃষ্ট খাদ্য শুক্তো হ’বে কুমড়া বেগুন দিয়ে তাতে পড়বে নটীয়া কাঠালবীচি, ফুলবড়ি আর আদার রস। সরষে তেল দিয়ে হ’বে সরষে শাক, বধুয়া শাক ভাজা হবে কড়া পাকে, টাবাজল দিয়ে হ’বে মুসুরী ডাল, ওড় দিয়ে করমচার অম্বল, ফুলবড়ি ঘিয়ে ভেজে দুধে ফেলা হবে। কাচ পলতায় হবে চচ্চড়ি। ছোলার ডালে পড়বে গুড় এতে একটু বেশি সময় লাগবে। কুমড়ো বড়ি দিয়ে মানের বেসার—তাতে পড়বে কাঠালবীচি আর ঘৃত জিরা সাঁতলে রান্না হ’বে পালং শাক। সবশেষে একটু ক্ষীর তৈরি করতে হবে। অতএব, মহাদেব বলেন—
‘ঝাট স্নান কর গৌরী না কর বিলম্ব।’
কৃতাঞ্জলি হয়ে গোরী জানালেন যে ভিক্ষার চাল দিয়ে ধার শোধ ক’রে যা বাকি ছিল, তা’ আগের দিনই তিনি রান্না করে ফেলেছেন, অতএব—
রন্ধন করিতে ভাল বলিলে গোঁসাই।
প্রথমে যে দিব পাতে তাই ঘরে নাই।।
অর্থাৎ মা অন্নপূর্ণার ভাঁড়ে মা ভবানী। তবে উপায়? হ্যা, উপায় একটি আছে—
‘আজিকার মত যদি বান্ধা দেহ শূল।
তবে সে আনিতে পারি প্রভু হে তণ্ডুল।।’
দেবীর এ কথায় মহাদেবের হ’ল অভিমান। তিনি স্থির করলেন, আর ঘরে থাকবেন না। কারণ গৃহবাসে তিনি কোন সুখ পাচ্ছেন না। তিনি কষ্ট ক’রে ভিক্ষা ক’রে আনেন, কিন্তু কিছুই বাড়তি থাকে না অথচ প্রচুর অপচয় হয়। মহাদেবের বাহন বলদ এবং ভূষণ সাপগুলির ওপরও চলে অত্যাচার। সংসারে তার অভাব ও দুঃখকষ্টের জন্য তিনি দায়ী করেন দেবীকে—
‘গৃহিণী দুর্জন ঘর হৈলা বন
বাস করি তরুতলে।’
অতএব তিনি স্থির করলেন—
‘আমি ছাড়ি ঘর যাব দেশাস্তর
কি মোর ঘর-করণে।’
মহাদেব তাঁর সম্বলাদি নিয়ে নন্দীকে সঙ্গে ক’রে ঘর ছেড়ে গেলেন; সব দেখেশুনে দেবী তো অবাক্। তার কোনো দোষ নেই, অথচ সবকিছুর জন্য তাকেই দায়ী করা হল। তাই তিনি বড় আক্ষেপ করে বলেন—
“কি জানি তপের ফলে বর মিলেছে হর।
পাট পড়শি নাহি আসে দেখি দিগম্বর।।
দারুণ দৈবের ফলে হইনু দুঃখিনী।
ভিক্ষার ভাতে দারুণ বিধি করিল গৃহিণী।।…
উচিত কহিতে আমি সবাকার অরি।
দুঃখ যৌতুক দিয়া পিতা বিভা দিল গৌরী।।’
অতএব এই দুঃখের সংসারে তিনিই বা থাকবেন কেন? তিনিও সখী পদ্মাকে ডেকে বল্লেন যে তিনি গৃহত্যাগ করবেন। পদ্মাবতীই দেবীকে বোঝালেন যে এইভাবে গেলে পিতৃগৃহেও আদর পাওয়া যাবে না। তিনি মর্ত্যলোকে আপনার পূজা করলেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। হরগৌরীর সংসার পর্ব এখানেই শেষ।
এরপরই পার্বতী মহাদেবকে অনুরোধ জানান, তিনি যেন কোনো ছলে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে শাপভ্রষ্ট ক’রে মর্ত্যলোকে পাঠান, দেবী তাকে অবলম্বন ক’রেই মর্ত্যলোকে আপন মাহাত্ম্য প্রচার করলেন। এই শাপভ্রষ্ট নীলাম্বরই ব্যাধসস্তান কালকেতু এবং তাকে নিয়েই মূল কাহিনী। দেবী চণ্ডী এইভাবেই পৌরাণিক দেবীর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন।
Leave a comment