(১) জীবন-বোধ: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সর্বশেষ সৃষ্টি শাক্ত পদাবলী। শাক্ত পদাবলীর ধারা আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিল বলে এতে আধুনিক যুগোচিত কিছু লক্ষণ যেমন ধরা পড়েছিল, তেমনি এর কিছু লক্ষণ ছিল যুগাতীত সাধক কবি রামপ্রসাদ ছিলেন শাক্তসঙ্গীতের গোমুখী এই পদগুলিতে সাধক কবির প্রত্যক্ষ অনুভূতির আনন্দময়তা, ভক্তির নিবিড়তা, সরলতা এবং অকৃত্রিমতা এদের এক অতুলনীয় অপূর্বতা দান করেছে। রামপ্রসাদের অনুসরণে আরো অনেক ভক্তই শাক্তপদ রচনা করেছেন। সাধারণভাবে ঐ সমস্ত পদে ছিল শরণাগতির আকাঙ্ক্ষা খুবই সামান্য সংখ্যক পদে আছে সম্পদের প্রতি আসক্তি। – আঠার শতকের সামগ্রিক অবক্ষয়ের মধ্যেও শক্তিদেবতাকে অবলম্বন ক’রে ভক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। তাই আরম্ভে অনেকের রচনায় ঐশ্বর্য-লিপ্সা থাকলেও শেষ পর্যন্ত অনেকেই পারমার্থিক সিদ্ধির স্তরে উঠে গিয়েছিলেন। পশুভাব ও বীরভাবের সাধনায় শুরু করেও অনেকে যে দিব্যভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, শাক্ত পদে তার পরিচয় গোপন থাকেনি।

শাক্তপদকর্তারা ছিলেন জীবন-সাধক কবি, তাই শাক্ত সঙ্গীতকে জীবনাশ্রয়ী কাব্য বলেই অনেকে অভিহিত করে থাকেন। শাক্ত সাধনা দেহ ও জীবনাশ্রিত, তাই শাক্ত পদে ভাব ভাবনার কথা থাকলেও ইহজীবন অস্বীকৃত নয়। তাই তাঁদের ভাবনায় উপাস্যা দেবী হলেন ‘ভক্তি মুক্তি প্রদায়িনী’। একদিকে শাক্ত পদগুলিতে আছে লোক জীবনের ক্রীড়া-কৌতুক, সমাজজীবনের উৎসব-কলা, যেমন—পাশাখেলা, গ্রাবু খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, শিকার ধরা প্রভৃতি, তেমনি অন্যদিকে ইহজীবনের পরিবর্তে তাঁরা মাতৃচরণে শরণ গ্রহণকেই ঈপ্সিত বলে মনে করেছেন।

শাক্তপদগুলিতে, বিশেষভাবে ‘আগমনী-বিজয়া’-সঙ্গীত-এ পারিবারিক জীবনের অপূর্ব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। প্রত্যক্ষ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কবিরা মানবজীবনের সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের পদগুলিতেও সস্তানের প্রতি মনোভাব লৌকিকভাবে পূর্ণ। ‘আগমনী-বিজয়া’ গানে বাৎসল্য রস এবং ‘ভক্তের আকৃতিতে প্রতিবাৎসল্যের মধ্যে জননী ও কন্যার পারস্পরিক সম্পর্কেরই রূপায়ণ ঘটেছে। জীবনবোধের সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটবার অবকাশ তো এখানেই রয়েছে। জীবনাতিরিক্ত কোনো অপ্রাকৃত ঘটনার এখানে কোনো প্রবেশাধিকারই নেই। জীবনধর্মে বিশ্বাসী শক্তিসাধকগণ ছিলেন গৃহী তাদের সাধনায় সংসার বৈরাগ্য নেই, অতএব শাক্ত কবিরা পদ রচনায় যথার্থ জীবন-বোধের পরিচয় দানে কোনো কৃপণতা করেন নি।

শাক্তপদ যখন রচিত হয়, তখন সমগ্র দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনীতিক দিক থেকে গভীর ঘোর তমসায় আচ্ছন্ন–তৎকালীন জনজীবনের সেই দুঃখক্লান্ত, নিষ্পেষিত, পীড়িত চিত্র শাক্তপদে বেশ উজ্জ্বল রেখায় পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। “শাক্ত পদাবলী মানবজীবনের বহু বিচিত্র চিত্র, চরিত্র, আশা কামনা ও ভাব-কল্পনার রূপায়ণ, এগুলি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জীবনের অমর আলেখ্য, তাই কাব্য হিসবে ইহাদের মূল্য অসাধারণ।”

জীবনধর্মী হওয়া সত্ত্বেও শাক্ত পদাবলী মূলত ধর্মাশ্রয়ী কাব্য বলেই এতে জীবনের বহু বিচিত্র সুর বর্তমান থাকলেও আধ্যাত্মিকতাই এর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। তাই এতে সৌন্দর্যসৃষ্টির প্রয়াস গৌণ—প্রধানত আবেগ, ভক্তি ব্যাকুলতা, একান্ত শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার বিচারে শাক্তপদগুলি প্রার্থনাসঙ্গীত-রূপে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে উঠেছে। পদগুলির আধ্যাত্মিক মূল্য-বিষয়ে ডঃ সুশীল কুমার দে বলেন, “Its treatment of the facts of religious experience is not less appealing but all the more artistic because it is so sincere and genuine, because it awakens a deep sense of conviction.”

শাক্ত পদাবলীতে ধর্মীয় ভাব তথা আধ্যাত্মিকতা থাকা সত্ত্বেও যখন ইষ্টদেবতার মাধুর্য ঘন রূপ আরোপিত হয় তখন স্বভাবতঃই এতে সৌন্দর্য এবং কবিত্ব সঞ্চারিত হয়ে থাকে। লৌকিক সম্পর্কের মধ্যে অরাপের রসময় রাপকল্পনায় শাক্তপদকর্তারাও যে কবি এবং ভাবুক হয়ে ওঠেন, তার পরিচয় বহু শাক্তপদেই বর্তমান। শাক্ত পদাবলীর উমা-সঙ্গীতে রয়েছে বাৎসল্য রস—যার তুলনা বাংলা সাহিত্যে মেলে না, এর শ্যামা সঙ্গীতে রয়েছে প্রতিবাৎসল্য বা ভক্তিরস—বাংলা সাহিত্যে এ জাতীয় পদেরও স্বল্পতা লক্ষণীয়, মাতা ও সন্তানের সম্পর্কে যে বিচিত্র রসধারার সৃষ্টি হয়, শাক্তপদাবলী তার এক অনুপম ভাণ্ডার। শাক্ত পদাবলী ‘শাক্তের সাধ্য ও সাধনরূপ দুরূহ তত্ত্ব এই ভাবের অবলম্বনে রসোীর্ণ কাব্যে রূপান্তরিত হইয়াছে।”

শাক্ত পদে বাৎসল্য এবং প্রতিবাৎসল্যের রসরূপ যেমন সমগ্রতায় বিধৃত রয়েছে, তেমনি এতে ঘটেছে লীলা ও তত্ত্বের সমন্বয় ঊমাসঙ্গীতে তথা আগমনী ও বিজয়াতে ফুটে উঠেছে জগন্মাতার রসমধুর লীলা অংশ, আর ভক্তের আকৃতি’ এবং ‘জগজ্জননীর রূপ’ পর্যায়ে আছে শক্তিসাধনার তত্ত্বাংশ।

ধর্মীয় সাহিত্য হয়েও শাক্তপদাবলী ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতামুক্ত এক উদার সর্বজনীনধর্মবোধ দ্বারা অভিভূত শক্তিসাধকের দৃষ্টিতে তাই শ্যাম ও শ্যামা একাকার। অনেক শাক্ত কবিই কালীকে‌ কৃষ্ণরূপে দেখবার বাসনাও মনে পোষণ করেছেন। ভেদবুদ্ধির অতীত এই সর্ব-সমন্বয়ী মনোভাবের পশ্চাতে শাক্ত সাধকের দিব্য অনুভূতি সক্রিয় ছিল বলে অনুমান করা চলে।

শক্তিদেবতা শাক্ত পদাবলীতে যে মূর্তিতে ভক্তের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছেন তাতে রয়েছে কঠোরতা এবং কোমলতার সমন্বয়। কারণ দেবীর ঐশ্বর্য এবং মাধুর্য—উভয় রূপই যে এখানে প্রকট। ‘করালবদনী, বিকটরূপিণী, মুণ্ডমালা-বিভূষিতা’ রূপে যেমন দেবীর রূপ চিত্রিত হয়েছে, তেমনি তিনি দেখা দিয়েছেন ‘বরাভয়দাত্রী, জগজ্জননী’-রূপেও। কন্যারূপিণী উমা তো সামান্য মেয়ে নয়।

ভাবের সরলতা ও অকৃত্রিমতা শাক্ত পদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বতঃস্ফূর্ত, ভক্তিপ্রণোদিত বলেই কঠিন তত্ত্বও শাক্তপদে সহজভাবে ধরা পড়েছে, নিরাবরণ ভাবের মতোই শাক্ত পদের প্রকাশভঙ্গিও অপেক্ষাকৃত নিরাভরণ। শাক্ত পদে আন্তরিক ভক্তির দ্বিধাহীন প্রকাশ ঘটেছে তার আবেগোচ্ছলতা ও ভাবপ্রবণতায়। সর্বোপরি এই ধরণীর ধূলিমাখা জীবনের প্রতি মমত্ববোধ শাক্ত পদাবলীর পদে পদে বর্তমান থেকে সাধারণের নিকটও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

(২) ‘নাটকীয়তা’ : বিষয়গত এবং ভাবগত ঐ বৈশিষ্ট্যগুলি ছাড়াও শাক্তপদাবলীর প্রকাশভঙ্গিতে দুটি বিশিষ্টতার কথা বিশেষভাবেই উল্লেখ করতে হয়। এদের একটি শাক্ত পদাবলীর নাটকীয়তা এবং অপরটি এর গীতিপ্ৰাণতা।

শাক্তপদাবলী নাটক নয় কিংবা নাটকের মতো করে সাজানো গুছানোও নয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও বিভিন্ন পদকর্তা-রচিত পদগুলিকে যথাযথভাবে সাজিয়ে নিতে পারলে এখানে একটি কাহিনী গড়ে তোলা যায়। এই কাহিনীতে রয়েছে গিরিরাজ হিমালয়, গিরিরাণী মেনকা, তাঁদের বিবাহিত কন্যা উমা এবং জামাতা মহাদেব—এ ছাড়া অত্যন্ত গৌণ চরিত্ররূপে রয়েছেন, নারদ, সখী জয়া এবং প্রতিবেশীরা। সমগ্র কাহিনীটি উমা-কেন্দ্রিক হলেও এতে প্রধান ভূমিকা না মেনকার। আগমনী-বিজয়ার বিভিন্ন সঙ্গীতেই এই কাহিনীটি পাওয়া যায় এবং এর অধিকাংশ পদ মেনকার উক্তিরূপেই ব্যবহাত। গোটা কাহিনীটিকে কয়েকটি দৃশ্যপটে বিভক্ত করা চলে।

প্রথম দৃশ্য – দীর্ঘ অদর্শন-জনিত বিরহ-ব্যথায় কাতর জননী মেনকা গিরিরাজকে অনুনয় করে বলছেন, গিরিরাজ যেন সত্বর কৈলাসে গিয়ে উমাকে নিয়ে আসেন। মেনকার উক্তি থেকে স্বপ্নদর্শন, প্রতিবেশীদের গঞ্জনা এবং পূর্ব পূর্ব বারের ঊমা আগমনের স্মৃতিকাহিনী জানতে পারা যায়। গিরিরাজ সামান্য আপত্তি করে গৌরীকে আনতে স্বীকৃত হলেন।

দ্বিতীয় দৃশ্য—উমার শয়নাগার, সেখানে পিতা গিরিরাজ উমাকে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছেন। তৃতীয় দৃশ্য উমা মহাদেবের নিকট পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি চাইছেন এবং মহাদেব সানন্দে অনুমতি দান করলেন।

পরের দৃশ্যে—প্রতীক্ষারত মা মেনকাকে প্রতিবেশীরা জানালেন যে উমা আসছেন। এখানেই মেনকার সঙ্গে উমার মিলন ঘটলো। পরবর্তী দৃশ্য নবমী নিশি, দশমী আগমন আশঙ্কায় শোকাতুরা জননীর কাতর আর্তনাদে দিমণ্ডল মুখরিত এবং শেষ দৃশ্য–বিজয়া প্রভাতে, যখন

‘বিছায়ে বাঘের ছাল, খারে বসে মহাকাল,

বেরোও গণেশমাতা, ডাকে বার বার।’

জননীকে চোখের জলে ভাসিয়ে স্বামী মহাদেবের সঙ্গে উমা আবার কৈলাসে চলে গেলেন।

‘আগমনী-বিজয়া’ পর্বে নাটকীয়তার আর একটি রূপ অতিশয় সুপরিস্ফুট। এর প্রায় প্রত্যেকটি পদই কোন-না-কোন চরিত্রের উক্তি রূপে রচিত হয়েছে। অধিকাংশ উক্তিই মেনকার বাচনিক প্রকাশিত। কোনটিই মেনকার স্বগতোক্তি নয়, সর্বদাই তার সামনে অপর একজনের উপস্থিতিও অনুভব করা যায়। পদকর্তারা একটি পদে একজনের বক্তব্য পরিবেশন করেছেন। বস্তুত প্রতিটি পদকে এক একটি নাটকীয় একোক্তি (dramatic monologue)-রূপে গ্রহণ করার কোনো অসুবিধে নেই। যথোপযুক্তভাবে পদগুলিকে সম্পাদনা করতে পারলে যে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে, শাক্তপদাবলীতে এমনও পদ রয়েছে যেখানে একাধিক চরিত্রের উক্তি প্রত্যুক্তির মাধ্যমে পরপর কয়েকটি দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে। অতএব, শাক্ত পদাবলীর নাটকীয়তা যে একটি বিশেষ গুণ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের কবিতার কোনো কাহিনী নেই—ভক্ত এখানে বদ্ধজীবরূপে দুঃখকষ্টময় সংসারে নির্যাতন ভোগ করছে এবং মাতৃচরণে শরণ গ্রহণ করতে চাইছে। এখানে যেমন কোনো কাহিনী নেই, তেমনি কোনো বহিঃসংঘাতও নেই। এখানে উক্তিপ্রত্যুক্তিও নেই— ভক্ত নিজের মনে জগন্মাতাকে সম্বোধন ক’রে আত্মনিবেদন করে যাচ্ছেন, অতএব নাটকের হিসেবে একে নাটকীয় একোক্তি (dramatic monologue) নামে অভিহিত করা চলে। আপাতদৃষ্টিতে এতে নাটকীয়তা তেমন লক্ষণীয় না হলেও এর অন্তর্দ্বন্দ্ব অতিশয় তীব্র।

অধ্যাপক জাহ্নবী চক্রবর্তী বলেন– “শাক্তপদাবলীর এই পালাটিকে সার্থক High Tragic Comedy বলা যায়। ইহা জীবনের বিবিধ জটিল সমস্যায় পূর্ণ, তাই High; ইহাতে প্রতিকূল পক্ষের শক্তি অপরিসীম এবং সংঘাত প্রচণ্ড, নায়কের জীবনে দুঃখের অভিঘাত অতি প্রবল, তাই মধ্যপথে ইহা Tragic: শেষ পর্যন্ত প্রতিকূল সংঘাতকে অতিক্রম করিয়া নায়ক সিদ্ধকাম, বিপক্ষ পরাজিত তাই ইহা Comedy বা হর্ষাপ্ত। এই নাটকের দ্বন্দ্ব বাহিরের নয়, সম্পূর্ণরূপে মনের—ইহাই খাঁটি অন্তর্দ্বন্দ্ব; এ অন্তর্দ্বন্দ্বের তীব্রতা প্রমত্ত ঝটিকা হইতেও বদ্ধজীবের অন্তর্দ্বন্দ্ব সুতীব্রতর। ইহার জয়-পরাজয়ের কাহিনী আরও চিত্তাকর্ষক ও গুঢভাবের ব্যঞ্জক।”

(৩) গীতিপ্রাণতা : অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী তান্ত্রিক সাধকমাত্রকেই কবি বলে অভিহিত করে বলেছেন—“তান্ত্রিক সাধকের চিত্ত ধ্যানানন্দে বিভোর, প্রজ্ঞালোকে সমুদ্ভাসিত, কিন্তু তাহার দৃষ্টি সঞ্চল সামাজিক সমস্যা, দুঃখ ও প্রশ্নের ওপর নিপতিত। ইহাই তন্ত্র-সাধনার বিশিষ্টতা। তান্ত্রিক সাধক জীবন সাধক যোগী, তিনি গীতো গৃহস্থ সন্ন্যাসী এবং কবি।” অধ্যাপকের এই বিশ্লেষণ থেকে আমরা শাক্ত পদগুলিকে অনায়াসেই কবিত্বধর্মী বলে গ্রহণ করতে পারি।

আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কবিত্বের কোনো স্বভাব-বৈরিতা নেই, কাজেই সাধন সঙ্গীত হওয়া সত্ত্বেও শাক্তপদগুলির যে উৎকৃষ্ট কাব্য-ধর্মযুক্ত এ বিষয়ে ভাবতে অসুবিধের কারণ নেই। মধ্যযুগের বৈষ্ণবপদগুলিও অনুরূপ গুণবিশিষ্ট। আধুনিক যুগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ই তো কাব্যগুণে বিশ্বজয় করেছে। এবং এটি ও ‘পূজা’ পর্যায়ের গানগুলিও যে বস্তুত এক ধরনের সাধন-সঙ্গীত, তা’ কি অস্বীকার করা চলে?

মনীষী প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী মস্তব্য করেছেন, “Shakta poetry represents the lyrical cry of the human soul in presence of all that is tremendous and death dealing in universe.” কবিত্বের সঙ্গে গীতিপ্রাণতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অতএব শাক্ত পদাবলী যে গীতিধর্মী তাকে প্রায় স্বতঃসিদ্ধরূপেই স্বীকার করে নিতে হয়, কারণ শাক্তপদ সাধক কবির ব্যক্তিগত অনুভূতির বাঙ্ময় প্রকাশমাত্র। শাক্ত পদগুলি সাধারণত ‘শাক্তসঙ্গীত’ নামেই অভিহিত হয়, এই পদগুলিকে সঙ্গতি আরোপিত না করলে এদের মনোহারিত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে না। এই হিসেবে বাংলা ভাষায় রচিত অপর যে কোনো গীতিকবিতা থেকেই শাক্ত পদের গীতধর্মিতাকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হয়।

কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষায় কবিতা হ’ল ‘spontaneous overflow of powerful feelings – শাক্ত গীতিকবিতাগুলি শাক্ত কবির ব্যক্তিগত প্রগাঢ় ভাবানুভূতির স্বতঃস্ফূর্তি প্রকাশরূপে বিবেচিত হয়। শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ পর্যায়-রূপে অভিহিত করা চলে ‘আগমনী-বিজয়া’র পদগুলিকে। একদিকে যেমন এখানে অভাবিত পূর্ব কন্যাসাধনার অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি দিবারসপিপাসার সঙ্গে কাব্য-রসের সমন্বয়ে এক নোতুন রসের সৃষ্টি হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ এর সম্বন্ধে বলেন– “আমাদের এই ঘরের স্নেহ ঘরের দুঃখ, বাঙালীর গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া বাঙালীর হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালীর অম্বিকাপূজা এবং বাঙালীর কন্যাপূজাও বটে। আগমনী ও বিজয়া বাঙালীর মাতৃহাদয়ের গান।” – রবীন্দ্রনাথ যাকে গানের স্বীকৃতি দিয়েছেন, তার গীতিপ্রাণতা নিয়ে কি সংশয় থাকতে পারে?

অধ্যাপক Thompsons বলেন যে পদগুলি—’from the region of religion into that of poetry– ধর্ম থেকে কাব্যে উত্তীর্ণ হয়েছে। শক্তিসাধনার সার্বজনীন গূঢ় তত্ত্বসমূহও যে কবির ব্যক্তিগত ভাবনা কামনার অনুরঞ্জনে রঞ্জিত হয়ে রসে ও মাধুর্যে মণ্ডিত-রূপে বিভিন্ন পদে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে, তার প্রমাণ প্রায় সব পদেই কবির আত্মভাষণে রয়েছে। বহু কবিতাতেই আমি, আমার, আমায়’ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার গীতিকবিতার মন্ময়তাকে (subjectivity) সুস্পষ্ট করে তুলেছে। শাক্ত কবিরা ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নিজস্ব ভাবে ভাষায় ও ঢং-এ প্রকাশ করেছেন এই নিজস্বতার জন্যই শাক্ত পদগুলিকে খাঁটি গীতিকবিতা না বলে উপায় নেই। বলাবাহুল্য আধুনিক যুগের এই মনোভাব যে সুস্পষ্টরূপে শাক্ত পদেই প্রথম সংক্রামিত হয়েছিল, তাও স্বীকার করে নিতে হয়।

অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীর ভাষায়, “অকৃত্রিম হৃদয়ভাবের আবেগোচ্ছল প্রকাশ হিসাবেও শাক্ত পদ গীতিকবিতার সমধর্মী। …একদিকে অধ্যাত্মজগতের সংবেদন, ভক্তের আবেগ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, সিদ্ধির আনন্দ– অপরদিকে মর্ত্যলোকের অভীপ্সা, মানুষের দুঃখসুখ, আকৃতি, মিনতি, উত্তেজনা সংকল্প। এই বিচিত্র ভাবের আত্মোচ্ছাস সার্থক গীতিকবিতার লক্ষণ, শাক্তপদগুলি এই লক্ষণা ক্রান্ত।