বিদগ্ধ পণ্ডিতমণ্ডলী অনুমান করেন যে আদি আর্যভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠী তথা আর্যজাতিই মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রবর্তক এবং এই সুত্রে ভারতীয় আর্যজাতিও ছিল পিতৃতন্ত্রের অনুগত। পক্ষান্তরে ভারতের প্রাগার্য তথা অন আর্য জনগোষ্ঠী (দ্রাবিড়, অস্ট্রীক বা নিষাদ এবং মঙ্গোল বা কিরাতগণ) ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অনুগামী একালেও যার প্রমাণ বর্তমান। ফলে আর্যদের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক চিন্তায় পুরুষ দেবতার প্রাধান্য, আর প্রাগার্য চিন্তাধারায় নারীদেবতাই বোধ হয় সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে। প্রাগার্য হরপ্পা-মোহন-জো দড়ো সভ্যতায় মাতৃমূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়, পক্ষাস্তরে আর্যদের মহাগ্রন্থ বেদে পুরুষদেবতারই প্রাধান্য ছিল। অর্বাচীন বৈদিক যুগে, সম্ভবত প্রাক্-আর্য-প্রভাববশতই, বেদে অল্পসংখ্যক স্ত্রী-দেবতার পরিচয় পাওয়া যায়– প্রসঙ্গক্রমে বেদের ‘দেবাসৃক্ত’ এবং ‘রাত্রিসূক্তে’র কথা উল্লেখ করা চলে।
দেবীসুক্তেই মাতৃকাশক্তি ‘আদিশক্তিদেবতা’ রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এর প্রথম ঋক্টি-
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহ
মাদিত্যেরুত বিশ্বদেবৈঃ
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভৰ্মাহ
মিশ্রামী অহমশ্বিনোভা।
–(একাদশ) রুদ্র (অষ্ট) বসু, (দ্বাদশ) আদিত্য এবং বিশ্বদেবগণ-রূপে আমিই নিখিল বিশ্বে পরিভ্রমণ করি; মিত্র ও বরুণ, ইন্দ্র ও অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আমি ধারণ করি।
ঋগ্বেদের একটি ‘রাত্রিসূক্তে “রাত্রির যে রূপময়ী অভয়দাত্রী মূর্তি অঙ্কিত হইয়াছে, তাহা ‘কালরাত্রি মোহরাত্রি’ রূপা মহাকালের রুদ্রসুন্দর রূপপ্রতিমা।”—সুক্তটি এরূপ—
রাত্রি ব্যখ্যদায়তী পুরুৱা দেব্যক্ষভিঃ …
রাত্রি স্তোমং ন জিণ্ডাষে— ১০।১২৭
সামবেদে শবরী দেবী ‘রাত্রি’ রূপে স্তুতি লাভ করছেন—
ও রাত্রিং প্রপদ্যে পুনর্ভূং ময়োভূং কন্যাং
শিখণ্ডিনীং পাশহস্তাং যুবতীং কুমারিণীম্।
আরও পরবর্তীকালে উপনিষদে ‘উমা হৈমবতী’র সন্ধান পাওয়া যায়। কালক্রমে আর্য অনার্য সভ্যতা-সংস্কৃতির সমন্বয়ের ফলে বিভিন্ন আর্য ধারণায় স্ত্রী-দেবতা তথা শক্তিদেবতার প্রাধান্য সুচিত হয়। এর পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন পুরাণে এবং বিশেষভাবে তন্ত্রশাস্ত্রে।
তান্ত্রিকগণ বিশ্বাস করেন যে তন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছিল দেব-পূর্ব যুগেই। এই বিশ্বাসে কিছুটা সত্যতা থাকা সম্ভব এই কারণে যে প্রাগ্-আর্যযুগে যে মাতৃকাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় তার সঙ্গে তন্ত্রের যোগ থাকা স্বাভাবিক। বস্তুত, তন্ত্র আর্য-প্রণীত শাস্ত্র হলেও তাতে আদিম সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। অথবা আরো স্পষ্ট করে বলা চলে যে আর্য ও আর্যেতর ধারার সংমিশ্রণেই তন্ত্রের সৃষ্টি। তন্ত্রে গণেশ -শিবাদি বিভিন্ন পুরুষ দেবতার পূজার নির্দেশ থাকলেও তন্ত্রের প্রধান উপাস্যা মাতৃকাশক্তি। বিভিন্ন বৈদিক স্ত্রী-দেবতা (রাত্রি, সরস্বতী, ঊষা প্রভৃতি), পৌরাণিক স্ত্রী-দেবতা (দুর্গা, লক্ষ্মী, গঙ্গা প্রভৃতি) কিংবা বিভিন্ন লৌকিক স্ত্রী-দেবতা (মঙ্গলচণ্ডী, শীতলা, মনসা, ষষ্ঠী প্রভৃতি) প্রত্যেকেই শক্তিদেবতা। এমন কি পরমভাগবত বৈষ্ণবগণও ‘রাবাতন্ত্র’ রচনা ক’রে ঐ তন্ত্রমতে বৈষ্ণব সাধনায় ব্রতী হ’য়ে থাকেন; অতএব সেই মতে ব্রজবিলাসিনী শ্রীমতী রাধিকাও তন্ত্রমতে একজন শক্তিদেবী। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ শক্তির উপাসনা করতেন বলে ‘রাধাতন্ত্র’ উল্লেখ করা হয়েছে। এককথায় বলা চলে, উপাস্যা যে কোন স্ত্রী দেবতাই কার্যত ‘শক্তি’ রূপে পরিচিতা, ‘শক্তি’ নামে অভিহিতা। কিন্তু এঁদের মধ্যেও বিশেষভাবে বিভিন্ন রূপে এবং নামে শিব পত্নীই ‘আদ্যাশক্তি পরমা প্রকৃতি’-রূপে অভিহিত হয়ে থাকেন। শক্তি দেবী রূপে তিনিই ‘দুর্গা’, উমা, পার্বতী, কালী, তারা প্রভৃতি নামে পরিচিতা। এই দেবীর উপাসকগণই ‘শাক্ত’ নামে এবং দেবীর মাহাত্ম্য-সুচক সাহিত্যই শাক্ত-সাহিত্য’ বা ‘শাক্ত পদাবলী’ নামে কীর্তিত হয়ে থাকে।
বাংলা সাহিত্যে প্রথম শক্তিদেবতার সাক্ষাৎ লাভ করি ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে। অবশ্য এরও পূর্বে রচিত ‘মনসামঙ্গল কাব্যে’র দেবী মনসাও স্ত্রী-দেবতা এবং সেই হিসেবে শক্তি রূপে পরিগণিতা হলেও ইনি ‘শিবপত্নী’ নন, এর পরিচয় ‘শিবকন্যা’ রূপেই, যদিচ ইনি শিবপত্নী চর্চার প্রতিদ্বন্দ্বিনী। শিব-পত্নী শক্তি-স্বরূপিণী চণ্ডীই তাই বাংলা সাহিত্যে প্রথম শক্তিদেবতা। তার মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য শাক্তসাহিত্য হলেও ‘শাক্ত পদাবলী’ নয়—শাক্ত পদাবলীর উদ্ভব ঘটেছিল আরও পরবর্তীকালে। ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দেবী চণ্ডীর সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক ছিল যতটা ভয়ের, ততটা ভক্তির নয়। লোভ দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে দেবী পূজা আদায় করেছেন বটে তবে ভক্তের হৃদয় মন্দিরে তখনো তার প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। তারপর দীর্ঘদিন গত হয়েছে, পরিবেশ পরিবর্তনে দেবীর সঙ্গে ভক্তের পারস্পরিক সম্পর্কেরও রূপাস্তর ঘটেছে। অনার্যকুলোদ্ভূতা চণ্ডী জগজ্জননী কালীমাতায় রূপান্তরিতা হয়েছেন অথবা তাঁরই দেহে লীন হয়ে গেছেন। এবার আর ভয়-ভক্তি নয়, ভক্ত এখন সস্তান, প্রাপ্তি কামনায়ই সে মায়ের কাছে হাত বাড়ায়। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদের হাতেই মায়ের এই বিশেষ রূপটি ধরা পড়ে- রামপ্রসাদই প্রথম শাক্তপদে মাকে নতুনভাবে রূপায়িত করেন।
চৈতন্যদেব সমগ্র বঙ্গভূমিতে একটা নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। তার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বাঙালী ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ রচনার মধ্য দিয়ে একটা সমুন্নত এবং আধ্যাত্মিক আদর্শ স্থাপন করেছিল। চৈতন্য তিরোভাবের পরও বেশ কিছুকাল তাঁর প্রভাব প্রবলভাবে বর্তমান ছিল। তারপরই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দিল্লী থেকে সুদূরে অবস্থিত গৌড়-বঙ্গ তথা সমগ্র বাংলাদেশেও একটি সামগ্রিক অবক্ষয়ের চিহ্ন দেখা দিল। এক সময় চৈতন্যদেবের সমুন্নত ব্যক্তিত্ব সামূহিক বিপর্যয়ের মুখে বাঙালীর সামনে যেমন একটি বিরাট আদর্শরূপে বর্তমান ছিল, তেমন কোনো ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব না ঘটায় বাঙালী যেন চোখে অন্ধকার দেখলো। এ যুগটি ছিল অবক্ষয়ের যুগ। অবক্ষয় যেমন সমাজদেহে বর্তমান ছিল, তেমনি অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল বৈষ্ণব পদাবলীতেও। সহজপন্থী বৈষ্ণব সাধনার প্রতি গৃহী মানুষের মন ছিল বিরূপ। তা ছাড়া বৈষ্ণব কবিতার সাহায্যে নতুনভাবে উজ্জীবন ঘটানোর মতো প্রতিভারও ছিল অভাব। বৈষ্ণব পরকীয়া তত্ত্ব অত্যধিক প্রাধান্যলাভের ফলে সমাজজীবন তথা গৃহস্থজীবন থেকে নির্বাসিত হ’য়ে স্থান পেল গ্রামপ্রাস্তে অবস্থিত বোষ্টম বোষ্টমীর আখড়ায়। সামাজিক মানুষের সঙ্গে এর হৃদয়ের যোগ ছিল না। অনুরূপ পটভূমিকায়, এই সামগ্রিক অব্যবস্থায় প্রথমে অদ্ভুত একজন কবিসাধক জগজ্জননীর নিকট শরণ গ্রহণের মধ্যেই আত্মরক্ষার উপায় দেখতে পেয়েছিলেন—সর্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে ছিল যেন একটি স্থির বিদ্যুৎ। কবি রামপ্রসাদ একেবারই দেবীর নিকট সুখদুঃখসমন্বিত জীবন নিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। তিনিই সম্ভবত সর্বপ্রথম আদ্যাশক্তি জগজ্জননীর উদ্দেশ্যে রচনা করেন কিছু পদ এবং তার সমকালেই আরও অনেকে করলেন তার অনুসরণ। তাঁদের রচিত এই পদগুলিই সাধারণভাবে ‘শাক্ত পদাবলী’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
এই শাক্তপদগুলির রচয়িতা শক্তিসাধক কবি বৈষ্ণব কবিদের মতো বিষয় বিমুখ ছিলেন না। তারা ছিলেন সংসারধর্মী, বিষয়-প্রত্যাশী; তাই তাদের কাব্যে “পদের ফাঁকে ফাঁকে, উল্লেখে-ইঙ্গিতে-তুলনায় রূপকল্পে সমাজ জীবনের বাস্তব সমস্যা ছায়াপাত করিয়াছে। এখানে আমরা ডিক্রি-ডিসমিস্, তহবিল তছরূপ হিসাবের খাতা প্রভৃতি বৈষয়িক জীবনের অনুষদের কথা শুনি: ঘুড়ি ওড়া, পাশা খেলা প্রভৃতি আমোদ-প্রকরণকে রূপক-রূপে ব্যবহৃত হইতে দেখি বহু বিবাহ-বিড়ম্বিত পরিবারে বিমাতার স্নেহহীন বিমাতৃ-শাসিত পিতার ঔদাসীন্যের খবর পাই।….. শাক্তপদাবলীতে সংসারের সমস্ত গ্লানি, কুশ্রীতা, দারিদ্র্য, রিক্ততা অনাবৃতভাবে প্রকট ও ইহার সাধনা-ক্রম অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত, উহাদের মধ্যে কোনো নিগূঢ় ব্যঞ্জনা নাই… বৈষ্ণব পদাবলীতে বাঙালীর মনের কথা যেন বেনামীতে ব্যক্ত হয় শাক্তপদাবলীতে উহার একেবারে সরাসরি প্রত্যক্ষ প্রকাশ। সেইজন্য মনে হয় যে অষ্টাদশ শতকে বাঙালীর সংসার ও ভাবজীবনে যে একটা গুরুতর পরিবর্তন ঘটিয়াছে, তাহাই তাহার ভক্তিসাধনার রীতিতে ও কাব্যপ্রকাশের নতুন ভঙ্গীতে স্বতঃই প্রতিফলিত হইয়াছে।” (ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।
Leave a comment