দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ ক’রে উমা-পার্বতীরূপে হিমালয়-গৃহে মেনকা গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং এজন্মেও মহাদেবের সঙ্গে বিবাহিতা হন। বিবাহের পর মহাদেব ঘরজামাই হ’য়ে হিমালয়েই রয়ে গেলেন। এখানে কিছুকাল পর মা মেনকার সঙ্গে ঝগড়া ক’রে পার্বতী পতিগৃহ কৈলাসে চলে আসেন স্বামী-পুত্রসহ মহাদের সংসার যাত্রা নির্বাহের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন কিন্তু তাতেও সংসারের অভাব দূর হয় না, ফলে এ নিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া হয় স্বামী-স্ত্রীতে। রাগ ক’রে মহাদেব সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে পার্বতীও অত্যস্ত ক্ষোভের সঙ্গে প্রকাশ করেন যে বিনা অপরাধে মহাদেব তাকে কটূক্তি করেছেন, অতএব তিনিই ঘর ছেড়ে যাবেন, মহাদেবই বরং তার সংসার নিয়ে থাকুন।
এ সময় পার্বতীর সখী পদ্মাবতী দেবীকে মর্ত্যলোকে তার পূজা প্রচারের কথা জানালেন। দেবী প্রথমে কলিঙ্গরাজের পুজা নিয়ে বনের পশুদের পুজা গ্রহণ করবেন। ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর কালকেতু রূপে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করলে দেবী তাঁর পূজা নিয়ে দেবকন্যা রত্নমালার মর্ত্যবিগ্রহ ফুল্লরার পূজা নেবেন। পদ্মাবতীর মুখে দেবী তার ভবিষ্যৎ পূজাকাহিনী শুনে বিশ্বকর্মাকে কলিঙ্গরাজ্যে দেবীর দেউল নির্মাণ করতে আদেশ দিয়ে কলিসরাজকে স্বপ্নাদেশে দেবীর পূজার নির্দেশ দিলেন। এই অনুসারে বিশ্বকর্মা-নির্মিত দেউলে কলিঙ্গরাজ দেবীর পূজা করলেন। দেবী এখান থেকে পুজা নিয়ে বনের পশুদের পূজা গ্রহণ করলেন এবং সেখানে সিংহকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে পশুদের অভয় দান করে কৈলাসে ফিরে এলেন। ইতিমধ্যে মহাদেবও মর্ত্যলোকের মানুষদের, জন্ম-আদি অসুরদের এবং স্বর্গে ইন্দ্রের পূজা করে কৈলাসে এসে পার্বতীর কাছে তাঁর পূজা প্রচারের কাহিনী জানতে চাইলেন। দেবী তখন মহাদেবের চরণে প্রণতা হ’য়ে জানালেন—
‘অষ্ট দিন পূজা মোর অবনী ভিতর।
তিন দিনের কথা তার নিয়া নীলাম্বর৷৷
নীলাম্বরে শাপ দিয়ে যদি লহ ক্ষিতি।
তবে সে প্রচার মোর পূজার পদ্ধতি।।’
স্বামী মহাদেবের সঙ্গে ঝগড়া করেই দেবী পার্বতী মর্ত্যলোকে পূজা প্রচারের সঙ্কল্প নিয়েছিলেন, এখন আবার মহাদেবের সহায়তাতেই তিনি সঙ্কল্প সিদ্ধ করতে চাইছেন। যাহোক, পার্বতীর অনুরোধ রক্ষার্থে মহাদেব কিছু ছলনার আশ্রয় নিলেন। উদ্দেশ্য সিদ্ধির যন্ত্ররূপে গ্রহণ করলেন তিনি নারদকে। নারদ ইন্দ্রের রাজসভায় উপস্থিত হয়ে জানালেন যে জড়াসুর শিবের বরে অসাধ্যসাধনের শক্তি অর্জন করেছেন, অতএব তার ভয়—
‘পাইয়া শিবের বর দৈত্য হৈলা পরতর
কোনদিন করে গণ্ডগোল।’
অতএব ই ভীত হয়ে শিবপূজা করে দোদেবকে তুষ্ট করতে উদ্যোগী হলেন এবং বিভিন্ন জনকে শিবপূজার আয়োজনের ভার দিলেন। পুত্র নীলাম্বরকে বললেন পূজার ফুল সংগ্রহ ক’রে আনতে। ইন্দ্রের আদেশ দানকালে টিকটিকি ডেকে উঠলো— দৈবক্রমে নীলাম্বর ছাড়া অপর কেউ তা শুনতে পেলো না কাছেই বাধা পেয়ে নীলাম্বর পুষ্পচয়নে আপত্তি ক’রে বলে—
‘পুষ্প তোলার জন্য জনে কর আরতি।’
নীলাম্বরের আপত্তিতে ইন্দ্ৰ বিরক্ত হলে নীলাম্বর ভয়ে সম্মতি জানিয়ে ফুলের সাজি হাতে নন্দনকাননে প্রবেশ ক’রে নানা জাতির ফুল চয়ন করলো। সেই ফুলে ইন্দ্র শিবপূজা করেন- এইভাবে বারো বৎসর ইন্দ্র শিবপূজা করবেন, নীলাম্বর প্রতিদিন ফুল নিয়ে আসে। একদিন মহাদেবের সঙ্গে ষড়যন্ত্র ক’রে দেবী চণ্ডী মায়া পাতলেন। ফলে—
‘ফুলহীন কৈল মাতা নন্দন কানন।
ফুলহীন হৈল যতেক উপবন।।’
নন্দনকাননে ফুল না পেয়ে নীলাম্বর ফুলের সন্ধানে বিজুবনে গিয়ে উপস্থিত হ’ল। হঠাৎ তার নজরে পড়লো অদ্ভুত দৃশ্য। ধর্মকেতু ব্যাবের তাড়া খেয়ে মৃগরূপিণী দেবী ছুটে চলেছেন—
‘আগে যান ভগবর্তী দীঘল তরঙ্গ।
তার পাছে ব্যাধ যেন উড়িছে পতঙ্গ।’
ফুল তোলার কথা ভুলে গিয়ে নীলাম্বর ভাবতে লাগলো ব্যাধের স্বাধীন জীবনের কথা। তার মনে হল—
‘হৃদয়ে রহিল শাল বেয়াধ জনম ভাল
কেনে হইনু ইন্দ্রের কোত্তর।।’
তারপর হঠাৎ ফুল তোলার কথা মনে হওয়াতে নীলাম্বর আর বাছ-বিচার না করে ফুল তুলতে আরম্ভ করে।
মহাদেব অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে কটূক্তি করলে ভীত ইন্দ্র জানালে—
‘মোর দোষ নাহি পুষ্প তোলে নীলাম্বর।’
মহাদেব নীলাম্বরকে সত্য কথা প্রকাশ করতে বললে নীলাম্বর জানালো যে ব্যাধকে শিকার করতে দেখে সে অন্যমনস্ক হয়ে ফুল তুলেছিল। তখন মহাদেব তাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন—
‘মোর সেবা ছাড়ি তুমি অন্য কর সাধ।
বসুমতী চল ঝাট হও গিয়া ব্যাধ।’
মহাদেবের অভিশাপ ব্যর্থ হবার নয়। নীলাম্বরকে অবশ্যই মর্ত্যলোকে গিয়ে ব্যাধজীবনযাপন করতে হবে, তৎসত্ত্বেও মহাদেবের নিকট তার সকাতর প্রার্থনা তিনি যেন দয়া করে নীলাম্বরকে কৃপা করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন—
‘অবনীমগুলে যাব চণ্ডীর কিঙ্কর হব
এই বর দিয়া পুর কাম।’
লজ্জিত মহাদেব নীলাম্বরকে বর দিলেন যে মাত্র কুড়ি বৎসর মর্ত্যলোকে বাস করেই নীলাম্বর আবার স্বর্গে ফিরে আসবে।
মন্দাকিনী জলে নীলাম্বর দেহত্যাগ ক’রে মর্ত্যলোকে ধর্মকেতু-পত্নী নিদয়ার গর্ভে আশ্রয় নিলেন এবং যথাকালে কালকেতু নামে জন্মগ্রহণ করেন। এদিকে নীলাম্বর-পত্নী ছায়াও পতির সঙ্গে সহমৃতা হন এবং মর্ত্যলোকে সঞ্জয়কেতু-পত্নী হীরার গর্ভে ফুল্লরা নামে জন্মগ্রহণ করে। মর্ত্যলোকেও কালকেতু-ফুল্লরা স্বামী-স্ত্রীরূপে জীবন-যাপন করে।
Leave a comment