সেন রাজসভায় সাহিত্যচর্চা
লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় ‘পঞ্চরত্নের’ সমাবেশ ঘটেছিল; এঁরা হলেন কবি জয়দেব, উমাপতি ধর, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন আচার্য। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে’র প্রশস্তি-শ্লোক, ‘সুভাষিতাবলীর’ (১৫শ শতাব্দী) শ্লোক এবং শ্রীমদ্ভাগবতের ‘বৈষ্ণবতোষণী’ টীকা-গ্রন্থের সাক্ষ্যে মনে হয়, এঁরা ছিলেন সমসাময়িক। জয়দেবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ‘স্বরাজ্যে স্বরাট্’।
উমাপতি ধরঃ উমাপতি ধরের কাব্যকলার পরিচয় বহন করছে দেওপাড়া এবং মাধাই নগরের প্রশস্তিলিপি এবং ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’র একানব্বইটি শ্লোক। তাঁর রচনার প্রধান লক্ষণীয় বিশেষত্ব হল, বাক্যের পল্লবিত বিস্তার তথা গৌড়ী রীতির চূড়ান্ত অনুসরণ। অবশ্য সহজবোধ্য পংক্তি কিছু পাওয়া যায় এইসব শ্লোকের মধ্যে; যেমনঃ
“বাচঃ পরং ভজস্ত্যেতা দেবি প্রণয়চাতুরীম্। হৃদয়স্য তু সর্বস্বং ত্বমেবৈকপ্ৰিয়া মমম্॥”
তবে এই সঙ্কলন গ্রন্থে আর এক কবি উমাপতির কথা জানা যায়। ইনি রাজা চাণক্য চন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘চন্দ্রচূড়’ কাব্য রচনা করেছিলেন বলে জানা গেছে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, “এই দুই উমাপতি এক এবং অভিন্ন হওয়া বিচিত্র নয়”
শরণঃ দুরূহ ও দ্রুত পদ রচনার (জয়দেবের ভাষায়, “শরণঃ শাঘ্যে দুরূহ দ্রুতে’) ক্ষেত্রে কবি শরণের প্রতিভা ছিল অসামান্য। তাঁর পদবী নিয়ে সংশয় আছে। ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ শরণদেব, শরণদত্ত, শরণ এবং চিরন্তন শরণ ইত্যাদি নামে বাইশটি কবিতা আছে। আছে কিছু রূপ গোস্বামীর ‘পদ্যাবলী’তে। তাঁর রচিত কবিতা বেশ কঠিন—
“পীযুষং বিষমপ্যসূত জলধিঃ কান্তে কঙ্কালস্য চ…”
ধোয়ীঃ কবি ধোয়ীর খ্যাতি ছিল শ্রুতিধর রূপে। তাঁর অন্যতম সৃষ্টি ‘পবনদূত’ কাব্য ‘মেঘদূত’ অনুসরণে লেখা হয়। বৈদভী রীতিতে লেখা এই কাব্যে যুবরাজ লক্ষ্মণসেনের দাক্ষিণাত্য অভিযান কালে কুবলয়বতী নামে এক গন্ধর্বকন্যার প্রণয় নিবেদন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে—
“তস্মিন্নেকা কুবলয়বতী নাম গন্ধর্বকন্যা
মন্যে জৈত্র মৃদু কুসমতোহ প্যায়ধুং যা স্মরণ্য”।
গোবর্ধন আচার্য : গোবর্ধন আচার্যের দক্ষতা ছিল শৃঙ্গার-বিষয়ক পদ রচনায়। আর্যা ছন্দে লেখা তাঁর ‘আর্যাসপ্তশতী’ বাংলার বাইরেও খ্যাতিলাভ করে। আদিরসের প্লাবন থাকলেও পরিহাস ও তির্যকতায় তার রচনা স্বাদু ও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে :
“ঋজুনা নিধেহি চরণৌ পরিহর সখি নিখিল নাগরাচার।
ইহ ডাকিনীতে পল্লীপতিঃ কটাক্ষেঽপি দণ্ডয়তি ॥ ”
কন্যার শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার ঘরোয়া দৃশ্যও তার কাব্যে দেখা যায়।
জয়দেব : ভাব-ভাষা-বাচনভঙ্গি ছন্দ ব্যবহারে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব কোন ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। অবক্ষয়ী সংস্কৃত সাহিত্যের যুগে জাত হয়েও কেন তাঁর কবি-ব্যক্তিত্ব এত সম্মানিত, তা সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করেছেন মনীষী সুনীতিকুমার : “Jayadeva sang not only the swan song of the age which was passing away, but he also sang in the advent of a new age in Indian Literature ‘the vernacular age’. He thus stands at the Juga Sandhi, a confluence of two epochs, with a guiding hand for the new epoch that was coming. Jayadeva can fully be called ‘The Last of the Ancients’ and the First of the Moderns’ in Indian poetry.
অনুরূপভাবে, ষোড়শ শতকের সস্ত কবি নাভাজী দাসও ‘ভক্তমাল’ বলেছেন— “জয়দেব কবি নৃপচক্কবৈ, খণ্ড মণ্ডলেশ্বর আণি কবি”, অর্থাৎ কবি জয়দেব হচ্ছেন চক্রবর্তী রাজা, অন্য কবিগণ খণ্ড মণ্ডলেশ্বর মাত্র।
জয়দেবের কবিতায় ভাবকলা ও রূপকল্প একান্তভাবেই মৌলিক। বাঙালী মনের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষা ও মানসিকতার সেতুবন্ধন করে তিনিই প্রথম কাব্য রচনা করলেন। চিরায়ত কৃষ্ণকথাকে রোমান্টিক এবং মানসিক পরিমণ্ডলে স্থাপন করেছেন। তাঁর কবিতা যেমন বৈষ্ণব পদাবলীকে আলোকিত করেছে, তেমনি সহজিয়া সম্প্রদায়, বল্লভাচারী সম্প্রদায়, শিখদের আদিগ্রন্থ প্রভৃতি নানাবিধ ভক্তি-নির্ভর রচনাশাখাকে বিভাবিত করেছে। অন্যদিকে গীতিকাব্যের অন্যতম পথিকৃৎ রূপেও তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যে নিত্য স্মরণীয় হয়েছেন মাইকেল মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে প্রমুখ কবিদের কাছে।
Leave a comment