‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্য’-এর দেবী চণ্ডী ছিলেন মূলত বন্য পশুদের অধিষ্ঠাত্রী। এই কারণেই দেখা যায় বনের পশুদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দেবী চণ্ডীর রয়েছে অতিশয় সক্রিয় ভূমিকা। কাব্যে দুইবার পশুদের সঙ্গে চণ্ডীকে দেখতে পাওয়া গেছে।
দেৱী চণ্ডী মর্ত্যলোকে প্রথম পূজা গ্রহণ করেন কলিঙ্গরাজের। সেখান থেকে ফেরবার পথে বিজুবনে পশুরা সব চণ্ডীর দর্শন পেলো। তারা দেবীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ ক’রে অভয় চাইলো।
‘অপরাধ বিনে পশু সদাই সশস্ক।
বর দিয়া ভগবতী কর নিরাতঙ্ক।।’
দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের বরদান করলেন সবাই অবিরোধে থাকবে, কেউ কাউকে হিংসা করবে না—
‘যেজন যাহার শত্রু থাক মিত্রভাবে।
থাকিবে আনন্দে সবে কেহো না হিংসিবে।।’
এর পর তিনি সিংহকে পশুরাজ বলে অভিষিক্ত ক’রে অন্যান্য পশুদের যথাযোগ্য পদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তারপর বিদায় নিয়ে তিনি চলে গেলেন।
এরপর বিভিন্ন কাহিনী। ব্যাধসস্তান কালকেতু বিয়ে করে সংসারী হ’ল, সংসার পরিচালনার দায়িত্ব তার কাঁধে পড়ায় সে শিকারে মনোযোগী হ’ল, ফলে বনের পশুদের মধ্যে সন্ত্রাসের সৃষ্টি হ’ল। পশুরা সিংহের নিকট নালিশ জানালো। প্রজাদের দুঃখের বিবরণ শুনে পশুরাজ সিংহ মানবসস্তান কালকেতুর উচিত শাস্তিবিধানের জন্য প্রস্তুত হ’ল। কালকেতু প্রতিদিনের মতোই যথা নিয়মে বনে প্রবেশ করলো। সিংহ সংবাদ পেয়ে কালকেতুকে আক্রমণ করলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত হ’ল—দেবীর বাহন বলেই সিংহকে কালকেতু হত্যা করলো না।
পশুরা পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চণ্ডীর শরণাপন্ন হ’ল—
উপনীত হৈল পশু তমাল তরুমূলে।
প্রদক্ষিণ নমস্কার করিল দেউলে।।
সেখানে দাঁড়িয়ে পণ্ডরা একে একে নিজেদের দুঃখের কথা জানাতে লাগলো। সিংহ যে অতিশয় ক্ষুব্ধ, বিধ্বস্ত এবং মর্মাহত হয়েছিল, তা তার উক্তি থেকেই বোঝা যায়—
ভালে টীকা দিয়া মাগো করিলে মৃগরাজ।
করিব তোমার সেবা রাজ্যে নাহি কাজ।
শরভ করভ অভিমান করে জানালো যে অতিশয় দ্রুত ধাবনের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা কালকেতুর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। দেবী তাঁকে পশুদের পুরোহিত ক’রে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাকেও উদর-জ্বালার সঙ্গে সহোদরের মৃত্যুশোক সহ্য করতে হচ্ছে। পশুদের দুর্দশার অস্ত নেই বলে তারা দেবীর নিকট পরিত্রাণ কামনা করছে। ভালুকেরও বড় দুঃখ, তার সাত পুত্র, স্ত্রী এবং নাতি সকলেই বীরের হাতে মৃত্যুবরণ করায় সে নির্বংশ হ’তে চলেছে, অথচ সে তো অত্যন্ত সাধারণ প্রাণী—
‘উই চারা খাই আমি নামেতে ভালুক।
নেউগী চৌধুরী নই না করি তালুক।।’
তবে তার কেন বার্ধক্যে এই দুর্দশা।
আদি বীর বরাহও জানায় যে সে মুথাভোজী, জীবিকার জন্যও কাউকে সে হিংসা করে না, তৎসত্ত্বেও তার বেন স্বামী, পুত্র, শাশুড়ি, ননদ, ভাসুর সবাই কালগ্রাসে পতিত হয়? বরাহ এদের কারো কথা ভুলতে পারছে না।
ধূলায় ধূসর হস্তিনী তার শ্যামলসুন্দর কমললোচন পুত্রের কথা স্মরণ করে কাঁদছে, সে দেখছে, তার তো বাঁচবার কোনো উপায় নেই।
‘বড় নাম বড় গ্রাম বড় কলেবর।
লুকাইতে স্থল নাই অরণ্য ভিতর।।
কি করিব কোথা যাবো কোথা গেলে তরি।
আপনার দস্ত হৈল আপনার বৈরী।।’
মকটি বড় দুঃখ ক’রে বলে যে তার বৃদ্ধ পিতামহ ছিল রামচন্দ্রের সেনাপতি, সাগর বন্ধন ক’রে রামচন্দ্রের হিতসাধন করেছিল, অথচ তার কপাল-দোষে সাতপুত্রই কালকেতুর জালে বাঁধা পড়লো। বারসিঙ্গা, তুলারু, ঘোড়ারু, ঢোলকান—সব জাতীয় হরিণ ধূলায় লুটিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে—
‘কেন হেন জন্ম বিধি কৈল পাপবংশে।
হরিণ ভুবন বৈরি আপনার মাংসে।।’
সজারু শশারুরাও ভূমিতে পড়ে কেঁদে বলে যে গর্তের ভিতর লুকিয়ে থেকেও নিস্তার নেই— বীর গর্তের ভিতর জল ঢেলে দিয়ে তাদের বের করে আনে। এদেরও স্ত্রী পুত্র কন্যা সব বীরের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে। এইভাবে সকল পশু যখন একজোটে নিজেদের দুঃখের বিবরণ জানাতে লাগলো, তখন—
‘ধেয়ানে জানিল মাতা পশুর রোদন।’
পদ্মাবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে দেবী চণ্ডী পশুদের সামনে দেখা দিলে বড় আক্ষেপের সঙ্গে পশুরাজ বলে—
‘অন্যের সেবক হৈলে সর্বয়েতে তরি।
তোমার সেবক হৈয়া সবংশেতে মরি।।’
দেবী তখন জনে জনে তাদের দুঃখের কথা জানতে চাইলে একে একে সিংহ, বাঘিনী, মহিষ, গজ, গণ্ডার, বানর, মুদ-আদি পশুরা প্রত্যেকের দুর্দশার কথা জানালে দেবী তাদের প্রশ্ন করেন, তারা প্রত্যেকেই এত বড় বীর হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ কালকেতুকে এত ভয় পায় কেন আর কেনই বা তার হাতে এত মার খায়? এরা প্রত্যেকেই কালকেতুর দূর থেকে তাঁর নিক্ষেপের এবং অদ্ভুত পরাক্রমের কথা বলে জানায় কালকেতুর সঙ্গে পেরে ওঠা ওদের সাধ্য নাই।
এর পর দেবী চণ্ডী তাদের আশ্বাস দান ক’রে বলেন—
‘আজি হৈতে মনে কিছু না করিহ ভয়।
না বধিবে মহাবীর কহিনু নিশ্চয়।।’
দেবী তার কথা রক্ষা করেছিলেন এর পর কালকেতুকে তিনি প্রচুর ধন দিয়ে রাজা করে দেওয়াতে কালকেতুর আর শিকারের প্রয়োজন দেখা দেয়নি, পশুরাও আর কালকেতুর হাতে অত্যাচারিত হয়নি।
বনের পশুদের মনে দুঃখ হতে পারে, তারা কাদতেও পারে, কিন্তু তাদের কান্না থেকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখকাহিনী উদ্ধার করা কোনো মানুষের কর্ম নয়। কিন্তু এখানে বনের পশুদের যে দুঃখবেদনার কাহিনী কবিকল্পণ লিপিবদ্ধ করেছেন, তা নিজস্ব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। কারণ এই দুঃখ বেদনা-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে কবি মুকুন্দ ডিহিদার মামুদ সরীফের অত্যাচারে জর্জরিত কৃষক প্রজাদের আতধ্বনিই শুনতে পেয়েছেন। এবং শুধু তাই নয়, কবি মুকুন্দও ছিলেন এই অত্যাচারিতদেরই একজন, তাদেরই দুঃখবেদনার শরিক। এই দুঃখবেদনা কবির উপলব্ধিজাত বলেই তা’ এত আন্তরিক, বাস্তব এবং বিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে। পশুদের দুর্দশা যে প্রজাদেরই দুর্দশা, তা স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ ক’রে গেছেন মুকুন্দ চক্রবর্তী। তিনি যখন ভালুকের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করান- ‘নেউগী চৌধুরী নই না করি তালুক’—তখন আর আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, লিখতে বসার পর এখানে কবির মনশ্চক্ষে তার তালুকদার গোপীনাথ নিয়োগীর চিত্রটিই উদ্ভাসিত হ’য়ে উঠেছিল। শুধু গোপীনাথ নিয়োগীই নয়, কবির লেখায় বিভিন্ন জাতীয় পশুর কাতরোক্তিতে ধনি-দরিদ্র ছোট-বড় নানাশ্রেণীর প্রজার অস্তরভেদী ক্রন্দনই ধ্বনিত হয়েছে। কবির সমকালের তাঁর স্বগ্রানের ইতিহাস আমাদের অজ্ঞাত যদি জানা থাকতো, তবে হয়তো পশুদের কাতর ক্রন্দনের মধ্যে গোপীনাথ নিয়োগীর মতো কবির অপর প্রতিবেশীদেরও সন্ধান পাওয়া যেতো। কাজেই পশুদের এই ক্রন্দন নিছক পাশবিক ব্যাপার নয়, এর মধ্যেই রয়েছে মানবিক আর্তনাদ ও পরিত্রাণের উপায় সন্ধান। পশুদের ক্রন্দন রূপক মাত্র, এর আবরণ-উন্মোচন করলেই আমরা এর যথার্থস্বরূপ উপলব্ধি করতে পারবো। এই বিশেষ কারণেই ‘পশুদের ক্রন্দন’ অংশটি একটি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যকে সমসাময়িক অপরাপর কাব্যের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে সংস্থাপিত করেছে।
Leave a comment